আজকের আধুনিক কৃষির মতো আদিম শস্যেও দারুণ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। হাজার হাজার বছর আগে এ অঞ্চলে বিচিত্র শস্যের আবাদ হতো। নরসিংদীর আদি ঐতিহাসিক দুর্গনগরী উয়ারী-বটেশ^রের মাটি পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে ২ হাজার ৪০০ বছর আগে চাষ করা আদিম ধান।
দেশে প্রথমবারের মতো শুরু হওয়া আদিম শস্য গবেষণায় ওঠে এসেছে চমকিত হওয়ার মতো এসব তথ্য। প্রকাশিত জরিপ বা প্রচলিত গবেষণাপত্র থেকে নয়, বিদেশে উন্নত ল্যাবরেটরিতে চলমান বিজ্ঞাননির্ভর মৌলিক এই গবেষণার নানা পর্যায়ে অনবরত খোঁজখবর করে এসব তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আদিম শস্য গবেষণা যুগে প্রবেশ এবং আদিম শস্য আবিষ্কারÑ বাংলাদেশের ইতিহাসে এ দুটোই নতুন ঘটনা। এর আগে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে রাজা বাদশাহদের ইতিহাসই মূলত আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্নস্থানে থাকা আদিম শস্য সম্পর্কে কারও তেমন কোনো ধারণা ছিল না। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শস্যদানা হাজার হাজার বছর ধরে মাটির নিচে থেকে যেতে পারে- সাধারণ মানুষের পক্ষে এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। অনেক প্রতœতত্ত্ববিদের মধ্যেও এ বিষয়ে অস্পষ্টতা ছিল। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর আগে শুরু হওয়া আদিম শস্য গবেষণা বিগত দিনের অনেক হিসাব-নিকাশ সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে।
দেশী-বিদেশী প্রতœউদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাটিতে তিন অবস্থায় থেকে যেতে পারে আদিম শস্য। কোনো কারণে আগুনে পুড়ে কার্বনাইজড হয়ে যাওয়া, জলাবদ্ধ অবস্থায় আটকা পড়া অথবা শুকনো অবস্থায় মাটির নিচে চাপা পড়া শস্যদানার অস্তিত্ব সহজে বিলীন হয় না। ‘এক্সিডেন্টালি প্রিজার্ভড’ এসব শস্যই আদিম শস্য। গবেষণার প্রয়োজনে প্রথমে প্রতœস্থান থেকে মাটি সংগ্রহ করা হয়, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার মাধ্যমে মাটি থেকে উদ্ভিজ্জ উপাদান আলাদা করা হয়। দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় শনাক্ত করা হয় শস্যের জাত। অধিকতর গবেষণার মাধ্যমে এসব শস্যদানা বা বীজের বয়স, চাষ পদ্ধতি এবং সেই সময়ের প্রকৃতি পরিবেশ জলবায়ু সম্পর্কেও নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়। অতীতের দুর্লভ তথ্য উপাত্ত কাজে লাগিয়ে বর্তমানের কৃষিতে বিপুল উন্নতি করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি কৃষির ইতিহাস জানা গেলে জানা যায় মানুষের ইতিহাস সমাজ এবং সংস্কৃতি সম্পর্কেও।
তবে প্রতœস্থানের মাটি থেকে আদিম শস্য আলাদা করার কাজটি অনেক জটিল। অতীতের বিভিন্ন গবেষণার সূত্রে জানা যায়, ৯৯.৯ ভাগ শস্যদানাই খালি চোখে দেখা যায় না। মাটির সঙ্গে একদমই মিশে থাকে। সরাসরি সংগ্রহ করা তাই অসম্ভব হয়ে যায়। তা ছাড়া প্রতœস্থানে দীর্ঘকাল ধরে থাকার কারণে শস্যদানার আকার আকৃতি অনেক ক্ষেত্রে বিকৃত হয়ে যায়। শস্য পরীক্ষা করার জন্যও অত্যন্ত উন্নত ল্যাবের প্রয়োজন হয়, যা অল্প কিছু দেশে আছে। এসব কারণে সারা দুনিয়াতেই প্রতœউদ্ভিদ গবেষণা অত্যন্ত সীমিত। বাংলাদেশেও এতকাল শুধু নগরসভ্যতার ইতিহাস অনুসন্ধান করা হয়েছে। নগরসভ্যতার আগের, অর্থাৎ কৃষির বা সংগ্রহের ইতিহাস ছিল অনাবিষ্কৃত।
এ অবস্থায় ২০০০ সালে বহুল আলোচিত প্রতœস্থান উয়ারী-বটেশ^রে খনন কাজের সূচনা হয়। দেশের স্বনামধন্য প্রতœত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের এক দল শিক্ষার্থী এ কাজে অংশ নেন। কয়েক দফা উৎখননে পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণ প্রতœনিদর্শন, বিষয়টি সে সময় বড় আলোড়ন তুলে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালে উয়ারী-বটেশ্বরে গর্তবসতি আবিষ্কৃত হওয়ার কথা জানা যায়।
