মুষলধারে ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় বৃহত্তর চট্টগ্রামে জলজট ও পাহাড়ি ঢলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। বান্দরবানের পর চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে মঙ্গলবার থেকে। পাহাড়ি ঢলের তোড়ে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, পেকুয়া, চকরিয়া, বান্দরবান, বাঁশখালীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের শত শত গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। পাহাড়ি ঢলে বাড়িঘর, মৎস্য ঘের সর্বত্র পানিতে সয়লাব। পানিবন্দি হওয়ায় চরম দুর্ভোগে লাখ লাখ মানুষ।
রাউজান, লোহাগাড়া ও বান্দরবানে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। বান্দরবান, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া এবং পেকুয়ায় উদ্ধার কাজে সেনা ও নৌবাহিনী নামানো হয়েছে। চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতিতে দুর্গতদের সহায়তায় সেনা মোতায়েন ও নৌবাহিনীর সদস্যদের নিয়োজিত করা হয়েছে। আইএসপিআর জানিয়েছে, পেকুয়ায় অতি বৃষ্টিতে প্লাবিত পানিবন্দি দুর্গতদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বোটসহ নৌকন্টিনজেন্ট প্রেরণ ও জরুরি খাদ্য সহায়তায় নৌবাহিনী কাজ করছে। এদিকে মঙ্গলবার পঞ্চম দিনের মতো ভারি বর্ষণে চট্টগ্রাম মহানগরীর নি¤œাঞ্চলে ব্যাপক জলজট সৃষ্টি হয়ে আছে। নগরীর বহদ্দারহাট, বাকলিয়া, চান্দগাঁও, মুরাদপুর, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ, ষোলশহরসহ সন্নিহিত অঞ্চলগুলোতে একদিকে ভারি বর্ষণ, অপরদিকে জোয়ারের কারণে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে রয়েছে। জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
মঙ্গলবার স্কুল, কলেজ একদিন বন্ধ রাখার পর চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড হতে বুধ ও বৃহস্পতিবার দুদিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সকল ক্লাস পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে। ভারি বর্ষণে চট্টগ্রাম মহানগরীর পর দক্ষিণ চট্টগ্রামে এবং বান্দরবানের পাহাড়ি ঢলে একাকার হয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকে চকরিয়া পর্যন্ত আরাকান সড়ক ডুবে গিয়ে যেন এক মহাসমুদ্রে রূপ নিয়েছে। বান্দরবানে পাহাড় ধস হয়েছে। ঢলের পানিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও কক্সবাজারের চকরিয়া এবং পেকুয়া এলাকা। সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার সংসদ সদস্য আবু রেজা মোহাম্মদ নদভীর আহ্বানে সাতকানিয়া, লোহাগাড়ায় উদ্ধার কাজে সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে। অপরদিকে ভারি বর্ষণে পেকুয়া উপজেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। দুর্গতদের উদ্ধার কাজে নৌবাহিনীর একটি কন্টিনজেন্ট কাজ শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ॥ মঙ্গলবার সকালে আবারও বর্ষণ হয়েছে। তবে দুপুরের পর থেকে পানি সরে গিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু টানা কয়েকদিনের বর্ষণে জনজীবনে যে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয় তা সীমাহীন। ভারি বর্ষণের কারণে মাটি নরম হয়ে যাওয়ায় বায়েজিদ লিংক রোডে আংশিক পাহাড়ধস হয়েছে। ফলে ওই সড়কে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া নগরীর নি¤œাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি সরে যেতে শুরু করেছে। অবস্থা ইতিপূর্বেকার চেয়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে আবহাওয়া দপ্তর থেকে আরও বর্ষণের পূর্বাভাস থাকায় শঙ্কা পুরোপুরিভাবে কাটেনি। আশা করা হচ্ছে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটবে। কয়েকদিনের ভারি বর্ষণে নগর জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে এসেছে তা অবর্ণনীয়।
এদিকে সোমবার বিকেলে লোহাগাড়ায় বন্যার পানিতে ডুবে আসহাব মিয়া (৬৫) নামে এক কৃষক নিখোঁজ হলেও তার সন্ধান মেলেনি। নিখোঁজ আসহাব মিয়া আমিরাবাদের বাসিন্দা। পদুয়া বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন। আশপাশের সকল এলাকায় তার খোঁজে তল্লাশি চালানো হলেও তার কোনো সন্ধান পায়নি প্রশাসন। অন্যদিকে চট্টগ্রামের রাউজানে উরকিরচরে শাহেদ হোসেন বাবু (৩৫) নামে এক খামারি নৌকায় উঠার সময় পা পিছলে পড়ে ডুবে মারা গেছেন। সোমবার সন্ধ্যায় হালদা নদী ও শাখা খালের সংযোগস্থলে এ ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রামের সঙ্গে বান্দরবান ও কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ ॥ কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সাতকানিয়ার কেরানিহাট থেকে চন্দনাইশের হাশিমপুর পর্যন্ত সড়ক ডুবে গেছে। যার ফলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সরাসরি বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে চন্দনাইশ থেকে। রাত ৩টার পর থেকে যান চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। মঙ্গলবার সকাল থেকেই সাতকানিয়া কেরানিহাট অংশে গোলচত্বরে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।
