ইত্তেফাক
সক্রিয় দুই শতাধিক কিশোর গ্যাং, নিয়ন্ত্রণে শতাধিক গডফাদার

সক্রিয় দুই শতাধিক কিশোর গ্যাং, নিয়ন্ত্রণে শতাধিক গডফাদার

*রাজধানীসহ সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে দুই শতাধিক কিশোর গ্যাং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিপথগামী কিশোররা এলাকায় মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, চাঁদাবাজি এমনকি হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। সর্বশেষ গতকাল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ও ভোলার দৌলতখানে কিশোর গ্যাং গ্রুপের হামলায় দুই জন নিহত হয়েছে। এ কিশোর গ্যাং গ্রুপগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে শতাধিক গডফাদার।* পর্দার আড়ালে থেকে রাজনৈতিক পরিচয় বহন করে গডফাদাররা কিশোর গ্যাং দিয়ে এলাকায় মাস্তানি, চাঁদাবাজি ও এলাকা নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটাচ্ছে। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সের এ কিশোরদের অজানা অপরাধে হাতেখড়ি হওয়ার পর এক পর্যায়ে তারা বড় অপরাধ জগতে পা রাখছে। আজকের কিশোর গ্যাং সদস্যই তিন-চার বছর পর অপরাধ রাজ্যে ‘বড় ভাই’ হয়ে যাচ্ছে। বড় ভাই থেকে এক সময়ে নেপথ্যের গডফাদার বনে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, বিপথগামী কিশোররা এলাকায় মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, চাঁদাবাজি এমনকি হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এই কিশোর গ্যাং গ্রুপগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে শতাধিক গডফাদার। এদের মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২১ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নাম রয়েছে। এছাড়া অর্ধশত গডফাদার রয়েছে, যারা থানা ও ওয়ার্ডে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পদধারী। পর্দার আড়ালে থেকে গডফাদাররা এখন কিশোর গ্যাং গ্রুপকে পরিচালনা করছে। গত দুই সপ্তাহে পুলিশ ও র‍্যাবের হাতে কিশোর গ্যাং গ্রুপের অন্তত শতাধিক বড় ভাই গ্রেফতার হয়েছে। গতকাল র‍্যাব-১ উত্তরা ও টঙ্গী এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ৩৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। র‍্যাব-১-এর কমান্ডিং অফিসার (সিও) লে. কর্নেল মোস্তাক আহমেদ বলেন, রাজধানীর মহাখালী, বনানী, বিমানবন্দর, টঙ্গী ও গাজীপুর এলাকায় একাধিক অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাং ০০৭ গ্রুপের দলনেতা আল-আমিন, জাউরা গ্রুপের দলনেতা মাহাবুব, বাবা গ্রুপের দলনেতা সাদ, হাই ভোল্টেজ গ্রুপের মনা, ডি কোম্পানির দলনেতা পাপ্পু ওরফে লন্ডন পাপ্পু ও তার অন্যতম দুই সহযোগী আকাশ এবং আমির হোসেন ও জাহাঙ্গীর গ্রুপের দলনেতা বয়রা জাহাঙ্গীরসহ ৩৭ জন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৫০০ গ্রাম গাঁজা, ২৪টি মোবাইল ফোন, একটি কুড়াল, একটি পাওয়ার ব্যাংক, পাঁচটি রড, ১৬টি চাকু, তিনটি লোহার চেইন, একটি হাতুড়ি, একটি উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করা মোটরসাইকেল, একটি ব্লেড ও নগদ ২৪ হাজার ২৫০ টাকা উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, প্রতিটি গ্রুপের আনুমানিক সদস্য ১০-১৫ জন। তারা টাকার বিনিময়ে মারামারি, দখলবাজি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। র‍্যাব বলছে, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১৭ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক, অস্ত্র, ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। স্থানীয় বিভিন্ন বড় ভাইর হয়ে কাজ করে এসব গ্যাং সদস্যরা। অনেকেই এসব গ্রুপের সদস্যদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সমাজবিজ্ঞানীরা যা বলেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, ঘটনা ঘটলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সবকিছু ছেড়ে দেই—এটা ঠিক নয়। কারণ এটা কিশোরদের জীবন ব্যবস্থাকেন্দ্রিক এক ধরনের অপরাধ। সেক্ষেত্রে পরিবারগুলোকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। অভিযানে শুধু কিশোর অপরাধীদের গ্রেফতার করলেই হবে না, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক বা গডফাদারদেরও গ্রেফতার করা প্রয়োজন। যারা সমস্যার সমাধান করবেন তাদের মধ্য থেকে কেউ যদি সমস্যা সৃষ্টির অংশ হয়ে যান তখন সেই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সংশোধনের সুযোগ রেখে আইন প্রয়োগ, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধকরণ,  সামাজিক অনুশাসনের পরিধি বৃদ্ধি  এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে বাড়াতে হবে। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরজাহান খাতুন বলেন, কিশোরদের মধ্যে ‘অ্যাডভেঞ্চার ফিলিং’ বা ‘হিরোইজম’ ভাব দেখা যায়।  তারা এ বয়সে এমন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে বা ফলো করে, সেখান থেকেই তারা অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। কিশোরদের গ্যাং কালচার থেকে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, অভিভাবক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। *১৫ বছরে ৮৫ খুন:* ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৫ সালের ২৭ মে উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে কিশোর গ্যাং গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র অনিককে (১৫)। ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন হয় ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। আদনান খুন হওয়ার পর উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশত কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১৯ সালের ২৯ জুন হাজারীবাগ এলাকায় ১৫ বছর বয়সি ইয়াছিন আরাফাত ও ঐ বছরের ৭ জুলাই গেন্ডারিয়া হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র শাওন খুন হয়। ঐ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানে কিশোর গ্যাং গ্রুপের দ্বন্দ্বে মহসিন নামে এক কিশোর খুন হয়। ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে শাহাদাত হোসেন হাসিবকে ধারালো ছুরি দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করে হূদয় ও তার সহযোগীরা। এ হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে কিশোর গ্যাংয়ের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। র‍্যাবের পক্ষ থেকে রাজধানীতে সক্রিয় এলাকাভিত্তিক ৮০টি কিশোর গ্যাংয়ের সুনির্দিষ্ট তালিকা করা হয়েছে। এই ৮০টি গ্যাংয়ের ৮০ জন গডফাদার রয়েছে। আবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশনের ২১ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ শতাধিক  কিশোর গ্যাং গডফাদারের নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ডিআইজি হারুন আর রশিদ বলেন, কিশোর গ্যাং গ্রুপের বড় ভাইদের গ্রেফতার করা হবে। নেপথ্যের গডফাদারদের তালিকা করা হয়েছে। এদের রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক—অপরাধের ক্ষেত্রের অপরাধীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পুলিশের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। অপরাধী যেই হোক, তাকে গ্রেফতার করা হবে। র‍্যাব মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন বলেন, কিশোর গ্যাং গ্রুপের বিষয়ে র‍্যাব অলআউট গেম খেলা হবে। র‍্যাব সারা দেশে কিশোর গ্যাং গ্রুপের বড় ভাই ও গডফাদার গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছে। এদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে।
Published on: 2024-02-24 02:17:25.6959 +0100 CET

------------ Previous News ------------