প্রভাবশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পর সরকার, বিরোধীদলসহ সারাদেশের মানুষের মধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে এই ভিসানীতিকে ইতোমধ্যে সরকার স্বাগত জানিয়েছে। বিরোধীদল বিএনপিও পিছিয়ে নেই স্বাগত জানানোর তালিকায়। তবে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভিসানীতি ঘোষণার পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও প্রকৃতপক্ষে ভিসানীতিটি দলটির জন্য বুমেরাং হয়ে যেতে পারে।
ভিসানীতি ঘোষণার পর শীর্ষ নেতা ও কর্মীদের মধ্যে উল্লাস দেখা গেলেও বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এবং নির্বাচন প্রতিহতের হুমকি দেওয়ার মতো বিষয়ে দলটি হোঁচট খেতে পারে। এর ফলে দলটির নির্বাচন বয়কট প্রবণতা, দেশব্যাপী জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি এবং বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে নালিশ দেওয়ার প্রবণতা কমে আসবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুত অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে প্রাধান্য দেওয়ায় ক্ষমতাসীনদের জন্য আখেরে লাভই হয়েছে। কারণ এখন আর বিএনপির সামনে নির্বাচনে না আসার কোনো সুযোগ থাকছে না। বিএনপি জোটকে এখন শেখ হাসিনার অধীনেই জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। তত্ত্বাবধায়কের মতো অগণতান্ত্রিক সরকার গঠনের স্বপ্নও ছেড়ে দিতে হবে দলটিকে। সেই কারণে শুরুতে বিএনপির নেতাদের মুখে স্বস্তি থাকলেও ভেতরে ভেতরে চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন তারা।
এই নতুন ভিসানীতিতে বলা হয়েছেÑ আগামী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো রকম অনিয়ম, হস্তক্ষেপ ও বাধা দান করা হলে এর সঙ্গে জড়িত যে কোনো ব্যক্তি ও তার পরিবারকে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। সেক্ষেত্রে ভুয়া ভোট প্রদান, ভোটার ও নির্বাচনী এজেন্টদের বাধা দান, নির্বাচনী সমাবেশে হামলা, গায়েবি মামলা প্রদান, নির্যাতন-নিপীড়ন, মতপ্রকাশে বাধা দান ইত্যাদি কাজ নির্বাচনে অনিয়ম ও হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এসব কাজে জড়িত থাকলে সরকারের সব পর্যায়ের ব্যক্তি (মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনী) এবং বিরোধী দলেরও যে কেউ এই ভিসানীতির তোপে পড়তে পারেন।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসানীতিতে চারটি কারণে বিএনপি চাপে পড়েছে। বিএনপির দাবি অনুযায়ী ভিসানীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কোনো বার্তা নেই। এই বিষয়টি ভিসানীতিতে যুক্তরাষ্ট্র অন্তর্ভুক্তই করেনি। অথচ বিএনপির এটি ছিল মূল দাবি। আর বিদেশী শক্তির দ্বারা সরকারের পতন ঘটানোর বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সব দলকে নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি অংশ না নিলে আসলে জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না সেই বিষয়টিই ভিসানীতিতে আসেনি।
বৃহস্পতিবার নিয়মিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে জানান, বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে মাথাব্যথা নেই যুক্তরাষ্ট্রের। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই দেশটির লক্ষ্য। তিনি আরও বলেন, আগামী নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দল অংশ নেবে কি না তা বাংলাদেশের একান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। অবাধ ও সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে একটি ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। আমরা জানতে পেরেছি বাংলাদেশ সরকার এটিকে স্বাগত জানিয়েছে। বিরোধী দল কোনো সহিংসতা করলে এই নীতির আওতায় তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়। এ সময় সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে বাংলাদেশ সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতার কথা জানান মিলার।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ভিসানীতির বিষয়টি তুলে ধরে এমনটি বললেও তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বিএনপি ধারাবাহিক আন্দোলন করে আসছে। এটিকে এক দফা দাবিতে রূপ দিয়ে সমমনা রাজনৈতিক মিত্রদের নিয়ে বৃহৎ আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে দলটি। চলছে যুগপৎ কর্মসূচিও। সেই কারণে মার্কিন সরকারের ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু গুরুত্ব না পাওয়ায় বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। তারা এই ইস্যুতে আন্দোলন চালিয়ে যাবে না কি সংবিধানের আলোকে নির্বাচনে অংশ নেবে, সেটিও ভাবতে হবে।
