দৈনিক জনকণ্ঠ
উৎপাদনে টালবাহানা

উৎপাদনে টালবাহানা

দেশের মোট ১৫৩ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ৫টি অবসরে যাওয়ার পর এখন চালু রয়েছে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৪৮টি। এর মধ্যে ৭০ থেকে ৭৫টি বেসরকারি মালিকানায়। এর মধ্যেই চলতি বছর দেশে আরও নতুন ২৩ টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসতে যাচ্ছে। যার মধ্যে ১৩টিই বেসরকারি মালিকানায়। দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার বড় একটা অংশ সরবরাহ করলেও বকেয়ার দাবিতে সম্প্রতি সরকারকে একপ্রকার জিম্মি করে রেখেছে কেন্দ্র মালিকরা। এমনকি অর্থের অভাবে জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না অজুহাতে সাম্প্রতিক বিদ্যুতের তীব্র সংকটেও উৎপাদন বন্ধ রাখে অনেক কেন্দ্র। সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা নেওয়ার সময় তৎপর থাকলেও বর্তমান সংকটে এমন উদাসীনতাকে স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ কেনা বাবদ সংস্থাটির ব্যয় হয়েছে ৭৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে এটা ছিল ৫১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বিদ্যুৎ কিনতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় বেড়েছে ২২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। এছাড়া বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনায় গত অর্থবছরের ব্যয় ৬ হাজার ৭৪৩ কোটি ৮৮ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ১৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপি) আওতাধীন কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ব্যয় হয়েছে ৪৯ হাজার ২১৩  কোটি টাকা, যেখানে আগের অর্থবছরে এ বাবদ ব্যয় হয়েছিল ২৭ হাজার ৭৩৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। সে হিসাবে গত অর্থবছরে আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কেনায় বিপিডিবির ব্যয় বেড়েছে ৭৭ শতাংশ বা ২১ হাজার ৪৭৬  কোটি টাকা। বিশ্বব্যাপী ডলার সংকট চলাকালে এসব কেন্দ্রের পাওনা পরিশোধ করতে পারেনি বিপিডিবি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মালিকদের দাবি, সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি কেন্দ্রের বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধ করেছে পিডিবি। ফলে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পিডিবির কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের বকেয়া পড়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। বিপ্পা এই বকেয়া টাকার ওপর সুদ বাবদ আরও দাবি করছে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। এতে করে সব বকেয়া পরিশোধ করতে হলে বিআইপিপিকে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে পিডিবিকে। তার ওপর টাকায় নয় বরং ডলারেই বকেয়া পরিশোধ চান বেসরকারি কেন্দ্রের মালিকরা। তাদের দাবি, যেহেতু এই অর্থ দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি কিনতে হবে সেহেতু ডলারেই সরকারকে বকেয়া পরিশোধ করতে হবে। টাকা দিয়ে হবে না। যা এই সংকটকালীন সময়ে প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কর ছাড়া, ভর্তুকি মূল্যে জ্বালানি, উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ (রেন্টাল ভাড়া), প্রকল্পের জমি, ঋণ গ্রহণে সহযোগিতাসহ সরকারের কাছ থেকে নানান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকরা। তিন-পাঁচ বছর মেয়াদি ব্যয়বহুল ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর চুক্তির মেয়াদও বেড়েছে একাধিকবার। এর পরও সরকারের কাছ থেকে আরও সুবিধা আদায়ের জন্যই তাদের এই দাবি উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, তারা ফার্নেস অয়েলের আমদানি শুল্ক কমানো ও বকেয়া বিলের ওপর সুদ দাবি করেছে। ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের ওপর ১০-১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের দাবি করেছে তারা। এর আগে ডলারের দর বৃদ্ধিরও আবদার করেছিল। এমনিতেই দেশ একটা কঠিন সময় পার করছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের এই স্বেচ্ছাচারিতা কতটা যুক্তিযুক্ত, তারাই জানেন। এ ব্যাপারে আইপিপির সভাপতি ফয়সাল করিম খান জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের কেন্দ্রগুলোর জ্বালানি তেল নিজেরাই আমদানি করে। অর্থ দিতে বিলম্বের আশঙ্কায় আমদানি বিলের ওপর তারা সরকারের কাছ থেকে ৩ শতাংশ সুদ চেয়েছিল। কিন্তু সেটিও এখন আর যথেষ্ট নয়। দীর্ঘদিন বকেয়া পড়ে থাকায় কেন্দ্রগুলো পরিচালনার ব্যয় মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বকেয়া বিল পরিশোধ হয়েছে। এখনো পাঁচ মাসের বিল বাবদ বকেয়া রয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা না পেলে আমরা জ্বালানি আমদানি করতে পারব না। আর জ্বালানি আমদানি না করতে পারলে উৎপাদন হবে না, এটাই তো স্বাভাবিক। আপনাদের ঠিক কতটি কেন্দ্র সম্প্রতি সর্বোচ্চ চাহিদাকালীন উৎপাদন করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে আমাদের বেসরকারি কেন্দ্রেই জ্বালানি সংকট রয়েছে। এদিকে তীব্র গরমে দেশজুড়ে বিদ্যুতের চাহিদা যখন ১৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে তখন পিডিবির অনুরোধে প্রথম ইউনিটের উৎপাদন শুরু করে বেসরকারি মালিকানাধীন এস আলম গ্রুপের চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এসএস পাওয়ার প্লান্টটি। কিন্তু কয়লার মজুত শেষ অজুহাতে চারদিনের মাথায় উৎপাদন বন্ধ করে দেয় কেন্দ্রটি। কিন্তু সূত্রমতে কেন্দ্রটিতে এখনো অন্তত দুই মাসের কয়লা মজুত রয়েছে। যা দিয়ে দ্বিতীয় ইউনিটের পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়টি পরিষ্কার স্বীকার না করলেও কেন্দ্রের ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর মো. মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যাওয়ার জন্য যে সঞ্চালন লাইন প্রয়োজন সেটা পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। ফলে আমরা সিওডি (বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ) করতে পারছি না। তাই আমাদের প্রথম ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ রেখেছি। যে পরিমাণ কয়লা মজুত রয়েছে তা দিয়ে দ্বিতীয় ইউনিটের পরীক্ষামূলক উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। শুধু মূল্য পাচ্ছে না বলেই কেন্দ্রটি এমন কঠিন সময়ে এমন স্বেচ্ছাচারিতা করেছে উল্লেখ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন সময় বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সরকারের কাছ থেকে নানাবিধ সুবিধা আদায় করেছে। এখন সরকারের যখন তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন তখন তারা নানা টালবাহানা শুরু করেছে। এই যেমন এসএস পাওয়ার প্লান্টটি। শুধু সিওডি না হওয়ায় তারা উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। তাহলে তাদের সুবিধা দিয়ে কি লাভ? তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকানা প্রায় একলাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। রেন্টাল কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে। এর পরও  ব্যবসায়ীরা আরও সুযোগ চাচ্ছেন। এসব অযৌক্তিক দাবি মানা কখনই উচিত হবে না। ব্যবসায়ীদের দাবি মানলে তার চাপ গিয়ে পড়বে ভোক্তার ঘাড়ে। এদিকে পিডিবির লোকসান বেড়ে চলার পেছনেও আইপিপি নির্ভরতাকেই দায়ী করছেন অনেকে। একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, সরকারি কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে আইপিডি থেকে বিদ্যুৎ কেনা প্রতিষ্ঠানটিকে আর্থিকভাবে সবচেয়ে বেশি দুর্বল করেছে বলেও দাবি তাদের। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর এই দাবি-দাওয়ার বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জনকণ্ঠকে বলেন, বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দেশের কঠিন সময়ে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে সব সময়। এখন বিশ্বজুড়েই একটা সংকট চলছে। এমন অবস্থায় পিডিবির কাছে তাদের বকেয়ার পরিমাণটা বেড়েছে অনেক। তারা বিভিন্ন সময় আমাদের কাছে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছে। আমরা চেষ্টা করছি সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে। তবে এর জন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন।
Published on: 2023-06-16 20:18:46.391465 +0200 CEST