ঢাকাট্রিবিউন
‘কিশোর গ্যাং’ থামানো যাচ্ছে না কেন?

‘কিশোর গ্যাং’ থামানো যাচ্ছে না কেন?

বিভিন্ন পক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আধুনিক প্রযুক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক কারণ ছাড়াও কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তারের পেছনের গডফাদাররাও দায়ী। তারা এই কিশোরদের চাঁদাবাজি, জমি দখল, প্রভাব বিস্তার ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে কাজে লাগান এবং অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করেন। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে জামিনে ছাড়িয়ে আনেন। চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে এক চিকিৎসক নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ীদের মদদদাতা হিসেবে ছাত্রলীগ নেতার জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ----------------------------------------------- চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার ছাত্রলীগ নেতা ----------------------------------------------- চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের হাত থেকে নিজের ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে গত ১০ এপ্রিল হামলার শিকার হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চিকিৎসক কোরবান আলী। গত ৫ এপ্রিল বিকেলে চট্টগ্রামের আকবরশাহ এলাকার পশ্চিম ফিরোশাহ হাউজিং এলাকা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তার ছেলে আলী রেজা। তিনি তখন দেখেন দুই স্কুল ছাত্রকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মারধর করছেন। মারধরের শিকার দুই স্কুলছাত্র তাকে দেখে সহায়তা চান। তখন তিনি ওই স্কুল ছাত্রদের বাঁচাতে পুলিশের ৯৯৯-এ ফোন করেন। ফোন পেয়ে পুলিশ এসে একজনকে ধরে নিয়ে যায়। ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি (আলী রেজা) ইফতারি কিনতে বাসা থেকে বের হন। তখন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা একা পেয়ে তার ওপর হামলা চালায়। ছেলেকে মারধরের খবর পেয়ে তাকে রক্ষা করতে ছুটে যান তার বাবা দন্ত চিকিৎসক কোরবান আলী। তখন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা তার ওপরও হামলা চালায়। তারা ওই চিকিৎসকের মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করায় তিনি গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়ার পর আইসিইউতে রেখে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ১০ এপ্রিল তিনি মারা যান। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি গোলাম রসুল নিশানের অনুসারী বলে জানা গেছে। হামলার পর ছাত্রলীগ নেতা গোলাম রসুল নিশান ও কিশোর গ্যাংয়ের ১১ সদস্যকে আসামি করে মামলা হয়েছে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) আকবরশাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাস রাব্বানী বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিনজনকে আটক করেছি। ছাত্রলীগ নেতাকে এখানও আটক করতে পারিনি। মামলাটি এখন হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়েছে।” তিনি বলেন, “ছাত্রলীগ নেতা নিশান এই গ্রুপটি পরিচালনা করতেন। গ্রুপটির মাধ্যমে সে ওই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও নানা অপরাধ করাত বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।” কিশোর দলের মারধরের শিকার হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে থাকা চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে/সংগৃহীত এদিকে নিহত কোরবান আলীর ছেলে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আলী রেজা বলেন, “যে তিনজনকে আটক করা হয়েছে তারা মূল আসামি নয়। মূল আসামি ছাত্রলীগ নেতা নিশানসহ অন্যরা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। হামলার পর ওই দিন রাতে আমি যখন থানায় মামলা করতে যাই, তখন ছাত্রলীগ নেতা নিশানও থানায় ছিল। কিন্তু পুলিশ তাকে তখন আটক করেনি। আমার মনে হয় আমি বাবা হত্যার ন্যায়বিচার পাব না।” তিনি বলেন, “ছাত্রলীগ নেতা নিশান এলাকায় গত ৫-৮ বছর ধরে কিশোর গ্যাং পরিচালনা করে আসছে। ওই কিশোরদের দিয়ে সে