দৈনিক জনকণ্ঠ
তফসিল আজ বা কাল

তফসিল আজ বা কাল

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আজ বুধবার অথবা কাল বৃহস্পতিবার এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে তফসিল ঘোষণা করবেন তিনি। ইসি সূত্র জানায়, মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনের একটি অনানুষ্ঠানিক  বৈঠকে আজ বুধবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। সেজন্য আজ বিকেলে কমিশনের একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে। আর এ বৈঠকে তফসিলসহ নির্বাচনের বিষয়ে সকল সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে তফসিল ঘোষণা করবেন সিইসি। তবে শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতিজনিত কোনো ত্রুটির কারণে আজ তফসিল ঘোষণা না করা গেলে তা বৃহস্পতিবার করা হবে। সকল দলের অংশগ্রহণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে করার জন্য দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের নানামুখী চাপ থাকলেও এ ব্যাপারে এখনো পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হয়নি। সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখনো দুই মেরুতে। রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে যেসব শর্ত দিচ্ছে তা সংবিধানসম্মত নয় বলে সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তাই বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে তাদের সমমনা দলগুলোকে নিয়ে রাজপথে এ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে হরতাল ও অবরোধের মতো আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে। তবে আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুসারে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা করণীয় তা করার পক্ষে তাদের অবস্থান জানিয়েছে। নির্বাচন কমিশনও বলছে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সকল প্রস্তুতি তাদের রয়েছে। তবে এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সহযোগিতা করতে হবে। এদিকে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার শেষ চেষ্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়ে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তার পক্ষ থেকে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তিন দলের কাছে চিঠি পৌঁছে দিয়ে তাদের সংলাপে বসানোর জন্য দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম জানান, ডোনাল্ড লুর চিঠি নির্বাচন কমিশনের তফসিলে প্রভাব ফেলবে না। চিঠিটি সংলাপের আহ্বান জানিয়ে কি না, সেটা কমিশন অবহিত নয়। কারণ, চিঠি কমিশনের কাছে আসেনি। তাই এই চিঠি নিয়ে ইসির মাথাব্যথা নেই। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, নির্বাচনী তফসিলের সঙ্গে সংলাপের কোনো সম্পর্ক নেই। সংবিধান অনুসারে সুনির্দিষ্ট সময়ে তফসিল ঘোষণা হবে। রেওয়াজ অনুসারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন। এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাষণ রেকর্ড করা হয়। আর সন্ধ্যায় ওই ভাষণ প্রচার করা হয়। ওই ভাষণেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ইসি সূত্র জানায়, আজ বিকেলে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকের পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। কোনো কারণে তা না হলে বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হবে তফসিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মঙ্গলবার সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প উদ্বোধনকালে বলেছেন, দুই-একদিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে। ইসি সচিব জাহাংগীর আলম মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, কখন কীভাবে তফসিল ঘোষণা হবে, তা বুধবার সকাল ১০টায় সাংবাদিকদের জানানো হবে। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার আলোকে ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী এগিয়ে যাবে। তিনি জানান, জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। ১৯৭০ সাল পরবর্তী সময়ে এ পর্যন্ত যতগুলো জাতীয় নির্বাচনের তফসিল হয়েছে, সিইসি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জাতিকে তা অবহিত করেছেন। এবারও সেই রেওয়াজ অব্যাহত থাকবে। এদিকে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া তফসিল ঘোষণা হলে নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিল কর্মসূচি ঘোষণা করে রেখেছে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন। বিএনপিসহ অন্যান্য দলও অনুরূপ কর্মসূচি দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, বিএনপি ও তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দল তফসিল ঘোষণা করা হলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা আগেই দিয়েছে। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন. নির্বাচন কমিশনের হাতে কোনো অপশন নেই। তাই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার অংশ হিসেবে যথাসময়ে নির্বাচন করতেই হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন অপশন থাকে। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতেও পারে, আবার নাও করতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে হবে। তাই ইসি দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। নিরাপত্তা জোরদার ॥ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন ভবন ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এ ছাড়া নির্বাচন ভবনে এনআইডি সংশোধনের জন্য ব্যক্তিগত শুনানি মঙ্গলবার থেকে বন্ধ করা হয়। যাদের অফিসিয়াল আইডি নেই তাদের সংশ্লিষ্ট অধিশাখা থেকে নির্বাচন ভবনে প্রবেশের সাময়িক অনুমতিপত্র সঙ্গে রাখতে হবে। এ ছাড়া সব অধিশাখার প্রধানকে যাদের অফিসিয়াল আইডি নেই তাদের তালিকা নির্বাচন ভবনের অভ্যর্থনা কেন্দ্রে দিয়ে রাখতে বলা হয়। এখন নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে প্রবেশ করতে গেলে গেটের সামনে পুলিশি জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে সাংবাদিকসহ সবাইকে। আজ বুধবার থেকে নির্বাচন ভবনে প্রবেশের সময় অফিসিয়াল পরিচয়পত্র দৃশ্যমান অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখার জন্য অনুরোধ করেছে ইসি। নিরাপত্তা জোরদারের অংশ হিসেবে ওই এলাকায় পুলিশি টহলও বাড়ানো হয়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই পুলিশের গাড়ি নির্বাচন কমিশনের সামনে দিয়ে টহল দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের আগের নেওয়া রোডম্যাপ অনুযায়ী ডিসেম্বরের শেষ অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। তফসিল ঘোষণার পরই সুনির্দিষ্টভাবে জানা যাবে এ নির্বাচন কবে হবে। সাধারণত তফসিলের ৪৫ দিন পর নির্বাচন হয়। তবে এর চেয়ে বেশিদিন সময় দেওয়া হলেও নির্বাচন আইনের কোনো ব্যত্যয় হবে না। কারণ, আইনে তফসিলের পর ভোটের জন্য কতদিন সময় দেওয়া যাবে তা উল্লেখ নেই। ভোটার তালিকা চূড়ান্ত ॥ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা আগেই চূড়ান্ত করা হয়েছে। মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন। আর নারী ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার হচ্ছে ৮৫২ জন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আসনভিত্তিক ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন। ৩০০ আসনের জন্য আলাদা আলাদা ভোটার তালিকার সেট প্রস্তুত করা হয়েছে। এই তালিকা অনুযায়ী প্রতিটি সংসদীয় আসনের ভোটগ্রহণ করা হবে। এবার ৩০০টি সংসদীয় আসনে ভোটকেন্দ্র থাকছে ৪২ হাজার ৩৮০টি। আর ভোটকক্ষ থাকছে দুই লাখ ৬১ হাজার ৬৬৮টি। প্রতিটি ভোটকক্ষের জন্য একটি করে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স রাখা হবে। এ ছাড়া প্রতি কেন্দ্রে একটি করে অতিরিক্ত ব্যালট বাক্স দেওয়া হবে। সে হিসাবে সংসদ নির্বাচনে তিন লাখের বেশি স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রয়োজন হবে। ভোটগ্রহণের জন্য এবার দশ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ইসি সূত্র জানায়, ভোটগ্রহণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়সহ মাঠ পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। এখন শুধু ব্যালট পেপার ছাপার কাজ সরকারি মুদ্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে। প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর ব্যালট পেপার ছাপার কাজ শেষ করা হবে। এখন ফর্মেট প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। আগেই আঞ্চলিক, জেলা, উপজেলা ও থানা নির্বাচন অফিসের নিরাপত্তা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে ইসি। অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের জন্য স্মার্ট অ্যাপ চালু করা হয়েছে। এখন ঘরে বসেই নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি শেষবারের মতো ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সংলাপের আয়োজন করে। তবে এই সংলাপে আওয়ামী লীগসহ ২৬টি দল অংশ নিলেও বিএনপিসহ ১৮টি দল যায়নি। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কয়েকটি বাম দল, তৃণমূল বিএনপি এবং বেশ কয়েকটি ইসলামী দলসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মাঠে সক্রিয় রয়েছে। দিনদিনই তারা প্রস্তুতি জোরদার করছে। ইতোমধ্যেই সংসদীয় আসনগুলোতে তাদের প্রচার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দলের ইশতেহার প্রণয়নের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। শীঘ্রই এসব রাজনৈতিক দল প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়াও শেষ করবে। তবে বিএনপি কী আন্দোলন চালিয়ে যাবে না শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের পথে আসবে তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে বিভিন্ন মহল চাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে বিএনপিসহ সব দলকে নির্বাচনে নিতে।
Published on: 2023-11-14 18:31:19.597666 +0100 CET