পাসপোর্ট ভিসা ও টিকিট ছাড়া এক বালক প্লেনে ওঠার পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার বিষয়টি সামনে এসেছে। এ ব্যাপারে গঠিত হয়েছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় এরই মধ্যে বিমানবন্দরের ১০ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তারপরও চলছে তদন্ত। বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান জানান, দোষীদের বিন্দুুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। কঠোর শাস্তির মুখে পড়তে হবে তাদের। পাশাপাশি বিমানবন্দরের নিরাপত্তার ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাসপোর্ট টিকিট ছাড়া বারো বছরের বালক জোনায়েদের প্লেনে ওঠার অনেক আগেই একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দুর্বলতা ও ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়েছে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তার বিপরীতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরও গত সোমবার রাতে ঘটে গেছে পাসপোর্টবিহীন বালকের প্লেনে চড়ার মতো ঘটনা। ওই ঘটনায় বেবিচক ফের বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। জোনায়েদের প্লেনে চড়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ত্রুটি নিয়ে অনুসন্ধান করে জানা যায়, এগুলো নতুন নয়।
দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ত্রুটির কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এগুলো হচ্ছেÑ বিমানবন্দরে প্রেষণে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা, বিমানবন্দরের অনেক এলাকা সিসিটিভির আওতার বাইরে থাকা, পর্যাপ্ত জনবল আর যন্ত্রপাতির অভাব ও অবকাঠামোগত ত্রুটি। মূলত এই চার কারণেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় ত্রুটি বিদ্যমান। বিমানবন্দরে কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে এ চারটি ক্ষেত্রে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ সম্পর্কে বিমানবন্দরের সাবেক এক পরিচালক নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, এখানে এতগুলো সংস্থা কাজ করে, কেউ কারো ধার ধারে না। যে যেমন পারছে, সেভাবেই কাজ করছে। এজন্য বিমানবন্দরের পরিচালক বা বেবিচকের কাছে খুব একটা জবাবদিহি করতে হয় না। তারা সবাই জবাবদিহির বেলায় মাদার সংস্থাকেই প্রাধান্য দেয়। বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিজ নিজ অফিস স্থাপন করে তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দায়িত্ব পালন করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থাও দায়িত্ব পালন করছে। তারাও বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালকের দপ্তরকে খুব একটা সমীহ করে না।
যদিও বড় ধরনের অপরাধ অনিয়মে জড়ানোর পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে ওই সংস্থার প্রধানের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হয়। ইচ্ছে করলেই বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালকের দপ্তর বা বেবিচক সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এমনকি বেবিচক কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি ইমিগ্রেশন পয়েন্টে যাত্রীদের লাইনে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা চালু করতে গেলে বড় ধরনের বাধার মুখে তা সম্ভব হয়নি। ইমিগ্রেশন জোর গলায় বলেছে, এটা তাদের এরিয়া। তাদের আইনেই চলবে। বেবিচকের কোনো নির্দেশনা বা আইন এখানে চলবে না। এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে সমন্বয় হবে কীভাবে?
এ বিষয়ে সাবেক এই পরিচালক বলেন, বিমানবন্দরে প্রেষণে নিয়োজিত সকল নিরাপত্তা সংস্থা, গোয়েন্দা স্স্থংা ও এয়ারলাইন্স অন্যান্য বাহিনীকে নির্বাহী পরিচালকের অধীনে ইউনিফাইড কমান্ডে আনতে হবে। যাতে সরাসরি তাদেরকে পরিচালকের দপ্তর থেকে নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে রাখা যায়। শাস্তিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। যতদিন পর্যন্ত এ অবস্থায় তাদেরকে এক ছাতার নিচে না আনা যাবে, ততদিন পর্যন্ত এ ধরনের সমন্বয়হীনতা থাকবেই।
দ্বিতীয়ত সিসিটিভির কভারেজ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এখনো সিসিটিভির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ইচ্ছা করেই হোক কিংবা অনিচ্ছাতেই হোক এখনো অনেক এলাকায় সিসিটিভি নেই। যেগুলো আছে সেগুলোতে নেই কোনো কম্বাইন্ড মনিটরিং। এটার বড় উদাহরণ সর্বশেষ ২ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দরের কাস্টমস হলের আওতাধীন মালখানার ভল্ট থেকে ৫৫ কেজি সোনা গায়েব হওয়া। এ ঘটনার পর তোলপাড় শুরু হয়। তখন সিসিটিভির ওপর সবার নজর যায়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ওই ভল্ট থেকে কখন কে, কীভাবে সোনা গায়েব করেছে- তার কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তকারীরা বারবার চেয়েও ফুটেজ পায়নি।
তখন তারা নিশ্চিত হয়, ওই গুদামের আশপাশের ক্যামেরাগুলো কাস্টমসের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে। তারা সেটা তাদের মতোই লাগিয়েছে। তারাই সেটা নষ্ট করেছে। এ সম্পর্কে এভসেক সূত্র জানিয়েছে, বেবিচকের নিজস্ব সিসিটিভি ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন সংস্থার নিজস্ব ক্যামেরা। যে কারণে তারা নিজেরাই সেগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে। কাস্টমস হলের গুদামের ভেতর কিংবা সামনের কোনো ফুটেজ নেই বেবিচকের নিজস্ব ক্যামেরায়। এভাবেই বিমানবন্দরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থান রয়ে গেছে সিসিটিভির কাভারেজের বাইরে। চোরাচালান ও অন্যরা ক্যামেরার আওতাভুক্ত এরিয়াকেই বেছে নেয়।
