ইত্তেফাক
শাস্তি না হওয়ায় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে প্রতারণা

শাস্তি না হওয়ায় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে প্রতারণা

শাস্তি না হওয়ায় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে প্রতারণা। অজস্র প্রতারণার মামলা হয়। কিন্তু কারোর সাজা হয় না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ৯৫ ভাগ প্রতারণা মামলার সাজা হয় না। বাদি আদালতে যেতে যেতে হয়রান হয়ে যান। প্রতারকদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্যদের যোগসাজশ রয়েছে। তারা প্রতি মাসে মাসোয়ারা পেয়ে থাকেন। এ কারণে প্রতারণার মামলার তদন্ত রিপোর্ট পাল্টে যায়। মামলা হলো খেজুর গাছ। দুই পক্ষ থেকে টাকা পাওয়া যায়। বেশিরভাগ মামলা কখনো আলোর মুখ দেখে না।  এভাবে নানা প্রক্রিয়ায় আসামিরা বের হয়ে যায়। এতে প্রতারকরা দোর্দণ্ড প্রতাপে কাজ করে যাচ্ছে। আর প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া কোটি কোটি টাকা তারা বিদেশে পা চা র করছে। এমপি থেকে আমলা অনেকেই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতারণা ভয়ংকর এক সামাজিক অপরাধ। অনেক ক্ষেত্রে বিষয়টি খুব সহজভাবে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রতারণার শিকার হওয়ার ভুক্তভোগী মানুষগুলো বা তাদের পরিবারকে এর জন্য অনেক সময় ভয়াবহ মাশুল গুনতে হয়। সহায়-সম্বল হারানো ছাড়াও কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। প্রতারকদের শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবার। রাজধানীসহ দেশব্যাপী পাড়া-মহল্লায় অহরহ ঘটছে প্রতারণার ঘটনা। মানুষভাবে প্রতারণার বি চা র হয় না। মামলা করলে তিনগুণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়, নিঃস্ব হয়ে যেতে হয়। এ কারণে অনেকে প্রতারণার মামলা করা থেকে বিরত থাকছেন।  বর্তমানে বড় ধরনের আর্থিক প্রতারণার ঘটনা ব্যাপক বেড়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন দিয়েও শত শত কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হচ্ছে। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, বুমবুম, কিউকম, ধামাকাসহ এমন বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের পণ্য প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের খবর ইতিমধ্যে প্রায় সবারই জানা। তবে বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে, প্রতারণা নেই এমন কোনো খাত বা ক্ষেত্রই যেন খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রতারণার ধরনেও এখন কোনো শেষ নেই। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিনিয়তই প্রতারকদের তৎপরতা ও নিত্যনতুন কৌশল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার পাশাপাশি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সকলে সঠিক ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করলে প্রতারণা কমে যাবে। কিন্তু দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করায় মামলার মেরুকরণ পরিবর্তন হয়ে যায়। চা ঁদপুর আওয়ামী লীগের এক নেতা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ওই নেতা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র এমপি পদে নির্বাচন করেছিলেন। তিনি পড়েছিলেন প্রতারক ফরহাদ হোসেন জনির কবলে। জনি সোনারগাঁও উপজেলার পাকুন্দা গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা ফারুক মোল্লা প্রতারণার শুরু হিসেবে পরিচিত। প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হাসান। বর্তমানে বসুন্ধরায় নিজের বিলাসবহুল এপার্টমেন্টে থাকেন। এএনএস এন্ট্রিকুইজ সংগঠন তৈরি করেছেন। হেরিটেজ একশন কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে এন্ট্রিক সামগ্রী সংগ্রহ করছে বলে প্রতারণার জালে ফেলেন চা ঁদপুরের আওয়ামী লীগ নেতাকে। বলেন, বৃটিশ সীমানা পিলার, প্রাচীন কয়েন ইত্যাদি তারা ক্রয় করে থাকে। এই কয়েনের নামে নানাভাবে প্রতারণা করে সে। জনি গ্রুপটি এন্ট্রিক কেনার জন্য প্রস্তাব দেয়, যেটা মূল্যবান পদার্থ। বিদেশে শত কোটি টাকায় বিক্রি করা যাবে বলেন। এটা অর্জিনাল কিনা নেতা সেটা পরীক্ষা করে নেন। কিন্তু যারা পরীক্ষা করেছে, তারাও জনি গ্রুপের লোক। পরীক্ষা করে বলে দিয়েছ আসল জিনিস। ৯ কোটি টাকা দিয়ে ক্রয় করেন। পুরোটাই ছিল একটা প্রতারণা। এই ব্যাপারে রমনা মডেল থানায় মামলা হয়েছে। মামলা নং ০৪, /০৩/১২/২০২৩। মোট আসামি ১৫ জন। তবে তাদের রয়েছে বিরাট গ্রুপ। ডিবি পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করেছে। ফরাদ হোসেন জনি হলো এই গ্রুপের