মাদক-ব্যবসা, চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা অপকর্ম করিয়ে আসছে। তার পরিবার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ ভয়ে মুখ খুলত না।” আলী রেজা জানান, তারা দুই ভাই এক বোন। মা ক্যান্সার আক্রান্ত। বাবাকে হত্যার পর এখন অসহায় অবস্থায় পড়েছে পরিবারটি। ---------------------- কিশোর গ্যাং ও ‘বড় ভাই' ---------------------- চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) একজন কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি  পুলিশ ও র‍্যাব চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের একটি তালিকা করেছে। তাদের তালিকা মতে চট্টগ্রাম শহরে ২০০ কিশোর গ্যাং সক্রিয়। এসব দলে পাঁচ থেকে ২০ জনের সদস্য আছে। কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতারা। আছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও। তারা চট্টগ্রাম শহরে কিশোর গ্যাংয়ের এমন ৬৪ জন ‘বড় ভাই' চিহ্নিত করেছেন।” পুলিশ ঢাকায় কমপক্ষে ৮০টি বড় ধরনের কিশোর গ্যাং থাকার কথা বলছে। এছাড়া আরও ছোটখাটো অনেক কিশোর গ্যাং আছে। ঢাকার কমপক্ষে ২১ জন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাং-কে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অভিযোগ আছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, “তাদের যারা ব্যবহার করে, তারাই নতুন নতুন গ্রুপ তৈরি করে। এক গ্রুপ আটক হলে আরেক গ্রুপের জন্ম হয়। শুরুতে কিশোর গ্যাং ধনীদের কিশোর সন্তানরা ফ্যান্টাসি থেকে তৈরি করত। এখন এটা সব পর্যায়ে। আমরা এখন কিশোর ছিনতাইকারী গ্রুপও পাচ্ছি।” ২০২২ সালের শুরুর দিকে সারাদেশের কিশোর গ্যাং নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। তাতে সারাদেশে কমপক্ষে ১৭৩টি কিশোর গ্যাংয়ের কথা বলা হয়েছিল। বিভিন্ন অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে সারাদেশে মামলা হয় ৭৮০টি। এসব মামলায় আসামি প্রায় ৯০০ জন। তখন রাজধানী ঢাকায় কিশোর গ্যাং ছিল ৬৬টি, চট্টগ্রামে ৫৭টি। মহানগরের বাইরে ঢাকা বিভাগে ২৪টি গ্যাং। বেশির ভাগ বাহিনীর সদস্য ১০ থেকে ৫০ জন। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, গত দুই বছরে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা সারাদেশে দুই গুণেরও বেশি হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের নৃশংসতার উদাহরণ চট্টগ্রামের চিকিৎসককে হত্যা। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ঢাকাসহ সারাদেশে হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করছে। পুলিশের হিসাব বলছে, ২০২৩ সালে শুধু রাজধানী ঢাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ২৫ জন নিহত হয়েছেন। ২০২২-২৩ দুই বছরে তাদের হাতে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ। ঢাকার অদূরে সাভারের আরাপাড়ার বালুর মাঠ এলাকায় ১২ এপ্রিল রাতে সাজ্জাদ হোসেন নামে এক রং মিস্ত্রিকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তিনি ওই এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আড্ডা দিতে বারণ করেছিলেন। এটা নিয়ে কথা কাটাকটি হওয়ায় কিশোর গ্যাংয়ের এক সদস্যকে চড় মারেন সাজ্জাদ। এরপর তারা সেখান থেকে চলে গিয়ে দল ভারি করে ফিরে এসে সাজ্জাদকে হত্যা করে। জানা গেছে, ওই কিশোররা স্থানীয় একজন যুবলীগ নেতার অনুসারী। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি শেরপুর জেলার শ্রীবরদি এলাকায় বিপ্লব হাসান নামে একজন এসএসসি পরীক্ষার্থীকে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। কথা কাটাকাটির জের ধরে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ভোলার দৌলতখান উপজেলায় মোহাম্মদ রাব্বী নামে একজন কলেজ শিক্ষার্থীকে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা তার জুনিয়র হওয়ায় তাদের গুরুত্ব না দেওয়ায় রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ। গত বছরের ২৪ আগস্ট ঢাকার দক্ষিণখান এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে রাফসান নামে ১৭ বছরের এর কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তখন আরেক কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, সিগারেট খাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। ওই