দৈনিক জনকণ্ঠ
দ্বিতীয় কিস্তি ডিসেম্বরে

দ্বিতীয় কিস্তি ডিসেম্বরে

ঋণ প্রদানের শর্ত পরিপালনে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আর্থিক খাতের সংস্কার কার্যক্রমের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আইএমএফ। সংস্থাটি মনে করে, বৈশ্বিক সংকটের এই সময় বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি, জলবায়ু মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা প্রশংসনীয়। আইএমএফ সমর্থিত প্রোগ্রামের অধীনে কাঠামোগত সংস্কারে যথেষ্ট অগ্রগতি করেছে বাংলাদেশ। তবে ঋণ চুক্তির ছয়টি শর্তের মধ্যে চারটি পূরণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। দুটিতে ব্যর্থতা থাকলেও দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ে তা বাধা হবে না। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ে নতুন কোনো শর্তও দিচ্ছে না আইএমএফ। তবে চলমান সংকট কাটিয়ে উঠতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সাধারণ মানুষকে রক্ষায় সামাজিক নিরাপত্তায় জোর এবং অর্থনৈতিক কমর্কা- পুরোপুরি চালু রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার আইএমএফের পক্ষ থেকে বিকেলে দেওয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলা হয়। এর আগে প্রতিনিধি দলটি সকালে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে তাদের এবারের সফরের শেষ বৈঠকে মিলিত হয়। দুপুরে রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে প্রতিনিধি দলটির সৌজন্যে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করে অর্থ বিভাগ। ওই অনুষ্ঠানে অর্থসচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গত ৪ অক্টোবর আইএমএফের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ সফরে আসেন। দুই সপ্তাহের বেশি সময় বাংলাদেশে অবস্থানকালীন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও অধিদপ্তরের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকে মিলিত হয়। বৃহস্পতিবার রাতেই সফররত প্রতিনিধি দলটির ওয়াশিংটনে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়, ঋণ প্রদানের শর্তে বাংলাদেশ যেসব সংস্কারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে তা চ্যালেঞ্জিং। এ অবস্থায়ও সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশকে ঋণ প্রদান করে যে সহযোগিতা করা হয়েছে ভবিষ্যতেও  তা অব্যাহত রাখবে আইএমএফ। বর্ধিত ক্রেডিট সুবিধা, বর্ধিত তহবিল সুবিধা, স্থিতিস্থাপকতা এবং টেকসই সুবিধার অধীনে প্রথম পর্যালোচনাতে স্টাফ-লেভেল চুক্তিতে  পৌঁছেছে আইএমএফ। তবে স্টাফ দলের বিবৃতি, যা একটি দেশ সফরের পর প্রাথমিক ফল প্রকাশ করে। এই বিবৃতিতে প্রকাশিত মতামতগুলো আইএমএফের কর্মীদের এবং তা আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে না। এই মিশনের প্রাথমিক ফলের ওপর ভিত্তি করে কর্মীরা একটি প্রতিবেদন  তৈরি করবে যা পরিচালনার অনুমোদন সাপেক্ষে, আলোচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের কাছে উপস্থাপন করা হবে। আইএমএফ মনে করে, নিকট-মেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতির দ্বারা সমর্থিত আরও আর্থিক কড়াকড়ি এবং বৃহত্তর বিনিময় হারে নমনীয়তা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক সংস্কার ত্বরান্বিত করে জলবায়ু এজেন্ডা প্রদানের সময় আইএমএফ প্রোগ্রাম সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং দুর্বলদের সামাজিক ও উন্নয়নমূলক ব্যয়ের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক স্থান তৈরি করতে সংস্কারের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন। এছাড়া নীতি-কাঠামো আধুনিকীকরণ, শাসন ??উন্নত করা এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এবারের সফরে ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ), এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ)  এবং রেজিলিয়ান্স অ্যান্ড সাসটেইন্যাবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ)-তিন ধরনের ঋণ নিয়েও আলোচনা এবং এর অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। আগামী ডিসেম্বরে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি প্রায় ৭০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে ইতিবাচক আভাস দিয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া মিশন শেষে রাহুল আনন্দ বিবৃতিতে বলেন- বাংলাদেশ সরকার আইএমএফ সমর্থিত প্রোগ্রামের অধীনে কাঠামোগত সংস্কারে যথেষ্ট অগ্রগতি করেছে, কিন্তু চ্যালেঞ্জগুলো  রয়েছে। প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের ঘরে নেমে আসতে পারে। এছাড়া  রিজার্ভ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং মধ্যমেয়াদে প্রায় চার মাসের সম্ভাব্য আমদানিতে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যাহোক, দৃষ্টিভঙ্গির চারপাশে অনিশ্চয়তা বেশি থাকে এবং ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে। এজন্য সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, সামাজিক ব্যয় এবং বিনিয়োগের জন্য রাজস্ব বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই পদ্ধতিতে কর জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য সমন্বিত করনীতি এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। ভর্তুকি যৌক্তিককরণ, ব্যয় দক্ষতা উন্নত করা এবং আর্থিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় অতিরিক্ত ব্যয় বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারবে। সুদের হার নির্ধারণে করিডর ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং একীভূত একক বিনিময় হার গ্রহণ ভালো পদক্ষেপ হবে। এগুলোর ওপর ভিত্তি করে, বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত সুদের হার টার্গেটিং কাঠামো সম্পূর্ণরূপে চালু করা এবং ধীরে ধীরে একটি নমনীয় বিনিময় হার ব্যবস্থায় চলে যাওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, অর্থিক সংস্কারে নেওয়া বাংলাদেশের পদক্ষেপে আশ্বস্ত হয়েছে আইএমএফ রিভিউ মিশন। ঋণ চুক্তির ছয়টি শর্তের মধ্যে চারটি পূরণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। দুটিতে ব্যর্থতা থাকলেও তা দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ে বাধা হবে না। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ে নতুন কোনো শর্তও দিচ্ছে না আইএমএফ। রাহুল আনন্দ আরও বলেন, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থায়নের চাহিদা মেটাতে ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা  মোকাবিলা করা গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের অ-পারফর্মিং ঋণ হ্রাস, তত্ত্বাবধান বাড়ানো, শাসনব্যবস্থা জোরদার করা এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোর উন্নতি আর্থিক খাতের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজারের বিকাশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে সহায়তার জন্য অর্থায়ন জোগাড় করতে সাহায্য করবে। এছাড়া ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের স্থিতিতে পৌঁছানোর জন্য কর্তৃপক্ষের উচ্চাকাক্সক্ষাকে সমর্থন করার জন্য কাঠামোগত সংস্কার এজেন্ডাকেও কেন্দ্রীভূত করেছে। বাণিজ্য সম্প্রসারণ, আরও এফডিআই আকর্ষণ করা, বিনিয়োগের পরিবেশ বাড়ানো এবং মহিলাদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বর্পূ। এছাড়া জলবায়ু মোকাবিলায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা জরুরি হয়ে পড়ছে। বৃহস্পবাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। তিজানান, আইএমএফের বেশ কিছু শর্ত ছিল। এর মধ্যে ৬টি শর্ত নিয়ে কাজ করে। শর্তের বেশকিছু সফল হয়েছে। কিছু পূরণ হয়। তবে বৈঠকে উভয়পক্ষ বেশকিছু বিষয়ে একমত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষতে বলা যায়, ঋণের দ্বিতীয় কিস্ত ৬৮১ মি(৬ কো৮১ লাখ র্মান ডলার) আমরা পা। ডিসেম্বরে আইএমএফ তাদের বোর্ড মিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। ডিসেম্বরে ঋণের দ্বিতীয় কিস্ত পাবে বলে প্রত্যাশার কথা জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র। এক প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, আইএমএফ ঋণ অনুমোদনের সময় আমাদের কিছু শর্ত দিয়েছিল। এর মধ্যে বেশকিছু শর্ত পূরণ করা হয়েছে। দুয়েকটি জায়গায় ব্যর্থতা আছে। রিজার্ভ কিছু কম আছে। রাজস্ব আহরণ কম হয়েছে। তবে অনেক কিছু বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশের কথা ছিল যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করেছে। বিপিএমসিক্স অনুযায়ী রিজার্ভ হিসাবায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া মুদ্রার বাজার-নির্ধারিত বিনিময় হার প্রবর্তন করা হয়েছে। সুদহারের নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে। আইএমএফ বেশকিছু বিষয়ে নির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে চলতি বছরের জানুয়ারিতে। এ ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার গত ফেব্রুয়ারিতে পায় বাংলাদেশ। দেশে ডলার সংকট চলাকালে আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
Published on: 2023-10-19 19:27:50.748933 +0200 CEST