সম্প্রতি সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘উয়ারী-বটেশ^র এলাকায় গর্তবসতি আবিষ্কারের পর আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে যে, সে সময় আসলে কেমন আবহাওয়া ছিল যে কারণে মানুষ গর্ত করে সেখানে বসতি গড়ে তুলেছিল? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমরা বুঝতে পারি আমাদের প্রচলিত প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণায় এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর বের করা সম্ভব নয়। তখন উপযুক্ত বিবেচনায় প্রতœউদ্ভিদ গবেষণার কথা ভাবা শুরু হয়।’
তিনি জানান, উৎখনন কাজে অংশ নেওয়া তারই এক শিক্ষার্থী পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। মো. মিজানুর রহমান নামের ওই শিক্ষক উয়ারী-বটেশ^রের মাটি নিয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। তার মতো করে কাজ শুরু করেন তিনি। ক্রমে মিজানুর রহমানের হাত ধরেই দেশে প্রতœউদ্ভিদ গবেষণার সূচনা হয়। এখন পর্যন্ত মিজান একাই প্রতœউদ্ভিদ গবেষণায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন বলে জানান তার শিক্ষক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।
বর্তমানে মিজানুর রহমান বিদেশে বাংলাদেশের আদিম শস্য নিয়ে উচ্চতর গবেষণার কাজ করছেন। বাইরে যাওয়ার পূর্বে তার সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেন এই প্রতিবেদক। আদিম শস্য নিয়ে গবেষণা শুরু প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে আর্কিওবোটানি নিয়ে টুকটাক লেখাপড়া শুরু করি আমি। তখন মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে। অবসর সময়। প্রতœউদ্ভিদ চর্চায় আগ্রহ থাকায় এ সংক্রান্ত বই পুস্তক সংগ্রহ করা শুরু করি। ইন্টারনেটে খোঁজখবর নেই। এভাবে আগ্রহ বাড়তে থাকে। শিক্ষকতা পেশায় আসার পর কাজটিকে আরও সিরিয়াসলি নেওয়ার সুযোগ হয় আমার।’
জানা যায়, মিজানুর রহমান পরে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে যান। ল্যাবরেটরি অব আর্কিওবোটানি অ্যান্ড প্যালিও ইকোলোজিতে প্রাচীন বীজ শনাক্তকরণের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেখানে প্রখ্যাত প্রতœউদ্ভিদ বিজ্ঞানী ডোরিয়ান ফুলারের সংসর্গে আসার সুযোগ হয় তার। মিজানের প্রশিক্ষক ছিলেন ফুলার। তার তত্ত্বাবধানে ওই ল্যাবরেটরিতে উয়ারী-বটেশ্বর থেকে সংগৃহীত কিছু নমুনা পরীক্ষা করেন মিজান। স্ক্যানিং ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে প্রতিটি বীজের খুটিনাটি বিশ্লেষণ করে তিনি জানান, উয়ারী-বটেশ^রের মাটিতে পাওয়া গেছে আদিম ধানের অস্তিত্ব। সেইসঙ্গে আরও কিছু শস্য ও উদ্ভিজ্জ উপাদানের প্রতœতাত্ত্বিক প্রমাণ হাজির করেন গবেষক।
দ্বিতীয় ধাপের কাজের প্রস্তুতির জন্য ২০১৪ সালে পুনরায় ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজিতে যান তিনি। সেখান থেকে ফাইটোলিথ প্রসেসিংয়ের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে পরিবেশ প্রতœতত্ত্ব বিষয়ে ডিস্টিংশনসহ এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর দেশে ফিরে কিছুদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ড. ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণাগারে কাজ করেন তিনি। পরবর্তীতে উন্নত ল্যাব সুবিধার কথা ভেবে যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে বেটা অ্যানালিটিক রেডিওকার্বন ডেটিং ল্যাবরেটরিতে আদিম ধান পরীক্ষা করেন। তখন প্রাথমিক পর্যায়ে (বছর তিনেক আগে) উয়ারী-বটেশ্বরে পাওয়া ধানের বয়স আড়াই হাজার হতে পারে বলে জানিয়েছিলেন মিজান। তবে সম্পূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সামনে আসে সুনির্দিষ্ট তথ্য। মিজান জানান, উয়ারী-বটেশ^রে পাওয়া ধানের বয়স ২ হাজার ৪০০ বছর হতে ২ হাজার ৩৫৫ (ক্যালিব্রেটেড) বছর!
