দৈনিক জনকণ্ঠ
স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা

স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা

দেড় দশকে দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো বদলে গেছে। তবে দেশের অনেক সরকারি বিদ্যালয় রয়েছে যেখানে সুপেয় পানি ও ভালো শৌচাগারের অভাব রয়েছে। মফস্বল এলাকার স্কুলগুলোতে পানির সংকট তীব্র না হলেও শৌচাগারের বেহাল দশা। ঢাকা মহানগরীর স্কুলগুলোতে দুটো সমস্যাই প্রকট। শিক্ষার্থী অনুপাতে শৌচাগারের সংখ্যা কম ও নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। ফলে স্কুল চলাকালে শিক্ষার্থীদের শৌচাগার ব্যবহারে অনীহা বাড়ছে। সুপেয় পানির সংকট থাকায় পর্যাপ্ত পানি পান করছে না ছাত্রছাত্রীরা। এতে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে রাজধানীর স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। সরেজমিন একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতা মিলেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তারা জনকণ্ঠকে এই সমস্যার কথা জানিয়েছেন। তবে মাউশি পরিচালক (বিদ্যালয়) বেলাল হোসাইন স্কুলগুলোতে এই সমস্যা রয়েছে তা মানতে নারাজ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, কোনো স্কুলে বিশেষ করে, সরকারি স্কুলে এমন সমস্যা থাকলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানালেই আমরা ঠিক করে দিতে পারি। বিদ্যালয়েরও আলাদা তহবিল আছে। তিনি অভিযোগ করেন, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তো আমাদের অভিযোগ দেয় না। তবে রাজধানীর ১০টি সরকারি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠানপ্রধান এসব অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের শহীদ মনু মিঞা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে মাত্র সাতটি কক্ষ রয়েছে। এই কক্ষগুলোতে প্রথম থেকে ১০ম শ্রেণির ক্লাস চলে। শিক্ষার্থী সংখ্যা সাড়ে চারশ’। স্কুলটিতে ছেলে ও মেয়ে একসঙ্গে পড়াশোনা করে। দীর্ঘদিন মাত্র দুটি টয়লেট ছিল। ছিল না কোনো পার্টিশন। যে কারণে গোপনীয়তাও রক্ষা করা যেত না। সম্প্রতি সেই টয়লেটে বোর্ড লাগিয়ে ছেলেদের ও মেয়েদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এখনো শিক্ষকদের জন্যও পৃথক টয়লেট বা শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। সুপেয় পানির জন্য দুটো ফিল্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে তা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। কারণ জনবলের অভাব। স্কুলের প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানা জনকণ্ঠকে বলেন, আমার স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থী গরিব পরিবারের। এ কারণে জীর্ণ ভবনেও তারা পড়তে আসে। এ বছর গুলশান-বনানীর অনেক শিক্ষার্থী লটারিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু স্কুলের গেট আর টয়লেটের অবস্থা দেখে মন খারাপ করে চলে গেছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর হাত দিয়ে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা  হয়েছিল স্কুলটি। এর পর ২০১৩ সালে সরকারিকরণ হয়। ২০১৮ সাল থেকে পুরোদমে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। এর পরও এখনো প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিলে বসে বাচ্চাদের পড়তে হচ্ছে। পুরান ঢাকায় অবস্থিত ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। সরকারি এই স্কুলে ২৪০০ শিক্ষার্থী আছে। এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য শৌচাগার রয়েছে মাত্র ১৫টি। অর্থাৎ প্রতি ১৬০ জন শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একটি করে টয়লেট। অনেক সময় সেগুলোও অকেজো থাকে। সম্প্রতি বিশুদ্ধ পানির জন্য স্কুলটিতে ফিল্টার বসানো হয়েছে। কিন্তু অভিভাবকদের এই পানি নিরাপদ না মনে হওয়ায় বাচ্চারা বাসা থেকেই পানি নিয়ে আসে। স্কুল কর্তৃপক্ষ সুপেয় পানির জন্য ওয়াসা থেকে এটিএম মেশিন বসানোর পরিকল্পনা করছে। রাজধানীর গভর্নমেন্ট হাই স্কুলেও তিন হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শ’খানেক টয়লেট আছে বলে প্রতিষ্ঠানপ্রধান দাবি করেন। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ও লোকবল সংকটে এর অনেকগুলোই বেহাল। প্রধান শিক্ষক আলমগীর হোসেন তালুকদার জনকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষার্থীরা টয়লেট নষ্ট করে এবং ফ্লাশ ও দরজা ভেঙে ফেলে। এসব কারণে রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। গত ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে রাজধানীর সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রধান শিক্ষকরা স্কুলের বিভিন্ন সমস্যার চিত্র বিভাগীয় কমিশনারের কাছে পেশ করেন। এর মধ্যে সুপেয় পানির অভাব এবং স্যানিটেশন সমস্যা ছিল অন্যতম। এসব বিদ্যালয়ের আরও কিছু সমস্যা আলোচনায় স্থান পায়। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার বিশেষ তহবিল থেকে সমস্যা সমাধানের আশ^াসও দিয়েছেন। এর মধ্যে নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, স্কুল ভবনের পাশের ১৬ তলা ভবন থেকে নিয়মিত আবর্জনা স্কুল আঙিনায় ফেলা হয়। এতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিক্ষার্থীদের চলাফেরা করতে হচ্ছে। বিঘœ ঘটছে স্বাভাবিক পাঠদান। হাজারীবাগের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, স্কুলের সামনে স্পিড ব্রেকার করা প্রয়োজন। এখানে প্রায়ই শিক্ষার্থীরা দুর্ঘটনায় পড়ছে। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে স্যানিটেশন ও সুপেয় পানির অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার অনুদান দেবেন বলেও জানা গেছে। সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুরনো ভবনের স্কুলগুলোতে এসব সমস্যা প্রকট। নতুন ভবনের স্কুলগুলো আধুনিক করে করা হয়েছে। তবে এর পরও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির লোকবল অভাবে ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। এর ফলে সমস্যা দেখা দিয়েছে। সারাদেশে সরকারি মাধ্যমিকের সংখ্যা ৩৫১টি। আত্তীকৃত মিলিয়ে এই সংখ্যা সাড়ে ৬শ’র বেশি। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে ৩৫টি বিদ্যালয় আছে। মাউশি ঢাকা অঞ্চলের কর্মকর্তারা জানান, সমস্যাটি নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানে সমস্যা রয়েছে তা সমাধান করা হবে। তবে মাউশির বিশেষ শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদেশী সংস্থার অর্থায়নে সম্প্রতি রাজধানীর ২২টি বেসরকারি স্কুলে এ সংক্রান্ত একটি ছোট্ট প্রকল্প চালু রয়েছে। প্রকল্পটি প্রায় শেষের পথে। সরকারি কোন স্কুলে স্যানিটেশন বা নিরাপদ পানি সংক্রান্ত বিশেষ কোন উদ্যোগ নেই। কিন্তু দেশে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এ বিষয়ে অবশ্যই পলিসি লেভেলে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্কুলের টয়লেট নোংরা হওয়ার কারণে বাচ্চারা টয়লেট ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে না। বাসায় ভালো টয়লেট ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়ায় এসব টয়লেটে  যেতে অনীহা রয়েছে তাদের। অন্যদিকে স্কুলের পানিতে অভিভাবকদের আস্থা নেই। ফলে অধিকাংশ শিশু বাসার পানি বোতলে করে নিয়ে আসে। কিন্তু পানি ফুরিয়ে গেলে এসব শিক্ষার্থীরা স্কুলের পানি পান করতে চায় না। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে বিশেষ নজর দেওয়ার অনুরোধও জানিয়েছেন তারা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বেনজির আহমেদের মতে, সুপেয় পানি ও নিয়মিত টয়লেট ব্যবহার না করার কারণে শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর ফলে কিডনি রোগসহ নানা ধরনের সংক্রামক রোগের আশঙ্কা প্রবল। এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, সময়মত টয়লেট ব্যাবহার স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। এজন্য প্রতিটি স্কুলেই ওয়াশ ব্লক থাকা বাধ্যতামূলক। জাপানের স্কুলে শৌচাগারগুলো ঝকঝকে। কারণ সেখানে নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের স্কুলে ক্লিনারের সংকট থাকায় তা নষ্ট হয়ে থাকে। শিক্ষার্থী স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে অবশ্যই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এজন্য নতুন নীতিও গ্রহণ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থী সচেতনতাও প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, ছাত্রীদের জন্য স্যনিটারি প্যাড রাখা ও তা ফেলে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর সৈয়দ গোলাম ফারুক জনকণ্ঠকে বলেন, মনিটরিং ও লোকবল অভাব এই সমস্যার অন্যতম কারণ। কিন্তু সহজ সমাধানও রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন যে মূল্যায়ন রয়েছে, স্কুল পরিচ্ছন্নতা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তা হলে  দেখা যাবে, বাচ্চারাই রুটিন অনুযায়ী শৌচাগার ব্যবহার ও পরিস্কার রাখবে। জাপানের স্কুলগুলোতে এর প্র্যাকটিস করা হয়। এই ব্যবস্থা নেওয়া গেলে বাচ্চাদের মধ্যে টেকসই সচেতনতা তৈরি করা সম্ভব হবে। ডিজি হিসেবে যখন বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শন করতাম তখন আগে থেকেই সব পরিষ্কার করে রাখা হতো। কিন্তু বাস্তব ঘটনা যে কী, সেটা আমিও জানি।
Published on: 2023-10-11 19:52:38.597669 +0200 CEST