*নৌকার প্রার্থীর জন্য কাজ করার চেয়ে ভোটারদের তালিকা ধরে ভোট কেন্দ্রে নেওয়ার ওপর বেশি জোর দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। আর এজন্য গ্রাম ও ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে।*
অন্যদিকে বিএনপির হাইকমান্ড তাদের নেতা-কর্মীদের যার যার এলাকায় চলে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। তারা ভোটের চার-পাঁচদিন আগে থেকে ভোট বিরোধী আন্দোলন চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। একজন নেতা জানিয়েছেন, ‘ওই পর্যায়ে গ্রেপ্তারকে মাখায় রেখেই আমরা ভোটের বিরুদ্ধে অবস্থান নেব।’
আর নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেছেন, ‘ভোট দানে নিরুৎসাহিত করাও আইনের আওতায় আসবে।’
*ভোটারদের কেন্দ্রে নিতে কমিটি*
তৃণমূলের আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, কেন্দ্র থেকে আমাদের প্রতি নির্দেশনা হলো ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিত করা। তারা যেখানেই ভোট দিক না কেন ভোট কেন্দ্রে যেতে হবে।
শুধু আওয়ামী লীগ নয়, আওয়ামী লীগের সব সহযোগী সংগঠনকে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছসেবক লীগকে মূল দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা যে পরিকল্পনা করেছে তা হলো, ভোটার লিস্ট ধরে নেতা-কর্মীদের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া। প্রত্যেক নেতা-কর্মী কতজনকে ভোট কেন্দ্রে নেবেন তাদের নাম ঠিকানা নির্দিষ্ট করে দেয়া। তাদের দায়িত্ব থাকবে ওই ভোটারদের ভোট চলার সময় ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। এই ভোটারদের মধ্যে আবার যারা সরকারি নানা সহায়তা প্রকল্পের সুবিধাভোগী তাদের নির্দিষ্ট করা। তাদের ওপর আলাদা নজর রাখা।
তালিকা ধরে ভোটের আগেই ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য আগাম বলে রাখবেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এই পদ্ধতির কারণে যারা ভোট দিতে যাবেন না তাদের চিহ্নিত করা সহজ হবে বলে কয়েকজন নেতা জানান।
আওয়ামী লীগ ছাড়াও সহযোগী সংগঠনগুলোর এই কাজের জন্য এরইমধ্যে গ্রাম থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত কমিটি গঠন করা শুরু হয়েছে। যারা দলের ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পদে আছেন তাদের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এর বাইরেও লোকজন রাখা হচ্ছে। কোনো ভোটারকেই তালিকার বাইরে রাখা হবে না। আর প্রত্যেক ভোটারকেই ভোট কেন্দ্রে নেয়ার লোক থাকবে। ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নেওয়ার এই কৌশলকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে, ‘গো ভোট’ ক্যাম্পেইন নাম দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সম্পাদক সুমন জাহিদ জানান, আমাদের টার্গেট হচ্ছে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নেয়া। তারা কাকে ভোট দেবেন সেটা তাদের ইচ্ছা। আমরা এজন্য কাজ শুরু করে দিয়েছি একদম গ্রাম পর্যন্ত।
আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচনে স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহীদের ব্যাপারে তাদের কৌশল সফল হয়েছে। ফলে নির্বাচনে অনেক প্রার্থী আছেন। নির্বাচন তাই তাদের ভাষায় ‘জমে উঠেছে’। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, গ্রামাঞ্চলে ভোটারের উপস্থিতি ভালোই হবে। বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচন নিয়ে স্বতন্ত্র ও নৌকা প্রতীকের সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষকে কোনো কোনো আওয়ামী লীগ নেতা নির্বাচন যে জমে উঠেছে তার প্রমাণ হিসবেও উপস্থাপন করছেন।
