ইত্তেফাক
ব্যবসায়ীদের হাতে কুক্ষিগত মিডিয়া ব্যবহার হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থে

ব্যবসায়ীদের হাতে কুক্ষিগত মিডিয়া ব্যবহার হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থে

*হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ বলেছেন, মিডিয়া বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের হাতে কুক্ষিগত। ব্যবসায়ীরা মিডিয়ার মালিক। ব্যবসায়ীদের আবার পলিটিক্যাল অ্যাফিলিয়েশন (রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা) আছে।* সোমবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ও আদালত সাংবাদিকতা’ শীর্ষক কর্মশালায় বিচারপতি হাসান আরিফ এ মন্তব্য করেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দক্ষিণ হলে এই কর্মশালার আয়োজন করে আইন ও সংবিধান বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ)। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ  বলেন, ব্যবসায়ীদের আবার নিজস্ব ধন-সম্পদ বা ব্যবসা বাণিজ্যের স্বার্থ আছে। এখন বিভিন্ন ব্যবসায়িক গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এসব গ্রুপের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে, তাদের ছেলে-মেয়েদের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে রিপোর্টিং করা আপনাদের অনেক সাংবাদিকের পক্ষে খুবই ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে। আবার মিডিয়াকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা শপথ নিয়ে এজলাসে বসেছি। শপথ নিয়ে না বসলেও আপনাদের স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর কমিটমেন্ট রয়েছে। কিন্তু স্বাধীন সাংবাদিকতা কতটুকু করতে পারছেন সেটা নিজেকে প্রশ্ন করে দেখেন। আপনি কি পারবেন আপনার টিভি চ্যানেলের মালিকের কোন একটা অনিয়মের রিপোর্ট করতে? পারবেন না। *মনে হচ্ছে একটি আসনেই নির্বাচন হয়েছে* বিচারপতি হাসান আরিফ বলেন, এবারের সংসদ নির্বাচনে দেখতে পেলাম কোনো একটি আসনের নির্বাচনে পুরো টিভি চ্যানেলটাই ওখানে গিয়ে বসে আছে। যেন বাংলাদেশের নির্বাচনটা ওই একটা আসনেই হচ্ছে। আর কোথাও হচ্ছে না। মিডিয়াকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। আপনারা যখন বলবেন আদালতকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে পাল্টা উত্তর এটাও তো আসে মিডিয়াকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন আদালতকে যদি রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয় তাহলে তো আমি বলব একটা বিরাট জনগোষ্ঠী এর সুবিধা পায়। কারণ, ওই রাজনৈতিক দলটার একটা বড় অংশ অনুসারী রয়েছে। কিন্তু একটি টিভি চ্যানেল যখন একটা ব্যবসায়িক গ্রুপের পক্ষে লিখে তার বেনিফিশিযারি মাত্র একটি পরিবার অথবা তার কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আর কেউ এটার বেনিফিশিয়ারি হচ্ছে না। যদি দুই খারাপের মধ্যে তুলনা করি তাহলে কোনটা ভালো? এই তুলনা করলে আদালতকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার তো মন্দের ভালো। মন্দের ভালো এজন্য যে ওখানে অনেকগুলো মানুষ বেনিফিটেড হয়। আমি বলছি না এটা করা ভালো। *মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে ডিসইনফরমেশনের কাজে* বিচারপতি বলেন, এখন সারা বিশ্বে সাংবাদিক ও টিভি চ্যানেলগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে ডিসইনফরমেশনের কাজে। এই জায়গাটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে আমি জানি না। খোদ আমেরিকার মত রাষ্ট্রে এটা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফক্স নিউজ এবং সিএনএন নিউজ চ্যানেল অনুসরণ করলেই এটা বুঝতে পারবেন। এত উন্নত দেশেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে আমাদের দেশের সাংবাকিতা কবে উন্নত হবে তা কেউ জানে না। তবে এর একটাই সমাধান জনগণকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা। তখন জনগণ নিউজটা পড়েই বুঝবে কোনটা ইনফরমেশন এবং কোনটা ডিসইনফরমেশন। সে অবস্থা কখন আসবে আমরা জানি না। একদিন হয়ত আসবে তখন হয়ত ডিসইনফরমেশন কালচার আমাদের এফেক্ট করতে পারবে না। *আদালত রিপোর্টারদের বাদ দিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে কল্পনা করা যায় না* বিচারপতি হাসান আরিফ বলেন, মামলার শুনানিকালে কোন বিচারকের সুইপিং কমেন্টস (হালকা মন্তব্য) প্রচার হয় তখন হয়ত পার্টিকুলার পত্রিকা বা টিভির টিআরপি বাড়ে। কিন্তু সত্যিকারে বিচার বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল। এই বিষয়টির দিকে আমাদের সতর্কভাবে খেয়াল থাকা উচিত। তিনি বলেন, আপনারা যখন একজন বিচারকের সুইপিং কমেন্ট প্রচার বা প্রকাশ করেন তখন তার জন্য আমরা বিচারকরা মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও কোন