রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে এ পর্যন্ত প্রায় ২২৭ কোটি টাকা খরচ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ( ডিএসসিসি ) । খাল সংস্কার , ড্রেনেজ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে নিজস্ব অর্থায়নে এই টাকা ব্যয় করে ডিএসসিসি। কিন্তু জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে এখনো নগরবাসীকে পুরোপুরি মুক্ত করতে পারেনি। টানা বৃষ্টিতে ডুবে যায় ঢাকার বিভিন্ন সড়ক। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন পুকুর , জলাধার ও খালগুলো দূষণ - দখল হয়ে যাওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশন হচ্ছে না। গত ২৮ বছরে ঢাকার ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ জলাশয় হারিয়ে গেছে বলে জানান নগর বিশেষজ্ঞরা।
গত শনিবার একঘণ্টার বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক কোমর থেকে হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বেশিরভাগ সড়কের পানি নেমে গেলেও রাজধানীর টিটিপাড়া , বংশাল , যাত্রাবাড়ী , জুরাইন , পোস্তগোলা , শ্যামপুর , মোহাম্মদপুর , মিরপুরসহ নি ¤œ াঞ্চলে সড়কের পানি নামতে কিছু সময় বেশি লেগেছে। আগে এসব এলাকায় দুই - তিনদিন বৃষ্টির পানি সড়কে জমে থাকত। এখন সেই অবস্থা নেই বলে স্থানীয়রা জানান।
কর্তৃপক্ষ অর্থ খরচ করলেও নাগরিক অসচেতনতার কারণে আবর্জনা ফেলে ড্রেনের মুখগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসব ড্রেন পরিষ্কার করার সময় বাসা - বাড়ির জঞ্জাল - আবর্জনা , পলিথিন , গাড়ির টায়ার , বালিশ , তোষক , পচা বস্তাসহ বিভিন্ন রকমের আবর্জনা তোলা হয়। এমনকি ড্রেন থেকে মরা গরুও তোলা হয়েছে। এসব জঞ্জাল - আবর্জনায় ড্রেনের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তাই শুধু অর্থ খরচ করে ড্রেন সংস্কার কাজ করলেই হবে না , নাগরিক সচেতনতা দরকার বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে ডিএসসিসি ’ র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ( পরিবেশ , জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেল ) মো. খায়রুল বাকের জনকণ্ঠ ’ কে বলেন , ‘ ঢাকায় জলাবদ্ধতার ১৩৬ পয়েন্টের মধ্যে ১০৩ পয়েন্টের কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে অনেক স্থানে ড্রেনের আবর্জনা পরিষ্কার করেই জলাবদ্ধতা নিরসন করা হয়েছে। তবে এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এক পয়েন্টের কাজ শেষ হলে আবার নতুন পয়েন্ট যুক্ত হয়। এ পর্যন্ত দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে খাল ও ড্রেনেজ সংস্কার করে জলাবদ্ধতা নিরসন করা হচ্ছে। বর্তমান মেয়র প্রথম দফায় ১০৩ কোটি , দ্বিতীয় দফায় ৭৪ কোটি ও তৃতীয় দফায় ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। তবে শুধু অর্থ খরচ করলেই হবে না , নাগরিক সচেতনতা খুবই প্রয়োজন। কারণ শহরের মানুষ জঞ্জাল - আবর্জনা ফেলে ড্রেনের মুখগুলো বন্ধ করে দেয়। এতে পানি নিষ্কাশনে সমস্যা হয়। আগে থেকে সড়কের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। আগে বৃষ্টি হলে সড়কে দুই - তিনদিন পানি জমে থাকত। এখন এক ঘণ্টা পানি জমলেই মানুষ বকাঝকা শুরু করে। ’ ঢাকার খালগুলো পুরোপুরি সচল হলে জলাবদ্ধতা অনেকাংশে নিরসন করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের জন্য ঢাকা ওয়াসা রক্ষণাবেক্ষণে ছিল ৩৮৫ কিলোমিটার গভীর ড্রেন , চারটি পাম্প স্টেশন , ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট। পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রক্ষণাবেক্ষণ করে ৫২টি স্লুইসগেট এবং একটি পাম্প স্টেশন , রাজউক রক্ষণাবেক্ষণ করে ২৫ কিলোমিটার লেক এবং ৩০০ কিলোমিটার জলাশয়। ডিএনসিসির এক হাজার ২৫০ কিলোমিটারের বেশি ড্রেনেজ লাইন রয়েছে এবং ডিএসসিসির রয়েছে ৯৬১ কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন। এ ছাড়া বর্তমানে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের আওতায় দেওয়া হয়েছে ৫১টি খাল , ৪টি পাম্প স্টেশন , ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট। তবে এখনো পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৫২টি স্লুইসগেট এবং একটি পাম্প স্টেশন , রাজউক - এর ২৫ কিলোমিটার লেক এবং ৩০০ কিলোমিটার জলাশয় সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। তাই সব খাল , ড্রেন ও জলাশয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ভারি বৃষ্টিতেই তৈরি হয় জলাবদ্ধতা।
