ইত্তেফাক
বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উদ্বেগ

বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উদ্বেগ

*নির্বাচনের আগে ‘সহিংস দমন-পীড়ন’ চলছে বলে অভিযোগ করেছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)। বিএনপির প্রায় ১০ হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করে তাদের বড় অংশের বিরুদ্ধে বিচারিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেছে এইচআরডাব্লিউ।* সংগঠনটির এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র গবেষক জুলিয়া ব্রেকনার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘যখন সরকার স্বাধীন মতপ্রকাশ বন্ধ করে দেয়, নির্বিচার গ্রেপ্তার, গুম, হয়রানি, ভয় দেখানোর মাধ্যমে বিরোধী, সমালোচক ও অধিকারকর্মীদের পদ্ধতিগতভাবে অকার্যকর করে দেয়, তখন একটি অবাধ নির্বাচন অসম্ভব।’ বর্তমানে সক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি আসামি কারাগারে রয়েছে বলে দাবি করে এইচআরডাব্লিউ। বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জুয়েল মৃধা বলেন, ৫ নভেম্বর বিকেলে অবরোধ সমর্থনে মিছিল শেষ করে আমি আমার ঢাকার পরিবাগের বাসার পাশে ‘সাংস্কৃতিক বিকাশ কেন্দ্রে’ বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে আমার এক বড় ভাইও ছিলেন। তখন স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের লোকজন এসে আমাকে খোঁজাখুঁজি করে। আমি বুঝতে পেরে সেখান থেকে চলে যাই। তারা আমাকে না পেয়ে আমার চাচাতো ভাই তরিকুল ইসলাম সজীব মৃধাকে ধরে নিয়ে যায়। তারা তাকে নির্যাতন করে ও শাহবাগ থানা পুলিশে তুলে দেয়। পরে তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। সে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। তিনি আরও বলেন, নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার তো করাই হচ্ছে, তাদের না পেলে তাদের আত্মীয়-স্বজনকে আটক করা হচ্ছে। আমি গ্রেপ্তার এড়াতে এখন আত্মগোপনে আছি। ভোলার ছাত্রদল নেতা মো. হাবিুবর রহমানকে ৪ নভেম্বর রাতে তাদের পৌরসভার বাসা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তার ভাই মোহাম্মদ হাসান বলেন, ভোর রাত ৪টার দিকে পুলিশ কোনো ওয়ারেন্ট বা মামলা ছাড়াই তাকে নিয়ে যায়। পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মীরাও ছিল। আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। এখন গায়েবি মামলায় তাকে আসামি দেখানো হয়েছে। জামিনের আবেদন করে তার জামিন করাতে পারছি না।’ ভোলার চরফ্যাশন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আল এমরান বলেন, আমি এখন বাসায় নেই। বাসায় থাকতে পারি না। আমি শুধু নয় যারা বিএনপির সাধারণ সমর্থক, যারা বিএনপিকে ভোট দেয়, তারাও পলাতক অবস্থায় আছেন। তারা ভয়ে রাস্তাঘাটে বের হতে পারছেন না। কারণ, পুলিশ একাধিক গায়েবি মামলা দিয়ে রেখেছে। কাউকে ধরতে পারলেই তাদের ওই মামলায় আসামি করে কারাগারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তারা বাসায় থাকতে পারছেন না। পুলিশ বার বার গিয়ে আমাদের বাড়ি-ঘরে হয়রানি করছে। সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজনও যাচ্ছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, গায়েবি মামলার কারণে আমাদের চর ফ্যাশনে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বাইরেই বের হতে পারছে না। তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অথচ তাদের নামে গাড়ি পোড়ানোর মামলা দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিজেরাই গাড়ি পুড়িয়ে আমাদের নামে মামলা দিচ্ছে। এইচআরডাব্লিউ বলছে, সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রতিযোগিতা দূর করতে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক ও সহিংস দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে এবং ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের দিন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া অধিকাংশই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতা-কর্মী। তাদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে বিচারিক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। বিএনপির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এইচআরডাব্লিউ দাবি করে, দলটির প্রায় ৫০ লাখ সদস্যের অর্ধেকই বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচারের সম্মুখীন। বিএনপির এক কর্মী তাদের জানিয়েছেন, উচ্চ পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত কাউকে ছাড়া হচ্ছে না, সবাইকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আগামী ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে উল্লেখ করে সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশে বিরোধী দলকে দমন এবং সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রতিযোগিতা দূর করার জন্য বিরোধী রাজনীতিকদের গণগ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এটাকে ‘সহিংস স্বৈরাচারী দমন-পীড়ন’ উল্লেখ করে এইচআরডাব্লিউ জানায়, অক্টোবরে বিক্ষোভ কর্মসূচি বেড়ে যাওয়ার পর থেকে কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে দুই পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন। আহত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৫০০ এর বেশি মানুষ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার পর বিএনপি ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত হরতালের ডাক দেয়। হরতাল চলাকালে এবং হরতালের পরে পুলিশ, বিরোধী দল ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। যদিও সব পক্ষেই সহিংসতা হয়েছে, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ বিরোধীদের ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির’ জন্য দায়ী করেছে। তারা অপরাধস্থল (ক্রাইম সিন) হিসেবে বর্ণনা করে বিএনপির কার্যালয়গুলো সিলগালা করেছে। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের সিনিয়র নেতারা বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলাকে উৎসাহিত করে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে চলমান সহিংসতাকে উসকে দিয়েছেন। সব পক্ষের সহিংসতার ঘটনা পুলিশের তদন্ত করা উচিত। কিন্তু তারা যখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালায়, তখন তাদের নিরপেক্ষতা ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার সক্ষমতা ক্ষুণ্ন হয়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা চলমান সহিংসতায় দায়মুক্তি ভোগ করছে। কিন্তু বিরোধী দলের সদস্যরা ব্যাপকভাবে, প্রায়ই নির্বিচার গ্রেপ্তারের শিকার হচ্ছেন। সংস্থাটি দাবি করেছে, তারা নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, যথেচ্ছা গণগ্রেপ্তার, গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী থাকার প্রমাণ হাতে পেয়েছে। এইচআরডাব্লিউ বলছে, বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশের মোট বার্ষিক রপ্তানি পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের ৮৫ শতাংশই এই খাত থেকে আসে। অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বাংলাদেশের কারখানাগুলো থেকে পোশাক কিনে থাকে। কূটনীতিক অংশীদারদের বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার যে এ ধরনের দমন-পীড়ন অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে বিপদে ফেলতে পারে। বিএনপি রোববার জানায়, অক্টোবর থেকে শুরু করে তাদের অন্তত ১৬ হাজার ৬২৫ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির অসংখ্য শীর্ষ নেতা আছেন। প্রসিকিউটর ও আইনজীবীরা জানিয়েছেন, গত দুই সপ্তাহে বিএনপির অন্তত ৫২৬ জন নেতা-কর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং তাদের অধিকাংশের অনুপস্থিতিতে সাজা দেওয়া হয়েছে। দলটির দাবি, বেশিরভাগই অভিযোগই ‘সাজানো’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের সহিংস অপরাধের জন্য গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে বিচারিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার এবং ভিডিও ও পুলিশের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এইচআরডাব্লিউ তাদের প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বলে দাবি করেছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যা বলেছে-তা সঠিক মনে করি। সরকার হঠাৎ বিরোধী দলের বিরুদ্ধে এমন আচরণ শুরু করেছে যা বিরোধী দল যাতে নির্বাচনে না আসে তার ব্যবস্থা করছে। যেভাবে মানুষ আটকাচ্ছে, জেলখানায় নিচ্ছে তাতে এই সরকার, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা চলে যাচ্ছে।’ তিনি আরও মনে করেন, এই সরকার দেশে একটি ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে। মানুষ যদি নিরাপত্তা না পায়, তাহলে দেশে একটা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। এ ব্যাপারে চেষ্টা করেও পুলিশ সদর দপ্তরের বক্তব্য জানা যায়নি। তবে কয়েকদিন আগে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান অতিরিক্তি পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ দাবি করেছিলেন, পুলিশ রাজনৈতিক কারণে কাউকে গ্রেপ্তার করছে না। যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা এবং ওয়ারেন্ট আছে, তাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। *জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।*
Published on: 2023-11-27 17:07:17.082194 +0100 CET

------------ Previous News ------------