বাঁশখালী থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, শুক্রবার রাত থেকে ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দি হয়ে পড়ছে উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার মানুষজন। ৫ দিনের ভারি বর্ষণে ও পাহাড়ি ঢলে ভাসছে বাঁশখালী। প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
চন্দনাইশ সংবাদদাতা জানিয়েছেন, টানা বৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ঢল নেমে চন্দনাইশের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে পাহাড়ি ঢল শঙ্খ নদীতে বিকট সীমানার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উপজেলার শঙ্খ তীরবর্তী ধোপাছড়ি দোহাজারী পৌরসভা, বৈলতলী, সাতবাড়িয়া, বরকল, বরমার সিংহভাগ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বান্দরবান ॥ বান্দরবানে পাহাড়ি ঢল ও সাঙ্গু নদীর পানি বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশ করায় পাহাড়ধস ও পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলাটি। সাঙ্গু নদীর বান্দরবান শহর পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেক জায়গায় পাহাড়ধস হয়েছে। জেলা থেকে বন্ধ হয়ে গেছে দূরপাল্লা ও উপজেলা শহরের যানবাহন চলাচল। বিভিন্ন জায়গায় মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে।
উদ্ধার তৎপরতায় সেনা ও নৌবাহিনী মোতায়েন ॥ চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীর কার্যক্রম অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে আইএসপিআর। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর মঙ্গলবার জানিয়েছে, সেনা সদস্যের মাধ্যমে নিরলসভাবে উদ্ধার তৎপরতা, জরুরি ত্রাণ পরিচালনা ও চিকিৎসা সহায়তা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সেনাবাহিনীর অন্যান্য ফরমেশনসমূহ দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে এবং অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সদা প্রস্তুত রয়েছে।
খাগড়াছড়ি থেকে পার্বত্যাঞ্চল প্রতিনিধি জানান, দীঘিনালায় মাইনী নদী পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাবিত হয়েছে নিচু এলাকা। মেরুং ইউনিয়নে বেইলি ব্রিজ ডুবে যাওয়ায় খাগড়াছড়ির সঙ্গে রাঙ্গামাটি লংগদুর ও বাঘাইছড়ি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। পানিবন্দি হয়েছে মেরুং ও কবাখালি ইউনিয়নের অন্তত ৬ শতাধিক পরিবার। এরই মধ্যে আশ্রয় কেন্দ্রে দুই শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া পাহাড়ের মাটি ধসের কারণে দীঘিনালার সঙ্গে বাঘাইছড়ি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
রাঙ্গামাটি থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি জানান, ভারি বর্ষণে সড়ক ও বসতবাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কয়েকদিন ধরে ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বাঘাইছড়ি ও লংগদুর উপজেলার নি¤œাঞ্চল ডুবে গেছে। বর্ষণে ধসে পড়ছে পাহাড়। পাহাড়ি ঢলে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
ঝালকাঠি ॥ নগর বন্যায় নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ঝালকাঠি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঝালকাঠি পৌরসভার কয়েক হাজার নাগরিককে চরম দুর্ভোগে পোহাতে হচ্ছে। অতি ও টানা বৃষ্টির কারণে শহরের ৯০ ভাগ সড়ক পানিতে তলিয়েছে।
পটুয়াখালী ॥ বিরামহীন ভারি বর্ষণে কলাপাড়ায় পানিতে তলিয়ে গেছে আমন বীজতলা। ডুবে গেছে বর্ষাকালীন সবজির খেত। শত শত পরিবারের বাড়িঘরে পর্যন্ত পানি ঢুকেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ২০ হাজার পরিবার। মানুষের এ কারণে ভোগান্তি চরমে।
নওগাঁ ॥ টানা বৃষ্টিতে বিপাকে পড়েছে নওগাঁর খেটে খাওয়া মানুষগুলো। একটানা রিমঝিম বৃষ্টি চলছে, যেন থামার কথা নেই। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষরা পড়েছেন বেশি বেকায়দায়।
মানিকগঞ্জ ॥ সামান্য ৫ মিনিটের বৃষ্টিতে ঘিওর হাটসহ উপজেলা সদরে ৭/৮টি স্থানে জলাবদ্ধতার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে ক্রেতা-বিক্রেতাসহ হাজারো মানুষের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। খানাখন্দে ভরা সড়ক, নালা ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে দিনের পর দিন।
ফেনী ॥ ফুলগাজী, পরশুরামের মুহুরী ও কুহুয়া নদীর তিনটি স্থানে ভাঙনে ১১টি গ্রামের প্লাবিত অঞ্চলগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। মঙ্গলবার সকালে মুহুরী নদীর পানি পরশুরাম পয়েন্টে বিপৎসীমার সাত সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ভাঙনে স্থান দিয়ে বানের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
Published on: 2023-08-08 19:13:21.963535 +0200 CEST
------------ Previous News ------------