এ বিষয়ে ডিএসসিসি ’ র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন , ‘ দুই বছর আগে আমরা ওয়াসা থেকে খালগুলো বুঝে পেয়েছি। তাই নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্পমেয়াদি কিছু কাজ করা হলেও দীর্ঘমেয়াদি অনেক কাজ এখনো বাকি। এ ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড ও রাজউকের খালগুলো আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। এগুলো পাওয়া গেলে এবং আরও কিছু কাজ করলে ঢাকার জলাবদ্ধতা পুরোপুরি নিরসন করা যাবে। তবে নগরবাসীর সচেতনতার অভাবে বিভিন্ন ড্রেনের মুখে পলিথিনসহ বিভিন্ন জঞ্জাল আবর্জনায় ভরাট হয়ে যায়। তাই সংস্কার করার পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা খুবই দরকার। ’
বৃষ্টিতেই ডুবে যায় ঢাকার সড়ক ॥ ভারি বৃষ্টি হলে ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকাতেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। গত শনিবার বিকেল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টা টানা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক। কোথাও হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে যায় সড়কগুলো। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ে ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফেরা ঘরমুখো মানুষ। টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটের বিভিন্ন সড়ক। এ ছাড়া গ্রিন রোড , পান্থপথ , শাহবাগ , শুক্রাবাদ , রাজাবাজার , কাকরাইল , মালিবাগ , বিজয়নগর , নয়াপল্টন , ফকিরাপুল , আরামবাগ এলাকার মূল সড়ক থেকে অলিগলিতে হাঁটু থেকে কোমর পানিতে ডুবে যায়।
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে , শনিবার দুই ঘণ্টার ভারি বৃষ্টিতে রাজধানীর বেশিরভাগ সড়কে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। বৃষ্টির পানি রাস্তার পাশে অনেক দোকান ও বাসা - বাড়ির নিচতলায় প্রবেশ করতেও দেখা গেছে। পান্থপথ মোড় থেকে ফার্মগেট আসার রাস্তা পুরোই পানিতে ডুবে গেছে। এ ছাড়া এইচআর হোম ও এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির সামনে পানি থই থই করেছে। সেখানে কোমর পরিমাণ পানি। একই অবস্থা ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সামনের সড়কে। কোমর পানিতে আটকা পড়ে সিএনজি অটোরিক্সা , প্রাইভেট কার , মাইক্রোবাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের।
মুরাদ নামের মালিবাগের এক বাসিন্দা জানান , ঈদের ছুটি শেষে কিশোরগঞ্জের গ্রাম থেকে ট্রেনে ঢাকায় আসলাম। বৃষ্টির কারণে বের হতে পারি না। কমলাপুর থেকে রিক্সায় মালিবাগ যাচ্ছি। কিন্তু রাজারবাগ এলাকার সড়ক কোমর পানিতে ডুবে গেছে। প্রতি বছর সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করে বড় বড় পাইপ বসানো হয়। কিন্তু একটু ভারি বর্ষণ হলেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। প্রতি বছর এত টাকা খরচ করে কি লাভ ? শুধু শুধু জনগণের ভোগান্তি।
একই অবস্থা রাজধানীর বিজয়নগর থেকে আরামবাগ সড়কে। বৃষ্টি হলেই হাঁটু পানিতে ডুবে যায় সড়কটি। মনোয়ার নামের আরামবাগের এক বাসিন্দা জনকণ্ঠ ’ কে বলেন , ‘ এটাই ঢাকা শহরের সবচেয়ে নিচু সড়ক। বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হবেই। রাস্তাটি প্রায় হাঁটু পানিতে ডুবে যায়। অথচ এই সড়কে কিছুদিন আগে ড্রেনেজ লাইন সংস্কার করে বড় বড় পাইপ বসানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজে আসেনি। ’