এ বিষয়ে আরেকটু পরিষ্কার হতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘মানুষ যেমন অক্সিজেন গ্রহণ করে তেমনি সকল জীব, এমনকি গাছপালাও জীবিত অবস্থায় এক ধরনের কার্বন গ্রহণ করে থাকে। মৃত্যুর পর একইভাবে সেই কার্বন বের হয়ে যেতে থাকে। শস্যদানা কত বছর ধরে কার্বন বর্জন করছে তা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে এর বয়স ইত্যাদি বলে দেওয়া সম্ভব হয়।’ কার্বন ফোরটিন নামের এই পরীক্ষার মাধ্যমেই উয়ারী-বটেশ^রে পাওয়া ধানের বয়স নির্ণয় করা হয়েছে বলে জানান গবেষক।
এদিকে দেশে আর কোনো প্রতœউদ্ভিদ গবেষক না থাকায় নতুন এ গবেষণা সম্পর্কে মূল্যায়ন জানতে যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত প্রতœউদ্ভিদ বিজ্ঞানী ডোরিয়ান ফুলারের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। লিখিত এক পত্রে বাংলাদেশে শুরু হওয়া প্রতœউদ্ভিদ গবেষণার প্রশংসা করেন তিনি। অধ্যাপক ফুলার বলেন, ‘আদিম শস্য গবেষণা আমাদের সামনে একবারে সরাসরি এবং বৈজ্ঞানিক তথ্য হাজির করে থাকে। এর ফলে আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারি কীভাবে কৃষির ইতিহাস বিবর্তিত হয়েছে এবং এর ফল আসলে কী। একই প্রক্রিয়ায় মিজান বাংলাদেশের প্রথম প্রাগৈতিহাসিক শস্য শনাক্ত করেছেন।
বয়সও নির্ণয় করেছেন। তার আবিষ্কৃত শস্যগুলো সত্যিই বাংলাদেশের আদিম শস্যের প্রথম পরীক্ষামূলক বৈজ্ঞানিক প্রমাণ। গত আড়াই হাজার বছরে বাংলাদেশের কৃষি কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় তার গবেষণা থেকে।’ বাংলাদেশের আদিম শস্য গবেষণা কৃষির পাশাপাশি সেই সময়ের মানুষের ইতিহাস জানতে সহায়তা করবে বলেও মন্তব্য করেন ফুলার।
সুফি মোস্তাফিজুর রহমানও দেশে শুরু হওয়া আদিম শস্য গবেষণা নিয়ে ভীষণ আশাবাদী। গবেষণাটি সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবরও রাখেন। সে অভিজ্ঞতা থেকে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রতœতাত্ত্বিক উৎখননে দীর্ঘকাল শুধু রাজা-রানী আর শহর নগরের ইতিহাস আবিষ্কৃত হয়েছে। মিজানের মাধ্যমে এবারই প্রথম আমরা কৃষির ইতিহাস জানতে পারছি। এর আগে শুধু কৃষিপ্রধান দেশের অনুমাননির্ভর গল্প করা হয়েছে। এখন আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে জাতিকে জানাতে পারছি যে, আজ থেকে ২ হাজার ৪০০ বছর আগে আমাদের এখানে ধান চাষ হতো। তার মানে, এ অঞ্চলে মানুষের ইতিহাস আরও পুরনো।’ প্রতœউদ্ভিদ গবেষণার মাধ্যমে সে ইতিহাসও একদিন বের হয়ে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।
আদিম শস্য গবেষণা বিষয়ে সম্পর্কে সরকারি পর্যায়ে কোনো তথ্য আছে কিনা জানতে কথা হয় কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গেও। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমার কিছুটা জানার সুযোগ হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক প্রতœশস্য নিয়ে প্রথমবারের মতো গবেষণা করছেন। এটাতো এক কথায় বিরাট কাজ। মৌলিক এবং বিস্ময়জাগানিয়া অনেক তথ্য ইতোমধ্যে এ গবেষণা থেকে আমরা পেয়েছি। আরও পাব। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সরকারি সংস্থাও কৃষি গবেষণার কাজ করছে।’ তারা এসব তথ্য কাজে লাগিয়ে কৃষির উন্নতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রী।
Published on: 2023-09-19 19:30:36.919295 +0200 CEST
------------ Previous News ------------