দৈনিক জনকণ্ঠ
রাজনীতিতে উত্তেজনা

রাজনীতিতে উত্তেজনা

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে পরস্পরবিরোধী অনড় অবস্থানে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুসারে দলীয় সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। বিএনপি বলছে, নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। এ পরিস্থিতিতে দুই দলের সমঝোতার জন্য বিদেশীরা সংলাপের প্রস্তাব দিলেও শর্তের বেড়াজালে আটকে গেছে সংলাপ। এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীতে আজ বুধবার বিকেলে এক কিলোমিটার দূরত্বে দুই বড় দলের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ একদফা দাবি আদায়ে নয়াপল্টনের সমাবেশ থেকে সরকারকে আলটিমেটাম দেবে বিএনপি। আর বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার ঘোষণা দেবে আওয়ামী লীগ। দুই দলের এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে চারদিকে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। সমাবেশকে কেন্দ্র করে দুই দলই আজ রাজধানীতে পল্টাপাল্টি শোডাউন করে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের মহড়া দেবে। এ জন্য দুই দলের পক্ষ থেকেই সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে সমাবেশে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। নির্বাচনের আগে রাজপথ দখলে রাখার চেষ্টার অংশ হিসেই দুই দল এ কৌশল নিয়েছে। আজ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি। এ কারণেই দেশের রাজনীতিতে উত্তাপ বিরাজ করছে। এ ছাড়া জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে, আগামী দিনগুলোতে কি হবে! বিএনপি ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, পূজার পর তারা চূড়ান্ত আন্দোলনে যাবে। আর আওয়ামী লীগও বলেছে, বিএনপি রাজপথে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলেও তাদের রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করা হবে। এ জন্য দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে মাঠে সক্রিয় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতে অনেকের মনেই প্রশ্ন, কি হতে যাচ্ছে পূজার পর? বিএনপি সূত্র জানায়, সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ একদফা দাবি আদায়ে আজ বুধবারের সমাবেশ থেকে সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়া হবে। পূজার পর শুরু হবে চূড়ান্ত আন্দোলন। ওই আন্দোলনের মধ্যে ঢাকা অবরোধসহ বিভিন্ন কঠোর কর্মসূচি থাকবে। অপরদিকে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগ আজ বুধবার সমাবেশ করে  বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি মোকাবিলার ঘোষণা দেবে। এ জন্য দলের নেতাকর্মীদের মাঠে সক্রিয় থাকার আহ্বান জানানো হবে। বিএনপি আজকের সমাবেশ সফল করতে ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি থানা, ওয়ার্ড, পাড়া-মহল্লা থেকে দলের নেতাকর্মীদের নয়াপল্টনে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগও বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উপস্থিত থাকার পাশাপাশি পাড়া-মহল্লাসহ সর্বত্র সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। সূত্র জানায়, বিএনপি দলের সর্বোচ্চ ফোরাম ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আন্দোলনের কৌশল চূড়ান্ত করেছে। এরই অংশ হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একদফা দাবি আদায়ে সরকারকে চাপে ফেলতে রাজধানীতে আন্দোলন কর্মসূচি জোরদারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ সমাবেশ শেষে সরকারকে আলটিমেটাম ও নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি। আর পূজার পর একটি মহাসমাবেশ করে চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচিও ঘোষণা করবে। এতে সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে জড়ো করে রাজধানীতে বড় ধরনের শোডাউন করে রাজপথ দখলে নেওয়ার চেষ্টা করবে দলটি। তবে মাঠ ছাড়বে না আওয়ামী লীগও। তাই পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে রাজপথ দখলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আজ বিএনপির সমাবেশের বিপরীতে আওয়ামী লীগের সমাবেশেও বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ঘটানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র আড়াই মাস বাকি। তাই দাবি আদায়ের বিষয়ে সরকারকে আর সময় দিতে চাচ্ছে না বিএনপি। সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ একদফা দাবি আদায়ে আগেই সারাদেশের সকল মহানগর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ধারাবাহিক সভা-সমাবেশ ও রোডমার্চসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। আর আওয়ামী লীগও দেশব্যাপী দলের সর্বস্তরে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করেছে। তবে বিএনপি এবার ঢাকায় আন্দোলন কর্মসূচি জোরদার করার কৌশল নিয়েছে। আওয়ামী লীগও সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মাঠে সতর্ক রেখেছে। সংবিধান অনুসারে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হলেও এ নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়, সে বিষয়ে বারবার সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের অন্য মন্ত্রীরাও তাই বলছেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও তা বলা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনও বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা করার তারা সবই করবে। এ ছাড়া দেশে এ পর্যন্ত যত বিদেশী প্রতিনিধিদল এসেছে, তাদের সঙ্গে বৈঠককালেও নির্বাচন কমিশন, সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। আর সংবিধানে নির্বাচনের বিষয়টি স্পষ্ট উল্লেখ থাকায় বিদেশীরাও এর বাইরে কোনো কথা বলেনি। তবে তারা বারবারই বলেছে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা। তবে বিএনপি চায়, দলীয় সরকারের পরিবর্তে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। এই দাবিতে তারা রাজপথে আন্দোলন জোরদারের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের কাছে দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রেখেছে। দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক শক্তি জোরদার করার কৌশল নিয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী গত বছর জুলাই মাস থেকে ধীরে ধীরে সক্রিয় হতে থাকে। আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপির ২২ জন মারা গেছেন বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আর মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন আরও অনেকে। তারপরও আগের চেয়ে কিছুটা সাহসী হয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এ কারণে এখন দলটির যে কোনো কর্মসূচিতে আগের চেয়ে বেশিসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ঘটিয়ে একদিকে রাজপথ দখল এবং অপরদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের অধিকতর সক্রিয় করার চেষ্টা করছে। এক বছরেরও বেশি আগে থেকেই বিএনপি বলে আসছে, বর্তমান সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। এ জন্য তারা তখন থেকেই বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করা থেকে বিরত রয়েছে। গত বছর ১০ ডিসেম্বর থেকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না- এমন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু করে। সেই সঙ্গে বিএনপি ও এই দল সমর্থিত সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ পরিষ্কার করতে ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে দৌড়ঝাঁপ বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশ এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে চিঠি চালাচালি করে। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার বিষয়ে তাগিদ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সংবিধানের মধ্যে থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দেওয়া হয়। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকেও সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচনের কথা বলা হয়নি। অভিজ্ঞ মহলের মতে, বিএনপির আন্দোলনের টার্গেট আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকারকে চাপে ফেলে দাবি আদায় করা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের টার্গেট অতীতের মতো রাজপথেই বিএনপিকে মোকাবিলা করা। বিএনপি আজকের সমাবেশ থেকে একদফা দাবি আদায়ে আলটিমেটাম ও নতুন কর্মসূচি দেবে। বিপরীতে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত নানা কর্মসূচির মাধ্যমে রাজপথ নিজেদের দখলে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ। আজকের সমাবেশ থেকে দলের নেতাকর্মীদের রাজপথে সক্রিয় থাকার ঘোষণা দেবেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা।
Published on: 2023-10-17 19:40:38.599017 +0200 CEST