ইত্তেফাক
ব্যবসার আড়ালে আকাশপথে আসছে ভয়ংকর মাদক

ব্যবসার আড়ালে আকাশপথে আসছে ভয়ংকর মাদক

ব্যবসার আড়ালে আকাশপথে দীর্ঘদিন ধরে আসছে ভয়ংকর মাদক। বুধবার রাতে দেশে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ আট কেজি ৩০০ গ্রাম সলিড কোকেনের চালান হযরত শাহজাজাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জব্দ করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। যার আনুমানিক মূল্য ১০০ কোটি টাকা। আফ্রিকার দেশ মালাউইয়ের নাগরিক নোমথেনডাজো তাওয়েরা সোকোকে (৩৫)  কোকেনের এ চালানসহ  গ্রেফতার করা হয়। নোমথেনডাজো তাওয়েরা সোকো বাংলাদেশের একটি গার্মেন্টসের অফার লেটারে এসেছিলেন। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন ব্যবসার অন্তরলে ভয়ংকর মাদক অহরহ আসছে, যার সামান্য কিছু ধরা পড়ে। একটা চালান ধরে পড়লে ২০টা চালান ধরে পড়ে না। বাংলাদেশকে নিরাপদ রুট ব্যবহার করে আসছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এদের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকসহ শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত। বিমানবন্দরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও জড়িত। এ কারণে বিমানবন্দরে নিরীহ যাত্রীদের লাগেজ চেকের নামে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। অথচ মাদক পাচারকারী ও চোরাচালানিদের লাগেজে হাত দেওয়া হয় না। নিরাপদে তারা বিমানবন্দর ত্যাগ করতে পারে। এমন অভিযোগ অহরহ পাওয়া যায়। টেকনাফসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে বন্যার মতো আসছে ইয়াবা। সারা দেশে এখন ইয়াবার ছড়াছড়ি। তবে কোকেন হলো ভয়ংকর মাদক। খেলে প্রথমে মন উত্তেজিত-উজ্জীবিত ও খুশি খুশি ভাব মনে হবে। একসময়ে গিয়ে ব্রেন ও মাংসপেশি সংকুচিত করে। কিডনিসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায় বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। অর্থাৎ কোকেন হলো প্রাণঘাতী। মাদক নিরাময়কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোকেন হলো উচ্চ মূল্যের মাদক। এ দেশে এর ব্যবহার কম হয়। বিদেশে যারা পড়াশুনা করে দেশে এসেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে কোকেনে আসক্ত। অভিজাত এক শ্রেণির মানুষ কোকেন সেবন করেন। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, মাদক হলো এমন জিনিস, যার কারণে মেধাহীন হয়ে পড়ে সমাজ। একই সঙ্গে রাজনীতিবিদ, প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগের এক শ্রেণির লোকজন মাদকাসক্ত। চিকিৎসকদের মতে, এমন কর্মকর্তাদের দেখে তারা নিজেরাই অবাক। এটা দেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক। ছাত্রছাত্রীরা মাদক সেবন করছে— এতে তরুণ সমাজ নীরবে ধ্বংস হচ্ছে। যারা মাদক ব্যবসায় জড়িত, তারা বুঝতে পারে না যে, তারা তাদের নিজের সন্তানকে হত্যার মতো অপরাধ করে যাচ্ছেন। কারণ ঐ মাদক তার নিজের সন্তানও খেয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একসময় তার মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে একসময় মাদকের কারণে মেধা হ্রাস পাবে। মাদকের কারণে অপরাধ বাড়ছে। দেশে খুন ও নারী নির্যাতন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো মাদক। প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ভয়ংকর মাদক দেশে আসার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দোষারোপ করে লাভ হবে না। সত্যিকার অর্থে মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। যে যেই দায়িত্বে আছে, সেখান থেকে মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। এটাও যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়। তিনি বলেন, যারা মাদক ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন, তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, গার্মেন্টসের অফার লেটার নিয়ে বিদেশি নাগরিকসহ ইতিহাসের সর্ববৃহৎ কোকেনের চালান জব্দ করা হয়েছে। কোকেনের একটি বড় চালান আফ্রিকান নাগরিকের মাধ্যমে ঢাকায় আসবে—এমন তথ্য পাই আমরা। এর পর থেকে আমরা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নজরদারি বাড়াই। বুধবার এপিবিএনকে সঙ্গে নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি টিম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৮ নম্বর টার্মিনালের  বোর্ডিং ব্রিজ এলাকায় অবস্থান করে। ফ্লাইটটিতে আসা বিদেশি যাত্রীদের আমরা ফলো করি। পরে ধরতে সক্ষম হয়েছি। এটা বড় সফলতা। এর সঙ্গে যারা জড়িত সবাইকে ধরা হবে। সবাইকে খুঁজে বের করতে টিম মাঠে কাজ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, বাংলাদেশে বৈশ্বিকভাবে এই মাদক খুবই ব্যয়বহুল। তাই মাদক কারবারিরা এমন নেটওয়ার্ক সাজিয়েছে, এই মাদক বাংলাদেশে বিমানবন্দরসহ যে কোনো পথে আসছে। এর সঙ্গে শুধু বিমানবন্দরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকতে পারে। লাগেজ পার্টির মাধ্যমেও আসে। আমরা মাঝেমধ্যে দুই-একটি চালান উদ্ধার করে স্বস্তি পাওয়ার সুযোগ নেই। আরো অনেক চালান আসতেছে, কী পরিমাণ চালান দেশে আসছে। দেশে যেভাবে আসক্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বোঝা যায় প্রচুর মাদক ঢুকতেছে। এর পৃষ্ঠপোষকরা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে শক্তিশালী। কীভাবে ও কোথায় চালানটি যাবে, কাকে টাকা দিতে হবে, এর একটা নকশা তৈরি করা থাকে। সামগ্রিকভাবে রুখে দিতে না পারলে সামনে আমাদের জন্য ভয়ংকর অবস্থা অপেক্ষা করছে। বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বাড়তে পারে। এর বিরুদ্ধে টার্গেট করে সামগ্রিকভঅবে কঠোর হাতে দমন করা না গেলে রোধ করা সম্ভব হবে না। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ডিএনসির উত্তর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) তানভীর মমতাজ জানান, কোকেনের এই চালানটি আফ্রিকার দেশ মালাউই অথবা ইথিওপিয়া থেকে বাংলাদেশে এসেছে। বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল চালানটি পাচার করার জন্য। তিনি বলেন, নোমথেনডাজো তাওয়েরা সোকো নামে এক বিদেশি নারী বিমানবন্দরের নিচতলায় ভিসা অন অ্যারাইভাল ডেস্কে দীর্ঘক্ষণ ধরে অবস্থান করছেন। তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সন্দেহজনক হওয়ায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন লাগেজে অবৈধ মাদকদ্রব্য কোকেন আছে। পরে লাগেজের ভেতরে বিশেষভাবে রক্ষিত আট কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেন জব্দ করা হয়। তিনি বলেন, নোমথেনডাজো তাওয়েরা সোকো প্রথমে মালাউই থেকে ইথিওপিয়া যান। পরে তিনি ইথিওপিয়া থেকে যান দোহা।  দোহা থেকে কাতার এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বাংলাদেশে আসেন। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি তার বাংলাদেশ  থেকে আবারও মালাউইতে যাওয়ার কথা ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে সোকো জানান, ২০২৩ সালে তিনি বাংলাদেশে একবার এসেছিলেন গার্মেন্টস ব্যবসার কথা বলে। এবারও তিনি বাংলাদেশের একটি গার্মেন্টসের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে আসেন। অন অ্যারাইভাল ভিসা নেওয়ার জন্য তিনি নিজের পরিচয় লুকিয়ে গার্মেন্টস ব্যবসার নাম করে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন। সোকো মালাউইতে পেশায় একজন নার্স। তিনি মূলত কোকেনের এ চালানের বহনকারী। আরেক বিদেশি নাগরিকের কাছে এ চালান পৌঁছে দিয়ে তার নিজ দেশে চলে যাওয়ার কথা ছিল।
Published on: 2024-01-25 20:54:22.731879 +0100 CET

------------ Previous News ------------