নিরাপত্তায় ত্রুটির তৃতীয় কারণ, প্রয়োজনীয় জনবল ও যন্ত্রপাতি না থাকা। বিমানবন্দরের প্রতিটি শিফটে ছয় ঘণ্টা করে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে নিরাপত্তাকর্মীদের। বিশেষ করে স্ক্যানার পয়েন্টে আইকাও রুলস অনুযায়ী একজন কর্মী কিছুতেই ২০ মিনিটের বেশি তীক্ষè দৃষ্টিতে চেয়ে থাকার নিয়ম নেই। অথচ শাহজালালে একজনকে স্ক্যানারের সামনে প্রায় পুরো শিফটেই টানা বসে থেকে চোখ দিয়ে দেখতে হয়। যা একজন সুস্থ সবল মানুষের পক্ষেও সম্ভব নয়। বিষয়টি জানা থাকলেও প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে সেটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অবশ্য এ বিষয়ে বেবিচক সিকিউরিটি মেম্বার গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবু মাহমুদ মান্নাফী তা খ-ন করে বলেন, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া আছে যাতে এক ঘণ্টায় ২০ মিনিট পর পর তিনজন ডিউটি করে। যাতে তাদের চোখের পর্যবেক্ষণ ও মনোযোগ থাকে।
এখন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের স্ক্যানারের অভাব আছে কি না সেটা দেখতে হবে।
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব ছাড়াও অবকাঠামোগত দুর্বলতার বিষয়টিও চিহ্নিত করা হয়েছে বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। গত বছরের শেষদিকে গোয়েন্দা সংস্থা, সিভিল এভিয়েশন এবং ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরিপ চালায়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছে ওই জরিপের প্রতিবেদন জমা দেন তারা। গত বছরের এপ্রিল মাসে একই ধরনের আরও একটি জরিপ চালানো হয়েছিল। ওই জরিপে যেসব সুপারিশ করা হয়, তার সামান্য অংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কার্গো ও রপ্তানি এলাকায় অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামের ঘাটতি আছে। তাই এ অঞ্চলগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিমানবন্দরের খুব কাছেই অনেক উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ কারণেও এর নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। আগের জরিপেই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিমানবন্দরে প্রবেশকারী যানবাহন নিচ থেকে স্ক্যান করার জন্য চারটি গেটে ক্যামেরা বসাতে জোরালো সুপারিশ করা হয়েছে। এর আগেও ২০১২ সালে বাউনিয়ার বেড়িবাঁধে মানুষ চলাচল বন্ধ করতে একটি আন্ডারপাস বা সুড়ঙ্গ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রানওয়ে-১৪ থেকে বিমানের ওঠা-নামা দেখতে প্রচুর মানুষ বাউনিয়া অঞ্চলে ভিড় করেন।
এমনকি রাতে সেখানে কিছু লেজার লাইটও ব্যবহার করা হয়। যা চালক, উড়োজাহাজ ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আলোর স্বল্পতাও নিরাপত্তা হুমকি ঘটাচ্ছে বলে পাইলটদের অভিযোগ। ৫৭টি ফ্লাডলাইটের আলো বিমানবন্দরের এক হাজার ২৯৮ একর জায়গার সব এলাকায় পৌঁছায় না। এ ছাড়া এখানে সিসিটিভি কাভারেজও আশানুরূপ নয় এবং কিছু কিছু সিসিটিভি রাতে ভালো কাজ করে না বলে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে কিছু এলাকায় নাইট-ভিশন সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং সেগুলো কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণের সুপারিশ করা হয়েছে। বিমানবন্দরের ভেতরে অনেক ঝোপ আছে- যা নিরাপত্তা কর্মীদের দৃষ্টিসীমায় বাধা তৈরি করে। এগুলো নির্দিষ্ট সময় পরপর ছাঁটাইয়ের সুপারিশ করা হয়েছে।
নিরাপত্তা ঘাটতির এ চারটি কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সদস্য (নিরাপত্তা)
গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবু মাহমুদ মান্নাফী দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, বিমানবন্দরে কর্মরত সব এজেন্সিকে একটা ইউনিফাইড কমান্ডে আনার কোনো বিকল্প নেই। এটা বাস্তবায়ন কঠিন হলেও করতে হবে। সবার মানসিকতায় পরিবর্তন হতে হবে। যেমন ইমিগ্রেশনে আমরা কিউ সিস্টেম চালু করতে পারিনি। তারা বলছে ইমিগ্রেশন চলবে ইমিগ্রেশনের আইনে। দুৃনিয়ার সব এয়ারপোর্টে প্রতিটি যাত্রীকেই পাসপোর্ট ভিসা টিকিট চেক করে তবে ছাড়ে। কিন্তু যারা সেদিন দায়িত্বে ছিল তারা যদি সবাই নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় নিয়ে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রতিটি যাত্রীর পাসপোর্ট ভিসা চেক করত তাহলে জোনায়েদের মতো শিশু প্লেনে উঠতে পারত না।
বিমানবন্দরের গোটা এলাকাকে সিসিটিভির আওতায় আনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে অনেক এরিয়া ছিল আওতার বাইরে। পরে জাইকার অর্থায়নে ৪৮৬টি ক্যামেরা সংযুক্ত করা হয়েছে। এমনকি দূরে প্লেন পার্কিং করার স্থান পর্যন্ত সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে যাতে চোরাচালানীদের চেক দেওয়া যায়। আমি নিজে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছি। তারপরেও যদি কোনো এরিয়া বাদ থেকে থাকে সেটা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ সংস্থাগুলো যতই আপত্তি করুক নিরাপত্তার স্বার্থে বেবিচক যা প্রয়োজন তাই করতে পারে। এখন সেটাই করা হবে।
Published on: 2023-09-16 19:23:22.719956 +0200 CEST
------------ Previous News ------------