তবে শহরাঞ্চল, বিশেষ করে ঢাকা শহরের আসনগুলোতে ভোটার কতটা উপস্থিত হবেন সেটা নিয়ে চিন্তায় আছে আওয়ামী লীগ। সেই কারণে ‘গো ভোট’ পরিকল্পনা ছাড়াও বাড়তি কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে শহরের বিভিন্ন এলাকার নিম্নবিত্ত ভোটারদের তালিকা করে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। ভোটার লিস্ট ডিজিটাল করা এবং প্রত্যেক ভোটারকে তার ভোটার নম্বর ও কেন্দ্র জানিয়ে মোবাইল ফোনে মেসেজ দেওয়া। আর ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার জোরদার করা।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন বলেন, ‘বিএনপির নির্বাচন বিরোধী অপতৎপরতার পরও নির্বাচন জমে উঠেছে। ভোটাররা উৎসবের আমেজে ভোট দিতে যাবেন। আর নির্বাচন বাধাগ্রস্ত বা ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হলে নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তা দেখবেন।’
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের চাপ ও হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবাই প্রার্থী। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। তারা এরইমধ্যে কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তো দলের কেউ এরকম করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য বলেছেন। ভোট নিরপেক্ষ হবে।’
*বিএনপি যা করছে*
বিএনপি ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের অসহযোগ কর্মসূচি শেষ করে নতুন কর্মসূচি দেবে। বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনের চার-পাঁচদিন আগে থেকে নির্বাচনে ভোট না দেয়ার ক্যাম্পেইন আরও জোরালো করা হবে। এজন্য নেতা-কর্মীদের যার যার এলাকায় চলে যেতে বলা হয়েছে। এই ভোট বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সহযোগী সংগঠনগুলোও তৎপর রয়েছে। এখন কোনো মিছিল বা পূর্ব ঘোষণা না দিয়েই তারা ঝটিকা লিফলেট বিতরণ করছেন। ঘরে ঘরে যাচ্ছেন। শহর গ্রাম সব জায়গায়াই তারা এভাবে কাজ করছেন। জাতীয়তাবাদী
কৃষক দলের যুগ্ম সম্পাদক ফজলে হুদা বাবুল জানান, ‘আমাদের কেন্দ্র থেকে এখন পর্যন্ত নির্দেশনা হলো ভোটাররা যাতে ভোট দিতে না যান সেটা তাদের বুঝানো। আমরা হাটে, বাজারে, যেখানে লোকজন থাকে সেখানে যাই। আমাদের লিফলেট দিই। এটা যে কোনো ভোট না তাদের বলি। তারা যাতে ভোট দিয়ে এই অবৈধ সরকারের ক্ষমতা নবায়নে সহযোগিতা না করে তা বলি।’
তার কথা, যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেভাবে পুলিশ নামানো হয়েছে তাতে এমনিতেই ভোট কেন্দ্রে মানুষ যাবে না। আরেকটি ভোটারবিহীন নির্বাচন হবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুন রায় চৌধুরী বলেন, ভোটের দিনও আমাদের কর্মসূচি থাকবে। এখন পর্যন্ত যা পরিকল্পনা তাতের আমরা ভোটের দিনও ভোট কেন্দ্রের আশপাশে থেকে ভোটারদের ভোট না দেয়ার জন্য অনুরোধ করব। ভোট না দিতে ভোটারদের মধ্যে ক্যাম্পেইন নির্বাচনের চার-পাঁচদিন আগে চূড়ান্ত পর্যায়ে নেয়া হবে। এখন আমরা গ্রেপ্তার এড়াতে চার-পাঁচ জনের ছোট ছোট গ্রুপ করে কাজ করলেও দ্রুতই আমরা একযোগে নামব। তাই আমাদের হাইকমান্ড সবাইকে যার যার এলাকায় চলে যেতে বলেছেন। গ্রেপ্তারের ভয়ে যারা ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে ছিলেন তারা এলাকায় যাওয়া শুরু করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা এবার গ্রেপ্তারকে বরণ করেই কাজ করব। কত গ্রেপ্তার করবে? সারাদেশই তো কারাগার। আমরা না হয় ছোট কারাগারে ঢুকব। ২৮ তারিখের পর যে কর্মসূচি দেয়া হবে তা আমাদের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। এরকম নির্দেশই আমাদের দেয়া হয়েছে।’