গুরু। তার বাবা দুটি বিবাহ করেন। প্রথম মায়ের নাম নিলুফা বেগম, দ্বিতীয় মায়ের নাম রিনা বেগম। দুটি ন্যাশনাল আইডি কার্ড জনি ব্যবহার করেন। এভাবে সে প্রতারণা করেও পার পেয়ে আসছেন। এর আগে দুই জন এমপির থেকে এইভাবে প্রতারণা করে ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এভাবে টাকা নিয়ে শত শত কোটি টাকা তারা বিদেশে পা চা র করছে। এই গ্রুপের সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি গ্রুপ জড়িত। তারাও টাকার ভাগ পায়। অনেক নারীকে টার্গেট করেও প্রতারণা করা হয়। বিয়েশাদি প্রলোভন দেখানো হয়। ফেসবুকের মাধ্যম সাইদ হাসানের সঙ্গে পরিচয় হয় এক তরুণীর। হাসান তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে। বিবাহ করে বিদেশে নিয়ে যাবে, ব্যবসা দিবে। এভাবে কোটি কোটি টাকা প্রতারণা করেছে। এমন একটি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম। ওই তরুণী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চা করি করতেন। সাইদ হাসান তাকে বলে, আমি নিউইয়র্কের একটি বিমানের ফ্লাইটে কাজ করি। বিবাহ করে নিয়ে যাবে। পাসপোর্ট ভিসা প্রসেস করতে হবে। টাকা লাগবে। আমি এসে সব টাকা দিয়ে দিবো। পাইলটের চা করি করে বলে একটা ছবিও দেখায়। আসলে সে পাইলট সাইন হাসান নয়, নড়াইলের প্রতারক বেনজীর হোসেন। আসল পাইলট সাইদ হাসানের বাড়ি খুলনায়। প্রতারক বেনজীর পাইলটের গ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করে প্রতারণা করে আসছে। এর আগে ২০ জন নারীর সঙ্গে একইভাবে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা যায়। এক কোটি ১০ লাখ টাকা নিয়েছে ওই তরুণীর থেকে। এই ব্যাপারে মামলা হয়েছে ঢাকার ওয়ারী থানায়। মামলা নং ১৩, ২১/১১/২০২৩। পরে তদন্তভার নেয় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। প্রতারক বেনজীরের একজন আত্মীয় আছেন সিআইডির কর্মকর্তা, তিনি ফরিদপুরে বর্তমানে রয়েছেন। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, তিনি একজন ইনন্সপেক্টর। নেপথ্যে সেই প্রতারণার সাথে জড়িত বেনজীরের সঙ্গে। এ কারণে প্রতিটি প্রতারণার মামলার তদন্ত অন্য দিকে মোড় ঘুরিয়ে ফেলে। এতে মামলার দাবিরা ন্যায়বি চা র থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কয়েকজন আইনজীবী বলেন, প্রতারণাবিরোধী আইনের (৪২০ ধারা) তুলনামূলক স্বল্প সাজা এবং জামিনযোগ্য। তারা সহজে বের হয়ে আসে। আবার তারা প্রতারণার কার্যক্রম শুরু করে দেয়। প্রতারণার শিকার  ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, মামলা করলেও প্রতারকরা জামাই আদরে থাকেন। আর যারা মামলা করেন, তারা নিঃস্ব হয়ে যান। আবার জামিনে বের হয়ে হত্যার হুমকি দেয়। এতে মামলার বাদি নিরুত্সাহিত হয়। আবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর কর্মকর্তা বাদিকে বলে দেন যে, যা পান তাই নেন, মামলা করে কোন লাভ হবে না। ক্ষতিগ্রস্তরা আরও বলেন, প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা নিঃস্ব হয়ে যান। এটা যেন আর না বাড়ে, সেজন্য প্রতারকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি বিধান চা লু করার দাবি জানান। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, প্রতারণার শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের অবশ্যই মামলা করতে হবে। যাতে অপরাধীর সাজা হয়। অনেকে মামলা করলেও তা শেষ পর্যন্ত না চা লিয়ে উঠিয়ে নেন, এতে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। অপরাধীদের একের পর এক সাজা হলে দেশে প্রতারণা কমে আসবে। তিনি বলেন, অবশ্যই আমরা প্রতি মাসে ক্রাইম কনফারেন্স করি পুলিশ সদর দপ্তরে। কঠোরভাবে মনিটরিং করছি। যাতে বাদি বিরুত্সাহি না হয় সে জন্য মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। বাদিকে এই ব্যাপারে সহযোগিতা করতে হবে। মামলায় সাজা নিশ্চিত হতে অন্যান্যদেরও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে, তাহলে প্রতারণা কমে আসবে। র‍্যাবের মহাপরি চা লক এম খুরশীদ হোসেন বলেন, প্রতারকদের শাস্তি নিশ্চিত করা এক পক্ষের পক্ষে সম্ভব না। সকল পক্ষের সহযোগিতা প্রয়োজন। তাদের ব্যাপারে কঠোর থেকে কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে হবে, তাহলে দেশে প্রতারণার ঘটনা কমে আসবে। বেড়া যদি ক্ষেত খায়, তাহলে মামলা দিয়ে লাভ কি? বেড়া যাতে ক্ষেত না খায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ডিবি প্রধান হারুন-উর-রশীদ বলেন, অনেক প্রতারককে ধরছি। আমাদের পক্ষ থেকে যা যা করার তার সবাই করছি।
Published on: 2024-03-23 22:08:40.963991 +0100 CET

------------ Previous News ------------