কারণ এতদিন বিএনপি ও জোটের সদস্যরা দেশে-বিদেশে কূটনীতিকদের কাছে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে লবিং করে যাচ্ছিল। আপাতত বিএনপির সেই চেষ্টা বিফল হয়েছে। বিএনপির এমন দাবিতে কোনো সাড়া দেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া দলটির শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিষেধাজ্ঞা চলছে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিশ্রুত অবাধ নির্বাচন প্রতিহত করতে চাইলে এবার নেতাকর্মীদেরও নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হবে। সেক্ষেত্রে বিএনি পকে নতুন করে কৌশল ঠিক করতে হবে নতুন ভিসানীতি মেনে। যেটি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কিছুটা কঠিনই।
আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক এম এ আরাফাত বলেন, নতুন মার্কিন ভিসানীতি কোনো দল, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নয়। যারাই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা দেবে এবং সহিংসতা করবে, তাদের বিরুদ্ধে এটি কার্যকর হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। সেটি শুধু কথার কথা নয়, আমরা করে দেখাব। এই ভিসানীতিতে চাপে পড়বে বিএনপি। তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন দলটিকে নির্বাচন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও সক্রিয় করবে। এই নীতির ফলে বিএনপিসহ সব বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করবে। বিএনপির তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন বিফল হয়েছে। শেখ হাসিনার অধীনেই তাদের (বিএনপি) নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। নইলে বিএনপির নেতারা ভিসানীতি অনুসারে চাপে পড়বে। আওয়ামী লীগ সব সময় অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সেটাই চেয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবৃতিতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির প্রতিধ্বনি। তবে বিএনপি বিশ্বাস করে বর্তমান সরকারের অধীনে কোনোভাবেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। কেবলমাত্র একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই তা সম্ভব। আর সে কারণেই বিএনপি দেশের সকল গণতান্ত্রিক দল ও শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায়ের লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে চলছে।
শুক্রবারের বিএনপি মহাসচিবের বিবৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দলটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে সন্তোষ প্রকাশ করলেও পুরো সন্তুষ্টি নেই। কারণ ভিসানীতিতে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচনের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সেই কারণে বিএনপি এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ছাড়ছে না। কিন্তু ভিসানীতি মানলে দলটির এসব বিবৃতি আর আন্দোলনের কোনো সুযোগ নেই। সেই কারণে ভিসানীতিতে যে বিএনপি সুবিধাজনক অবস্থায় নেই সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ভিসানীতির প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন বলেছেন, সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন না হলেও নিষেধাজ্ঞার যে ইঙ্গিত দিয়েছে তারা, এটি যথাযথই করেছে। ভিসা থেকে শুরু করে যেসব বিষয় আমাদের সামনে এসেছে, এগুলো আমাদের জাতির জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর ও লজ্জার।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছয় মাস ধরেই প্রভাবশালী দেশগুলোকে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। তাই ভিসানীতি বিষয়ে খামখা উতলা হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আছি, থাকব। ভিসানীতিতে দেশের কোনো ক্ষতি হবে না। আওয়ামী লীগের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কোনো দুরভিসন্ধি নেই। সেই কারণে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মার্কিন যক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সদস্যরাও নিষেধাজ্ঞায় পড়বেন। কারণ বিরোধী দল সব সময়ই আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে থাকেন। আর সেটি অনেক সময় সহিংস ও জ্বালাও এবং পোড়াও কর্মসূচিতে পরিণত হয়। সেই কারণে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা এই নীতিতে নিষেধাজ্ঞায় পড়বেন। নিজেদের মতো পরিবারের সদস্যরাও নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, নতুন এই ভিসানীতি দ্বিপক্ষীয় নয়, অভ্যন্তরীণ ও রাজনৈতিক কারণে মার্কিন সরকার এ কাজটি করছে। মার্কিন সরকার সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দিন দিন শক্তিশালী হয়েছে। এই নীতিতে সরকারি ও বিরোধী সবপক্ষই সমভাবে চাপে থাকবে। যেহেতু বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে আগের ধারা থেকে বের হয়ে সেক্ষেত্রে বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ থাকবেই।
Published on: 2023-05-26 18:50:34.618421 +0200 CEST
------------ Previous News ------------