অ্যাকশনে যাই না। কারণ আমাদের মধ্যে একধরনের ফ্রেন্ডলি রিলেশনশিপ গড়ে উঠেছে। এটা ডেভেলপ করার কারণ হলো এখন আইনজীবীদের মত সাংবাদিকদেরও আমরা পার্ট অব দ্যা বার এন্ড বেঞ্চ মনে করি। সাংবাদিকদেরও একটা নির্দিষ্ট জায়গা দেওয়া হয়েছে বারের মত করে বসার জন্য। আদালতের রিপোর্টারদের বাদ দিয়ে এখন সুপ্রিম কোর্ট কল্পনা করা যায় না। একটা সময় বারকে বাদ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কল্পনা করা যেত না। একটা কথা ছিলো বার ও বেঞ্চ মিলেই সুপ্রিম কোর্ট। এখন কথাটা সেরকম নাই, বার, বেঞ্চ এবং জার্নালিষ্ট মিলেই এখন সুপ্রিম কোর্ট। অর্থাৎ প্রেসকে বাদ দিয়ে এখন আর সুপ্রিম কোর্টকে কল্পনা করা যায় না। একটা সময় হয়ত যেত। কিন্তু এখন আর নয়। একটা সময় রেস্ট্রিকশন ছিলো কোন কোন সাংবাদিক ঢুকবে, কোন কোন সাংবাদিক ঢুকবে না। সাংবাদিকরা থার্ড আই অব দ্যা স্টেট। আদালতের কার্যক্রম সাংবাদিকরা দেখা মানেই জনগণ দেখা। *লাইভ স্ট্রিমিংয়ে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে* বিচারপতি হাসান আরিফ বলেন, বোম্বে ও মাদ্রাজ হাইকোর্টে লাইভ স্ট্রিমিং চালু হয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে তো আরও আগে চালু হয়েছে। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট লাইভ স্ট্রিমিংয়ে যাবে কি যাবে না সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। লাইভ স্ট্রিমিংয়ে গেলে আমাদের বিচার বিভাগের লাভ না ক্ষতি হবে সেটা নিয়েও বিবেচনার বিষয় রয়েছে। আপনাদের অনুরোধ করব আপনারা বিচারকদের সুইপিং কমেন্টস প্রচার বা প্রকাশ করবেন না। এ ধরনের কমেন্ট বা রিমার্ক প্রচার বা প্রকাশ করলে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। আমাদের বিচার বিভাগের মূল ভিত্তিই হলো ভাবমূর্তি। আমরা টিকে আছি ভাবমূর্তির উপর। আমি আশা করি আপনারা এ বিষয়টি খেয়াল রাখবেন। *রাষ্ট্রের অন্যায় কাজকে থামানোই হলো রিট বেঞ্চের দায়িত্ব* বিচারপতি হাসান আরিফ বলেন, আমরা যেসব বিচারক রিট বেঞ্চে আছি তাদের কাজটি কি? রাষ্ট্র একটা অন্যায় কাজ করছে আপনি রাষ্ট্রকে থামাবেন এটাই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের মোদ্দাকথা। নাগরিক বা কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর রাষ্ট্র যাতে কোন অবিচার করতে না পারে সেটা ঠেকানোর কাজ হলো রিট বেঞ্চের দায়িত্ব। কন্সটিটিউশনাল কোর্ট শব্দটা ব্যবহার করি, সেই কোর্টটা হলো হাইকোর্টের এই রিট বেঞ্চ। এই রিট বেঞ্চের কাজই হলো সরকারের বিরুদ্ধে অর্থাৎ আপনি কোন অন্যায় করছেন কিনা আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। সেজন্য এই বেঞ্চের যারা বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন তাদের চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের কাজকে বা সিদ্ধান্তকে ক্রিটিক্যালি পরীক্ষা করে দেখা। এইসব কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় বিচারকের ক্যারিয়ার এবং ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়, যদি না তার চাকরির নিরাপত্তাটা থাকে যেটা ভারত ও পাকিস্তানে রয়েছে। এই নিরাপত্তাটা যদি না থাকে তাহলে দেখবেন আমাদের সাংবিধানিক আদালত/উচ্চ আদালতের বিচারকদের কাজ করাটা অনেক ডিফিক্যাল্ট হয়ে যায়। এটার প্রমাণ আপনারা দেখেছেন। বাস্তবতাটা হলো আমাদের চোখ খোলা বলেই আমাদের রায় ও আদেশগুলোতে চোখ খোলার প্রতিফলনটা আপনারা দেখতে পান। চোখ খোলার প্রতিফলনটা যখন দেখতে পান তখন আপনাদের উচিত যে বিচারক রায়টা দিয়েছেন সেই বিচারক রায়টি চোখ খুলে দিয়েছেন, বন্ধ করে দেননি একথাটা বলা। *আইনে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা দরকার* বিচারপতি হাসান আরিফ বলেন, সাইবার আইনের আটটি ধারায় অপরাধকে সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এসব ধারা সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সমালোচকরা বলে থাকেন এসব ধারা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যার কারণে সংজ্ঞাগুলো অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। আবার সংজ্ঞায়িত করাটাও মুশকিলের কাজ। কোন সংজ্ঞাই পারফেক্ট সংজ্ঞা নয়। আজকে যে সংজ্ঞাটাকে পারফেক্ট মনে হচ্ছে ৫/১০ বছর পর সেই সংজ্ঞাটাকে হাস্যকর মনে হতে পারে। এ কারণে সংজ্ঞা দেওয়াটা একটা কষ্টসাধ্য কাজ। তবে সংজ্ঞাটা দেওয়া থাকলে সাংবাদিকরা বুঝতে পারলেন যে আমার প্রতিবন্ধকতাটা কোথায়। আমাকে কোথায় থামতে হবে। কর্মশালায় আপিল বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বক্তব্য রাখেন। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি শামীমা আক্তার। সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান।
Published on: 2024-02-26 16:36:58.343701 +0100 CET

------------ Previous News ------------