বছরের ১৭ মে ঢাকার মিরপুরে এক স্কুল ছাত্রকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হতে না চাওয়ায় সিয়াম (১৪) নামের ওই কিশোরকে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ তখন জানায়। নিহত কিশোরের পরিবারের অভিযোগ, ওই কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে প্রভাবশালীরা জড়িত। পুলিশ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা নিলেও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি। ------------- সমস্যা কোথায়? ------------- পুলিশ জানায় প্রায় ১৬ বছর আগে ঢাকার উত্তরা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা প্রথম নজরে আসে। এরপর তা আর থামেনি। সেই কিশোর গ্যাং এখন ঢাকাসহ সারাদেশে এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। হত্যা থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই যাতে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িত নয়। তাদের এই অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একজন কর্মকর্তা বলেন, “কিশোর গ্যাংগুলোর নেপথ্যে আছে প্রভাবশালীরা। বিশেষত রাজনৈতিক নেতা এবং হোয়াইট কলার ক্রিমিনালরা কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যে থাকে। তারা তাদের রাজনৈতিক শো-ডাউন থেকে শুরু করে নানা অপকর্মে এইসব গ্যাংকে কাজে লাগায়। অস্ত্র দেয়, অর্থ দেয়। ফলে গ্যাংয়ের সদস্যরাও নিজেদের ক্ষমতাধর মনে করে এবং কাউকে পরোয়া করতে চায় না। জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধে।” ডিএমপি গত দুই মাসে রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের কমপক্ষে ২০০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। গত মার্চ মাসে দুই দিনের ধারাবাহিক অভিযানে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করে তারা। তারপর তাদের সংখ্যা কমছে না। নতুন নতুন গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, “আমরা তো চেষ্টা করছি। কিন্তু আইন প্রয়োগ তো সর্বশেষ স্তর। শুধু আইন প্রয়োগ করে এই কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। এখানে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। আমাদের নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। এই সময়ে কিশোররা অনলাইনে অনেক কিছু দেখে। ফেসবুকের মাধ্যমে সংগঠিত হয়। তাদের খেলার মাঠ নাই, বিনোদনের ব্যবস্থা নাই। এগুলো দেখতে হবে। আর দেশের ছয়টি কিশোর সংশোধানাগারে ১,১০০ কিশোরকে জায়গা দেওয়া যায়। কিন্তু দেশে ওই বয়সের ছেলে-মেয়ে আছে সাড়ে চার কোটি।” তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “একটি মহল এই কিশোরদের ব্যবহার করছে সত্য। কিন্তু তাদের আইনের আওতায় আনা প্রচলিত আইনে বেশ কঠিন। কারণ তাদের জড়িত থাকা তো আদালতে প্রমাণ করতে হবে।” আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং কিশোর অপরাধ বিষয়ক গবেষক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, “কিশোরদের নানা অপরাধে কাজে লাগানো সহজ। ফলে সমাজের প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী বিশেষ করে কাউন্সিলর, নির্বাচিত জন প্রতিনিধি তাদের ব্যবহার করছে। কারণ ভাড়াটে অপরাধী ব্যবহার করা অনেক খরচের ব্যাপার।” তবে তিনি মনে করেন, “কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের সমাজ ও পরিবার থেকে কাজ করতে হবে। এর মূল অনেক গভীরে। বিশেষ করে এখন যে ডিজিটাল যুগ তাতে আমাদের অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করার আছে।” পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে বাংলাদেশের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কিশোর গ্যাং নিয়ে কথা বলেছেন। গত ৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিশোর গ্যাং মোকাবিলার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সবাইকে যুক্ত হতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, “অন্য অপরাধীদের মতো নয়, তাদের (কিশোর গ্যাং) ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। কিশোর অপরাধীরা যেন সংশোধনের সুযোগ পায় সেজন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে।”
Published on: 2024-04-14 08:10:46.377028 +0200 CEST