এ ছাড়া মিরপুর - ১ নম্বরে চাইনিজের সামনে , মিরপুর - ১৪ নম্বর , মিরপুর - ২ নম্বরে কমার্স কলেজ সড়কে , শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়ায় , মোহাম্মদপুর , মগবাজারের মধুবাগ , মিরপুর - ১০ থেকে খামারবাড়ি সড়কের বিভিন্ন জায়গায় , ঝিগাতলা , মোহাম্মদপুর এবং মিরপুর রোডের ধানমন্ডি - ২৭ নম্বর মোড়ে পানি জমে যায়। এসব এলাকায় কোথাও গোড়ালি আবার কোথাও হাঁটু সমান পানি জমে। তবে জলাবদ্ধতা আগের মতো দীর্ঘ সময় থাকে না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সড়কের পানি নেমে যায় বলে স্থানীয়রা জানান।
হারিয়ে গেছে ঢাকার ১৭ শতাংশের বেশি জলাশয় ॥ বিশেষজ্ঞদের মতে , জলাবদ্ধতা নিরসনে ইতোমধ্যে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে , সেগুলোও সুপরিকল্পিতভাবে হয়নি। বিশেষ করে যথাযথভাবে হয়নি ড্রেনেজ , খাল ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। আর বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পাদনে সিটি করপোরেশন এবং সরকারের অন্য সংস্থার মধ্যে ছিল না তেমন কোনো সমন্বয়ও। ফলে জলাবদ্ধতার জন্য একে অন্যকে দায়ী করেই বছর পার করছে সংস্থাগুলো। তবে সুযোগ পেলেই মোটা অঙ্কের একাধিক প্রকল্প নেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী সংশ্লিষ্টরা। সমস্যার সমাধান হচ্ছে কি না সেদিকে নজর নেই তাদের। বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের ওপর তাগিদ দিয়ে প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জলাশয় ভরাট হয়ে গত ২৮ বছরে ঢাকার ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ জলাশয় এলাকা হারিয়ে গেছে। ১৯২৪ সালে পুরান ঢাকায় ১২০টি পুকুর ছিল। বর্তমানে আছে মাত্র ২৪টি। তাও ভরাট ও দূষণের শিকার। গত ১০০ বছরে পুরান ঢাকার ৯৬ পুকুর হারিয়ে গেছে বলে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স ( বিআইপি ) ।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান জনকণ্ঠ ’ কে বলেন , ‘ শুধু প্রকল্পের মাধ্যমে টাকার অঙ্ক বাড়ালেই জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না। খাল সংস্কার , ড্রেনেজ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ করার পর তা মনিটরিং ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। কিন্তু সিটি করপোরেশন কাজ শেষ হওয়ার পর তা আর রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে খাল ও ড্রেনের মুখ আবার ভরাট হয়ে যায়। ’ তাই কাজ বাস্তবায়নের পর রক্ষণাবেক্ষণ ও জবাবদিহিতা থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল ডিএনসিসি ’ র ॥ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ( ডিএনসিসি ) আওতাধীন এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসন , ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মশক নিধন কার্যক্রম ও সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ডিএনসিসি ’ র সংশ্লিষ্ট বিভাগ / শাখাসমূহের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা / কর্মচারীসহ মাস্টাররোল শ্রমিকদের ছুটি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছে। সোমবার নগর ভবনে এক জরুরি সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে একটি অফিস আদেশ জারি করা হয়।
এ বিষয়ে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন , ‘ বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ডেঙ্গু যাতে কোনোভাবে শহরে ছড়িয়ে না পড়ে তাই সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। জমে থাকা পানিতে এডিস মশার জন্ম হয়। বাসার ভেতরে , ছাদে ও বারান্দায় কোথাও কোনো পাত্রে যেন পানি না জমে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া টানা ভারি বৃষ্টির কারণে শহরে অনেক জায়গায় পানি জমে। দ্রুত সময়ে জলাবদ্ধতা নিরসন করে জনগণকে স্বস্তি দিতে কর্মীদের সার্বক্ষণিক মাঠে থাকার নির্দেশ দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট সকলের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ , পলিথিনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ড্রেনে ফেলবেন না। এগুলো ড্রেনে ফেলায় ব্লক হয়ে পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়। সবাই সচেতন হলে কাজটা আমাদের কর্মীদের জন্য সহজ হয়ে যায়। ’
Published on: 2023-07-04 19:08:27.49274 +0200 CEST
------------ Previous News ------------