ঢাকাট্রিবিউন
এবার ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

এবার ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

সাধারণত বর্ষার ঠিক আগে আগে শুরু হয় ডেঙ্গুর প্রকোপ। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়টাকে ডেঙ্গুর মৌসুম ধরা হয়। সেই হিসেবে ডেঙ্গু মৌসুম শুরু হতে আরও এক মাস বাকি। তারপরও এখনই প্রতিদিনই আসছে ডেঙ্গু রোগী। ফলে এবার ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে এমনই আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এবারের প্রস্তুতি কেমন? সিটি কর্পোরেশন আগে থেকেই কি ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে? জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, “পুরো বছরজুড়েই সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম চলে। বিশেষ করে ডেঙ্গু মৌসুমে এই কার্যক্রমটা ব্যাপকভাবে চালানো হয়। এবার নতুন করে আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেটা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে ২২ এপ্রিল থেকে। তিনি বইলেন, “আমরা দেখেছি, স্ত্রী এডিস মশার সবচেয়ে বেশি জন্ম হয় ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার, দইয়ের খুটি, চিপসের প্যাকেটসহ এই ধরনের জিনিসপত্রের মধ্যে। ফলে সর্বশেষ মিটিংয়ে আমরা এবার এগুলো টাকা দিয়ে কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেমন চিপসের খালি প্যাকেট এক টাকা; দইয়ের হাড়ি, ডাবের খোসা দুই টাকা; পরিত্যক্ত টায়ার ৫০ টাকা করে কিনব। ২২ এপ্রিল থেকে এই কার্যক্রম শুরু হবে। আমরা সবার কাছ থেকেই এটা কিনব। আমরা ধারণা করছি, এতে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি হবে এবং মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে।” ছবিটি রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতাল থেকে তোলা/মেহেদি হাসান/ঢাকা ট্রিবিউন গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরই কম-বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এ বছর গত ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২২ জন। এ সময়ের মধ্যে ১,৭৮৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এখনও মৌসুম শুরু না হলেও ডেঙ্গু রোগীর চাপ কেমন? জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “জানুয়ারি মাস থেকেই ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে। এখন তুলনামূলক একটু কম। তারপরও প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে।” ডেঙ্গু মৌসুমে পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রস্তুতি কেমন? জানতে চাইল তিনি বলেন, “আমাদের সব সময়ই প্রস্তুতি থাকে।” ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত রোগ। এ রোগের ভাইরাসের একমাত্র বাহক স্ত্রী এডিস মশা। এ মশার মাধ্যমে ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত হলে ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে এডিস মশা কামড়ালেও মশার মধ্যে ভাইরাস সংক্রমিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত বাহক অন্য জায়গায় ভ্রমণের মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ একজন আক্রান্ত ব্যক্তি যখন অন্য জায়গায় ভ্রমণ করেন, সেখানে তাকে এডিস মশা কামড়ালে সেই মশার ভেতরেও ডেঙ্গুর জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধি পায় বলে এ সময় ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এমন ধারণা প্রচলিত থাকলেও বিগত কয়েক বছরে দেখা গেছে, উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বছরের যেকোনো সময় এ মশার বংশবিস্তার ঘটে এবং ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীদের একাংশ। বেডের অভাবে তাদের জায়গা হয়েছে মেঝেতে। ৯ আগস্ট,২০২৩/ফোকাস বাংলা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১,৭৮৯ জন এবং মারা গেছেন ২২ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে রোগী ছিল ১,০৫৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯ জন এবং মার্চে ৩১১ জন। এপ্রিলের ৯ দিনে রোগী পাওয়া গেছে ৮৪ জন। গত বছর এযাবতকালের সর্বাধিক ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। তবে তখন রোগী বেশি ছিল মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ বছর জানুয়ারিতেই হাজারের বেশি রোগী পাওয়া গেছে, যা আগে কখনও পাওয়া যায়নি। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে রোগী পাওয়া যায় ১২৬ জন, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে রোগী ছিল ৩২ জন। সারা বছরই কেন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন? জানতে চাইলে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, “আগে আমরা বলতাম মৌসুমের মধ্যে ডেঙ্গু সীমাবদ্ধ। কিন্তু এখন এটা অনেক বেড়ে গেছে। অর্থাৎ মৌসুমের বাইরেও মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন শীতকাল ছোট হয়ে গেছে। তাপমাত্রা, সূর্যের আলো, বাতাসের প্রবাহ সবকিছুই বর্তমান প্রেক্ষাপটে এডিস মশা জন্মানোর উপযোগী। এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি দরকার। শুধুমাত্র কেমিকেলের ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, যেসব জায়গায় এডিস মশা জন্ম নেয় সেগুলো ধ্বংস করতে হবে। সবকিছু দিয়ে এই মশাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে।” আগের বছরের তুলনায় এ বছর মৃত্যুও বেড়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতে মারা গেছেন ১৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন এবং মার্চে পাঁচজন। গত বছরের জানুয়ারিতে মারা যান ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন এবং মার্চে কোনো মৃত্যু ছিল না। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ডেঙ্গুতে কেউ মারা যায়নি। তার আগে ২০২১ সালেও এই সময়ের মধ্যে এই রোগে মৃত্যুর কোনো ঘটনা ঘটেনি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারে পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে নাজুক হতে পারে। সংক্রমণ ও মৃত্যু সেই পূর্বাভাস দিচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “আলামত বলছে, এবার ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আক্রান্ত বেশি হতে পারে। ডেঙ্গু চিকিৎসায় রোগীর ব্যবস্থাপনা ভালো থাকলে মৃত্যু কম হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মশা কমানো বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। গত বছর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। সেখানে বেশিরভাগ রোগী প্রথমবারের মতো আক্রান্ত হয়েছেন। এবার যদি ঢাকার বাইরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তাহলে তারা দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হবেন। আবার নতুন নতুন রোগীও আক্রান্ত হতে পারেন। এবার যদি আপনি বড় ধরনের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেন তাও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কমপক্ষে তিন বছর লাগবে। শুধু বাংলাদেশ না, সারা বিশ্বেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশে মৃত্যুর হার বেশি। এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থাও ঢেলে সাজাতে হবে। সবকিছু স্বাস্থ্য বিভাগ একা করতে চাইলে পারবে না। সিটি কর্পোরেশনের যে স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো আগে, সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন সমস্যাটা কোথায়? এরপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নিতে পারবেন। সবকিছু মিলিয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার।”
Published on: 2024-04-16 07:32:03.82589 +0200 CEST