দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের তৎপরতা বাড়ছে। একটি মহল চাচ্ছে বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা প্রয়োজন তা করতে। আবার বিভিন্ন কারণে বর্তমান সরকারের ওপর নাখোশ এমন একটি মহল চাচ্ছে যে কোনোভাবে এ সরকারের ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকাতে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) চাচ্ছে আইনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে সবাইকে আস্থায় নিয়ে সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থা করতে। ইসির এ অবস্থানের পক্ষেও কোনো কোনো মহল কাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে পর্দার অন্তরালে কি হচ্ছে তা জানতে জনমনে কৌতূহলের শেষ নেই। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের বিষয়টিও ফের আলোচনায় স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকারের ভালো চান এমন দেশী-বিদেশী মহল বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন করতে যা যা প্রয়োজন তা করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে তাগিদ দিচ্ছে।
এ কারণে সরকার কঠোর অবস্থানে না গিয়ে এখন বিএনপিসহ রাজপথের বিরোধী দলগুলোকে অবাধে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে। আবার বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে নির্বাচনের পক্ষে যারা কাজ করছেন, তাদের পরামর্শে বিএনপি এখন রাজপথের কঠোর আন্দোলনের অবস্থান থেকে সরে কিছুটা নমনীয় হয়েছে। আর যারা কোনো অবস্থাতেই বর্তমান সরকারকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না তারা বিএনপিসহ রাজপথের বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনের আগেই কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকতে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। তারা মনে করছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে প্রয়োজনে দেশে জরুরি অবস্থা আসলেও সমস্যা নেই।
দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন চাচ্ছে বিদ্যমান আইনে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে সবাইকে আস্থায় নিয়ে সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থা করতে। এজন্য সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা যায় সেজন্য গাইডলাইন চেয়েছেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতে অতীতে নির্বাচনের বিষয়ে এভাবে গাইডলাইন চাইতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাক্ষাতের নজির রয়েছে বলে জানা যায়।
এদিকে জাতীয় নির্বাচনকে সমনে রেখে রাজনীতিতে ফের সংলাপের বিষয়টি আলোচনায় স্থান পেয়েছে। দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের বিষয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিভিন্ন মহল এ দুটি দলের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। পর্দার অন্তরালে থেকে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল দুই দলকে এক টেবিলে বসানোর চেষ্টা করছে। তাদের মতে এক টেবিলে বসানো গেলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। আর তা করা গেলে বড় দুই দল এবং দেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্যই মঙ্গল।
ঢাকায় অবস্থানরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের সঙ্গে মঙ্গলবার বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালও সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ প্রয়োজন। তাই ইসি প্রত্যাশা করে রাজনৈতিক পরিম-লে কতগুলো বিষয় নিয়ে যে সংকট রয়েছে, সেগুলো যে কোনো মূল্যে সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। আমরা চাই রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক। যে স্থিতিশীল পরিবেশে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। আমরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকেও এ বিষয়টি বলেছি। ওনারাও বিশ্বাস করেন, সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ প্রয়োজন। সংলাপ ছাড়া সংকট আসলে রাজপথে মীমাংসা করার বিষয় নয়। তবে এটা নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। তাই নির্বাচন কমিশন এই সংলাপ আয়োজন করতে পারবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদেরই নিজেদের মধ্যে সংলাপ আয়োজন করতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবার বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসবে কি আসবে না এমন জল্পনা-কল্পনার মধ্যে মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক শেষে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে জানান, নির্বাচনী পরিবেশ দেখতে অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক পর্যবেক্ষক টিম বাংলাদেশে আসবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রত্যাশা করে। এর আগে ৮ জুন সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।
তখন তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। সেই নির্বাচনে কে বিজয়ী হবে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা নেই। এর আগে মার্কিন একটি প্রতিনিধি দলও ঢাকা সফরে এসে নির্বাচন কমিশন ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করেন। তখন তারা জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না তা তারা দেশে গিয়ে রিপোর্ট করার পর সিদ্ধান্ত হবে। সেই রিপোর্ট ইতিবাচক হওয়ার পর মঙ্গলবার ঢাকায় কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে অক্টোবরে প্রাক-পর্যবেক্ষক দল আসার কথা জানিয়েছেন।
সূত্র মতে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজ নিজ অবস্থানে থাকায় নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর দেশী-বিদেশী চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে। আর এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মেকানিজমের পাশাপাশি নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য সংলাপের বিষয়টিও বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে পর্দার অন্তরালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সংলাপে বসাতে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রয়েছে। আর কোনো কারণে একসঙ্গে বসাতে না পারলেও তাদের বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধকরণের চেষ্টা করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চেষ্টা করছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ অনুসারে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ অথবা আগামী বছর জানুয়ারি মাসের শুরুতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন, অক্টোবরের শেষ দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে বিএনপি প্রকাশ্যে সবসময়ই বলছে। আবার তারা তলে তলে নির্বাচনের প্রস্তুতিও চালিয়ে যাচ্ছে। প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়াও শুরু করেছে। লন্ডনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে ৩০০ আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের একটি তালিকাও রয়েছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে গেলেও শেষ মুহূর্তে সরকারের সঙ্গে কোনোভাবে সমঝোতা হলে তারা নির্বাচনে যেতেও পারে। আর এ দলটি যাতে নির্বাচনে যায় সে জন্য বিভিন্ন মহলের দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ পর্যন্ত দেশে যত বিদেশী প্রতিনিধি দল ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক এসেছেন, তারা কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেননি। আর সংবিধানের বাইরে গিয়ে এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ারও তাদের নেই। অবশ্য কোনো কোনো বিদেশী পর্যবেক্ষক তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে না থাকায় এ পদ্ধতিতে নির্বাচন এখন অবৈধ বলেও মন্তব্য করেছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত একটি দেশের প্রতিনিধি দল যৌথভাবে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায়ই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন সবসময়ই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে। এজন্য তারা দেশের সকল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসহ সর্বস্তরের অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করেছেন। যদিও এ সংলাপে যায়নি বিএনপিসহ সমমনা ১২টি রাজনৈতিক দল। তবে আওয়ামী লীগসহ ২৭টি দল সংলাপে অংশ নিয়ে ইসির প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছে। তবে নির্বাচন কমিশন আশা করছে বিএনপি গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনে যাবে। এজন্য বিএনপি যদি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলতে চায় বা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কোনো প্রস্তাব দিতে চায় তা বিবেচনা করে দেখা হবে বলেও ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইসির সঙ্গে বৈঠক করে আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম (ইএমএফ)। বৈঠকের পর ইএমএফ সদস্য এবং নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঝালানাথ খানাল বলেন, আমরা আশা করি, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন পক্ষপাতহীন ও শান্তিপূর্ণভাবে হবে এবং সব নাগরিক তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। এর আগে-পরে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরাও ইসির সঙ্গে বৈঠক করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করতে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি জানতে চায়। সব দলকে নির্বাচনে আনতে ইসির করণীয় জানতে চায়। এ ছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। তাই সবকিছু বিবেচনা করে ইসি চাচ্ছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন করতে যা যা করণীয় তা করতে। এজন্য সিইসি প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
Published on: 2023-08-01 19:10:38.550761 +0200 CEST
------------ Previous News ------------