লিফলেট ছাড়াও বিএনপি দুই-একদিনের মধ্যে ভোটবিরোধী স্টিকার তৈরি করবে। ওইসব স্টিকার যানবাহন ও বিভিন্ন স্থাপনা এবং হাটে বাজারে লাগানো হবে। তাদের কথা হলো কত স্টিকার আর তুলে ফেলবে। হাজার হাজার স্টিকার লাগানো হবে। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভোটের বিরুদ্ধে কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপক প্রচার শুরু হবে বলে জানা গেছে।
নিপুন রায় চৌধুরী বলেন, ‘ভোটের দিনকে মধ্যে রেখে একটা টানা কর্মসূচি দেওয়া হবে। ২৮ তারিখের পর ওই কর্মসূচি জানানো হবে।’
বিএনপির তৃণমূলের কয়েকজন নেতা জানান, তারেক রহমান এখন থানা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গেও নিয়মিত কথা বলছেন লন্ডন থেকে। তিনি তাদের চাঙা রাখছেন। তিনি চাইছেন যেকোনো উপায়ে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন যেন গ্রহণযোগ্যতা না পায়, তার জন্য যা যা করা দরকার তাই করতে হবে। গ্রেপ্তার মেনেই সেটা করতে হবে।
*নির্বাচন কমিশন যা বলছে*
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন ভোটাররা যাতে ভোট দিতে উৎসাহিত হয় তার জন্য আলাদা কর্মসূচি নিয়েছে। আর নির্বাচন কমিশন মনে করে নির্বাচনে ভোট না দিতে বলা বা ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করা নির্বাচনী আইনের লঙ্ঘন। তারা এব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনে আসা না আসা ব্যক্তিগত বিষয়, দলীয় বিষয়। নির্বাচন নিয়ে তো বিভক্তি আছে। নিবন্ধিত দল ৪৪টি। তাদের মধ্যে বিএনপি ও তাদের কয়েকটি সমমনা দল নির্বাচনে আসেনি। আমরা আহ্বান জানিয়েছি তারা আসেনি এটা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। কিন্তু কাউকে ভোটদানে বাধা দেয়া, প্রতিহত করা বা ভোট দানে বিরত রাখা-এই অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। আইনে পরিষ্কার বলা আছে ভোটদানে বাধা দেয়া, বিরত রাখা দণ্ডনীয় অপরাধ। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
ভোটারদের ভোট দানে নিরুৎসাহিত করতে লিফলেট বিতরণও অপরাধ কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লিফলেট বিতরণ আমি আলাদাভাবে বলব না। যেকোনো উপায়ে ভোটদানে বাধা দেওয়া, ভোটদানে কাউকে নিরুৎসাহিত করা হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। আইনে যা আছে তাই হবে।’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা ভোটারদের ভোট দিতে উৎসাহিত করতে কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। তবে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নেয়ার দায়িত্ব প্রার্থীদের। আমরা রিটার্নিং, প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার এবং মেম্বার-চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দিয়েছি। তারা ভোটারদের কাছে গিয়ে ভোটদানে উৎসাহিত করবেন। ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন কোনো সমস্যা হবেনা সেটা তারা জানাচ্ছেন। আর গণমাধ্যমের জন্য বিজ্ঞাপন ও টিভিসি তৈরি করেছি, তাও প্রচার হচ্ছে।’
*জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।*
Published on: 2023-12-25 18:00:40.68417 +0100 CET
------------ Previous News ------------