সম্প্রতি বেশ কয়েকটি মাদকের চালান আটক করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। জব্দ করা মাদকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছে ইয়াবা।
বিভিন্ন সময়ে পাচারের সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথাও অনেক সময় উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
শুক্রবার রাতে কক্সবাজারে ২০ হাজার ইয়াবাসহ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর একজন এসআই ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে মাদকদ্র্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। চলতি বছরেই বিভিন্ন সময় কক্সবাজার, টেকনাফসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ইয়াবা জব্দ করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রকাশিত সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ মাসেই প্রায় ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৯ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ২০২২ সালের বার্ষিক ড্রাগ রিপোর্ট অনুযায়ী, সব সংস্থা মিলে গত ৫ বছরে প্রায় ২১ কোটি ৬৬ লাখেরও বেশি ইয়াবা জব্দ করেছে।
ইয়াবার চালান ঠেকাতে সরকারি নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও ঠেকানো যাচ্ছে না এই মাদকের বিস্তার। এখন ইয়াবার পাশাপাশি ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের মতো ভয়ঙ্কর মাদকও আসছে বাংলাদেশে।
বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক চক্র এক সময় বাংলাদেশকে মাদকের করিডোর হিসেবে ব্যবহার করলেও এই ব্যবসায় বাণিজ্যিক লাভের যে সুযোগ আছে তাতে অভ্যন্তরীণ বাজারও তৈরি হয়েছে।
অন্যতম রুট টেকনাফ
বাংলাদেশে ইয়াবা-আইসের মতো মাদক প্রবেশের অন্যতম রুট হলো কক্সবাজার ও মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষা টেকনাফ রুট।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক গবেষক ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এম ইমদাদুল হক বলেছেন, আশির দশকে ভারত থেকে অবৈধভাবে আসা ফেনসিডিলের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছিল মাদকসেবীদের কাছে। এরপর কিছু সময় হেরোইনে আসক্ত হয় মাদকসেবীরা। ধীরে ধীরে সেই জায়গাটা দখল করে নিয়েছে মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা।
স্বাধীনতার আগে থেকে টেকনাফ অঞ্চল মাদক চোরাচালানের অন্যতম রুট। আশির দশকে হেরোইন চোরাচালানের রুট হিসেবে এটা বেশ ব্যবহার করতো চোরাকারবারিরা। আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশকে একটা করিডোর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে গত পাঁচ বছরে শুধুমাত্র কক্সবাজার জেলা থেকেই আট কোটির বেশি ইয়ারা উদ্ধার করা হয়েছে। গত দুই বছরে এই জেলা থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার আইস উদ্ধার করা হয়েছে। এই টেকনাফ রুট দিয়ে এলএসডি এবং আইসের মতো মাদক আসছে। যেটা বেশ অ্যালার্মিং।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থায় গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের কাছাকাছি হওয়ায় সহজেই এই পথ বেছে নিতে পারছেন মাদক ব্যবসায়ীরা। তারা রাতের আঁধারে বা ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন সময় এই রুট বেছে নিচ্ছেন।
টেকনাফের সীমান্ত ঘেঁষা মিয়ানমারে বেশ কিছু ইয়াবা কারখানা তৈরি হয়েছে। যেখান থেকে ইয়াবার চালানগুলো বাংলাদেশে এসে ঢুকছে।
কক্সবাজারের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর অধিনায়ক মো: আমির জাফর মনে করেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থাকার কারণে এখন মাদক পাচারের পরিধিও বেড়েছে।
মিয়ানমারের যেখান থেকে মূলত ইয়াবার চালান এসে ঢুকে রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল সেই একই জায়গায়। পথঘাট চেনা। সেটা তাদের আনার জন্য সহজ। যেহেতু সংখ্যায় প্রায় দশ লাখের বেশি মানুষ বাস করছে।
যেসব চালেঞ্জ তারা মোকাবেলা করছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো ইয়াবা, আইসের মতো মাদক পাচার ঠেকানো।
কম পরিশ্রমে বেশি লাভ
ইয়াবার মতো মাদক ব্যবসায় বাণিজ্যিক লাভের যে সুযোগ রয়েছে সেই কারণে এর নিয়ন্ত্রণ সহজে সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক ইমদাদুল হক বলছেন, ইয়াবা, আইসের মতো মাদক পাচার ঠেকাতে না পারার অন্যতম কারণ হলো- বড় ধরনের বাণিজ্যিক লাভের যে সুযোগ এই লোভটা সংবরণ করতে পারছে না ব্যবসায়ীরা। স্থানীয়ভাবে ব্যবসায়ী, চোরাকারবারী, বিনিয়োগকারীর সংখ্যা যে বাড়ছে এর কারণ আন্তর্জাতিক চক্রও এখানে কাজ করছে।
তার মতে, আর্থিক লাভের কথা ভেবেই বেপরোয়াভবে এই ব্যবসার কাজটি পরিচালনা করে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চক্র।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক সঞ্জয় কুমার চৌধুরী বলেন, যারা ইয়াবার ব্যবসা করেন তারা অতি কম পরিশ্রমে অনেক টাকা লাভ করতে পারেন। প্রতি পিস ইয়াবার দাম ২০০ টাকা যদি হয় তাহলে এর বাজারটা কত বড় সেটা নিশ্চয়ই আঁচ করা যায়। এজন্য মানুষ ঝুঁকি নিয়ে কাজটা করে।
অধ্যাপক ইমদাদুল হকের মনে করেন, ২০১৮ সালের মে মাসে বাংলাদেশের সরকার যে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেছিল সেই সময়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততাও বেড়ে যায়।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
Published on: 2023-05-23 10:01:18.205921 +0200 CEST
------------ Previous News ------------