দৈনিক জনকণ্ঠ
যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কী হাসিল করতে চায়?

যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কী হাসিল করতে চায়?

যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন কম্বোডিয়ায় গত সপ্তাহের নির্বাচনকে ‘নিরপেক্ষ নয়’ আখ্যা দিয়ে দেশটির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এছাড়াও বেশ কিছু আর্থিক সহায়তাও বন্ধ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিতর্কিত ওই নির্বাচনে ৩৮ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা হুন সেনের দল কম্বোডিয়ান পিপল’স পার্টি (সিপিপি) প্রায় বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সব আসনে জয় পায়। নির্বাচনের আগে সিপিপি’র একমাত্র শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যান্ডেললাইট পার্টিকে অযোগ্য ঘোষণা করায় কার্যত একপাক্ষিক নির্বাচনই হয়। নির্বাচনের রাতেই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এক বিবৃতিতে জানান, নির্বাচনের জের ধরে কম্বোডিয়ায় যারা ‘গণতন্ত্রের অবমূল্যায়ন’ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনের আগে কম্বোডিয়ার সরকার ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, মিডিয়া ও সুশীল সমাজের সদস্যদের হুমকি ও হয়রানিমূলক আচরণ করে’ দেশের সংবিধানের চেতনা ক্ষুণ্ন করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি কম্বোডিয়ার দায়িত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে। কম্বোডিয়ায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও ‘গনতন্ত্রের অবমূল্যায়নে জড়িত থাকা’ এবং ‘সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে সরাসরি প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেবার ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা এসেছিল কম্বোডিয়ার তৎকালীন একমাত্র কার্যকর বিরোধী দল সিএনআরপির ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার পর। কম্বোডিয়ায় ২০১৩ সালের নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালে দেশটির ওপর প্রথমবার ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সিপিপি’র ৬৮টি আসনের বিপরীতে বিরোধী দল সিএনআরপি পায় ৫৫টি আসন। নির্বাচনের পর বিরোধী দল ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলে। সিএনআরপি সংসদে আসন গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এবং এক বছর ধরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চালায়। ক্ষমতাসীন দল কঠোরভাবে এই বিক্ষোভ দমন করে এবং সিএনআরপি শেষ পর্যন্ত এই শর্তে সংসদে যোগ দেয় যে, পরবর্তী নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংশোধন আনবে সরকার। কিন্তু এর পরের বছরগুলোতে সরকার বিরোধীদের ওপর আরও কঠোরভাবে চড়াও হয়। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট সিএনআরপি’কে নিষিদ্ধ করে এবং দলের সদস্যদের সংসদ সদস্যপদ বাতিল করে। এরপরই প্রথমবারের মতো কম্বোডিয়ার দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ওপর এবং বিভিন্ন বাণিজ্য সহায়তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ২০১৯ সালে চীনের সহায়তায় কম্বোডিয়ায় একটি নৌঘাঁটি তৈরির খবর প্রকাশিত হলে আবার নিষেধাজ্ঞা আসে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে। আবার, ২০২১ সালে কম্বোডিয়ায় কাজ করা একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিষ্ঠানটি থাইল্যান্ডের উপসাগরের কাছে দারা সাকোর অঞ্চলে চীনা বিমানবাহিনীর ব্যবহারের জন্য এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করছিল। সবশেষ গত ২৩ জুলাইয়ের নির্বাচনের পর কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে আরেক দফা ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিলো যুক্তরাষ্ট্র। কম্বোডিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ২০২২ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো গ্রেগরি পোলিং, সহকারী ফেলো চার্লস ডুন্সট ও সহকারী গবেষক সিমোন ট্রান হিউডস। তাদের গবেষণা অনুযায়ী, কম্বোডিয়ার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব স্ববিরোধী। কম্বোডিয়াকে তাদের অগণতান্ত্রিক চর্চার জন্য শাস্তির আওতায় আনা উচিত নাকি ভূরাজনৈতিক শক্তি অর্জনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা উচিত- এই দোটানায় দেশটির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি দোদুল্যমান রয়েছে বলে মনে করেন গবেষকরা। ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার সংখ্যা মোট ২৮টি, যার মধ্যে ২৬টিই একটি নির্দিষ্ট আইনের অধীনে। গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি হিউম্যান রাইটস অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যাক্ট (জিএমএ)-এর আওতায় বিশ্বের যেকোনো জায়গায় মানবাধিকার লঙ্ঘন বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে তারা। গবেষকদের মতে, স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে হতে পারে কম্বোডিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা ও দুর্নীতি প্রতিরোধই যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ভিসা নিষেধাজ্ঞার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু ২০২১ সালে চীনা বিমানবাহিনীর জন্য এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জিএমএ’র অধীনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বোঝা যায়, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা দুর্নীতির চেয়ে ভূরাজনৈতিক স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ওয়াশিংটন। এই নিষেধাজ্ঞার আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তর ‘কম্বোডিয়ায় ক্ষতিকর চীনা বিনিয়োগ’ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে একটি বিবৃতিও প্রকাশ করেছিল। অন্যদিকে, ২০১৯ সালে চীনের সহায়তায় নৌঘাঁটি তৈরির জের ধরে কম্বোডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরপরই আবার দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে পদক্ষেপ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ২০২২ সালের মে মাসে ‘ইউএস-আসিয়ান স্পেশাল সামিট’-এ অংশ নিতে কম্বোডিয়ান প্রধানমন্ত্রী হুন সেন তিন দশকে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন ও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও গত নভেম্বরে আসিয়ান-ইউএস বৈঠকে অংশ নিতে কম্বোডিয়া সফর করেছিলেন। গবেষকদের মতে, কম্বোডিয়া সম্পর্কে কৌশল নির্ধারণে ওয়াশিংটনকে আরও দূরদর্শিতা অবলম্বন করা উচিত। এখনকার মতো নিষেধাজ্ঞাভিত্তিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অব্যাহত থাকলে কম্বোডিয়ায় গণতন্ত্র ফেরার পরিবর্তে হুন সেনের স্বৈরশাসনই দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে আশঙ্কাপ্রকাশ করেছেন গবেষকরা। সূত্র: বিবিসি বাংলা
Published on: 2023-07-27 12:10:07.554275 +0200 CEST