দৈনিক জনকণ্ঠ
বন্ধুত্বের নবদিগন্ত

বন্ধুত্বের নবদিগন্ত

৩৩ বছর পর কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ঐতিহাসিক ঢাকা সফর শেষ করলেন। ম্যাক্রোঁর চলতি সফরে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। দুই দেশের শীর্ষ নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের সার্বভৌম নীতি ও স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন প্রকাশ করেছে ফ্রান্স। বিশেষ করে চলমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে। অপরদিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, ফরাসি উড়োজাহাজ নির্মাণ সংস্থার তৈরি নতুন ১০টি এয়ারবাস কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ঢাকা। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এক যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ে শেখ হাসিনা ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা উভয়েই আশা করি বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে এই নতুন কৌশলগত পদক্ষেপ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, আমার পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে যে বন্ধুত্বপূর্ণ বন্ধনের সূচনা করেছিলেন তা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। শেখ হাসিনা তাঁর বিবৃতিতে বলেন, আজ ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক দিন যা পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বিকশিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দ্বিপক্ষীয় সমগ্র বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, ফ্রান্স বাংলাদেশের সার্বভৌম নীতি, স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন প্রকাশ করেছে, বিশেষ করে চলমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে। তিনি বলেন, আমরা উভয়েই আশা করি বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে এই নতুন কৌশলগত পদক্ষেপ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তিনি আরও বলেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা, উন্নয়ন ও সুশাসনের ওপর ভিত্তি করে এই নতুন সম্পর্কের ভিত রচিত হয়। তিনি বলেন, ফ্রান্স সরকার জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কর্মকা-ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির দর্শনীয় ও ধারাবাহিক অগ্রগতিতে ফরাসি সরকারের আস্থা ও প্রশংসা ব্যক্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিএসপি প্লাস প্রকল্পের অধীনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য সুবিধা বাংলাদেশের জন্য অব্যাহত রেখে ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে ফ্রান্স। তিনি বলেন, তাই বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বে ফ্রান্স সরকার ও ফ্রান্সের জনগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। বৈঠকে তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতির লক্ষ্যে তারা বিশদ আলোচনা করেছেন এবং ‘আমরা কিছু ঐকমত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি।’ বাংলাদেশের বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে শেখ হাসিনা বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নে ফ্রান্স আমাদের অব্যাহত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। তিনি বলেন, তারা বাংলাদেশের কৌশলগত নিরাপত্তা অবকাঠামো নির্মাণে উন্নত ও বিশেষায়িত প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় এবং দায়িত্বশীল আবাসিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কাজ করবে। সরকারপ্রধান উল্লেখ করেন, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় ফ্রান্সের নেতৃত্বকে স্বাগত জানাই এবং একটি টেকসই তহবিল গঠনের জন্য প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর আহ্বানের প্রশংসা করি। এ ছাড়া বৈঠকে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিনিময় নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে কার্যকর আলোচনা হয়েছে বলেও জানান শেখ হাসিনা। বৈঠকের শুরুতেই শেখ হাসিনা প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর এবং তাঁর প্রতিনিধিদলের সম্মানিত সদস্যদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে ফ্রান্সের সরকার ও ফ্রান্সের জনগণের প্রতি শুভেচ্ছা জানান এবং দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের আরও সমৃদ্ধি কামনা করেন। অপরদিকে বৈঠক শেষে বিবৃতিতে ম্যাক্রোঁ বলেছেন, ইউরোপীয় মহাকাশ শিল্পে আস্থা রাখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। ‘এ ৩৫০’ মডেলের ১০টি এয়ারবাসের জন্য প্রতিশ্রুতিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফরাসি কর্মকর্তারা জানান, ‘এ ৩৫০’ মডেলের ওয়াইডবডির উড়োজাহাজের জন্য চুক্তিটি চূড়ান্ত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের সঙ্গে। ‘এয়ারবাস এ ৩৫০’ হলো একটি দূরপাল্লার, ওয়াইডবডির ও দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট জেট বিমান। যা এয়ারবাস কোম্পানি নির্মাণ করে থাকে। ৫১ বছরে বাংলাদেশের ২০টিরও বেশি বোয়িং সমৃদ্ধ উড়োজাহাজ রয়েছে। বেশিরভাগই ওয়াইডবডির বিমান। তবে এখনো কিছু ড্যাশ-৮ রয়েছে বহরে। এবার এয়ারবাস কিনতে আগ্রহী বাংলাদেশ সরকার। এর আগে সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ফরাসি প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছলে শেখ হাসিনা টাইগার গেটে ফুলের তোড়া দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। পরে দুই নেতা একান্ত বৈঠকেও মিলিত হন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে শেখ হাসিনা ও ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ একটি ফটো সেশনেও অংশ নেন। দুই নেতার উপস্থিতিতে দুটি চুক্তিও সই হয়। দুই সমঝোতা স্মারক সই ॥ ঢাকা ও প্যারিস অবকাঠামো ও স্যাটেলাইটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে দুটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সোমবার রাজধানীতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের করবী হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর উপস্থিতিতে নথিপত্রে সই করা হয়। চুক্তি দুটি হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং ফ্রান্সের ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (এফডিএ)-এর মধ্যে ‘ইমপ্রুভিং আরবান গভর্নেন্স অ্যান্ড ইনফ্রাস্টাকচার প্রোগ্রাম’- বিষয়ে একটি ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি অ্যাগ্রিমেন্ট এবং  বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) এবং ফ্রান্সের এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস এসএএস- এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু-২ আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম সম্পর্কিত সহযোগিতার বিষয়ে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই)। বাংলাদেশের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান এবং ফ্রান্সের পক্ষে ঢাকায় ফরাসি উন্নয়ন সংস্থার (এএফডি) কান্ট্রি ডিরেক্টর বেনোইট চ্যাসেট চুক্তিতে সই করেন। বাংলাদেশে নগর পরিচালনা ও অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তার জন্য ঋণ সহায়তা চুক্তিটি সই হয়। চুক্তির আগে হাসিনা ও ম্যাক্রোঁ দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র অন্বেষণে আলোচনা করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন ম্যাক্রোঁ ॥ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সোমবার ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তিনি ফরাসি ভাষায় ভিজিটরস বইয়ে লিখেছেন, আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছি, যিনি তার জাতির স্বাধীনতার জন্য, এর ভাষা ও সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য লড়াইয়ে তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, তাঁর পরিবারের যেসব সদস্য তাঁর সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছিলেন, আমি ফরাসি জনগণের পক্ষ থেকে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্ব প্রকাশ করতে চাই। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা ও তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। ঢাকা ছাড়লেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ॥ দুদিনের সফর শেষে ঢাকা ছাড়লেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। সোমবার বিকেল ৩টায় তাঁকে বহনকারী বিমানটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যায়। বিমানবন্দরে তাঁকে বিদায় জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং সাবের হোসেন চৌধুরী। এর আগে রবিবার রাত ৮টায় ভারতে জি-২০ সম্মেলন শেষে দুদিনের সফরে ঢাকায় অবতরণ করেন ম্যাক্রোঁ। রাত সাড়ে ৮টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দরে তাঁকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। এ সময় ম্যাক্রোঁকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। পরে বিমানবন্দর থেকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পৌঁছান তিনি। রাতে ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফরাসি প্রেসিডেন্টের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নৈশভোজ শুরুর আগে চলে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। পরে ম্যাক্রোঁ দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ‘জলের গান’র শিল্পী ও সংগীত পরিচালক রাহুল আনন্দের হোম স্টুডিও পরিদর্শন করেন।
Published on: 2023-09-11 19:30:34.182812 +0200 CEST