যায়যায়দিন
পেঁয়াজে ভারত নির্ভরতায় বড় ঝুঁকি

পেঁয়াজে ভারত নির্ভরতায় বড় ঝুঁকি

পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদার প্রায় ৮০ ভাগ দেশে উৎপাদিত হলেও পর্যাপ্ত সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় এর ২০ থেকে ২২ শতাংশ পচে যায়। ঘাটতি এই ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। যার সিংহভাগে আসে প্রতিবেশি দেশ ভারত থেকে। ফলে সে দেশে কোনো কারণে পেঁয়াজের সংকট দেখা দিলে বাংলাদেশের ভোক্তাদের বড় ধরণের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। গত পাঁচ বছরে অন্ততঃ ৯ দফা এ সংকটের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। অথচ পেঁয়াজ আমদানিতে ভারতের একক নির্ভরতা কমাতে দীর্ঘদিনেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এছাড়া পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংস্পূর্ণতা অর্জন এবং উৎপাদিত পেঁয়াজ পচে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উন্নত সংরক্ষণাগার তৈরির পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। যা গড় মৌসুমে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘প্রমোটিং অ্যাগ্রিফুড সেক্টর ট্রান্সফরমেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেও পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশে কৃষিপণ্যগুলোর মধ্যে পেঁয়াজের বাজারেই অস্থিতিশীলতা দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। এর পেছনের কারণ হিসেবে বরাবরই পণ্যটির ঘাটতি চাহিদা পূরণে ভারতনির্ভরতাকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছেন বাজার পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা। স্থানীয় উৎপাদন চাহিদা পূরণে অপর্যাপ্ত হওয়ায় প্রতিবেশী দেশটি থেকে নিয়মিতভাবেই বছরে ৭-৮ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে পণ্যটির মূল্যে বড় প্রভাবক হয়ে উঠে ভারতে অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দেশটির সরকারের পেঁয়াজ বাণিজ্য-সংক্রান্ত নীতিগত সিদ্ধান্ত। বাজার কারসাজি চক্রের জন্যও পণ্যটির বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে একক উৎসে নির্ভরতা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে একক দেশ নির্ভরতা পরিহার করে একাধিক দেশ থেকে পণ্য আমদানির উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে তারা বারবার তাগিদ দিয়েছে। যাতে কোনো দেশে সমস্যা হলে অন্য দেশ থেকে আমদানি বাড়ানো যায়। তবে এ ব্যাপারে আগাম উদ্যোগ না নিলে সংকটের সময় হঠাৎ করে নতুন করে কোনো দেশ থেকে আমদানি করা কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য আগে থেকেই আমদানির বিকল্প ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষ করে পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। তবে তাদের এ সুপারিশ উপেক্ষিত হয়েছে। এ কারণে পেঁয়াজ আমদানিতে ভারতের একক নির্ভরতা দেশের মানুষকে বারবার ভুগিয়েছে। ঝুঁকি কমাতে আমদানি নির্ভর পণ্যগুলো কোনো একক দেশের ওপর নির্ভর না করে বেশ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বাজার বিশ্লেষকরাও। তারা বলেন, নানা কারণে কোনো একটি দেশের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। একই সঙ্গে বিভিন্ন কারণে রপ্তানিও বন্ধ করতে পারে। এতে করে দেশের বাজারে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয় সেজন্য বিভিন্ন দেশ থেকে একই পণ্য আমদানির উদ্যোগ নিতে হবে। এতে কোনো দেশ থেকে আমদানিতে সমস্যা হলে বিকল্প দেশগুলো থেকে কিছু কিছু করে আমদানি বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে। বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, পেঁয়াজ আমদানিতে বাংলাদেশ এককভাবে ভারতের ওপর নির্ভরশীল। দেশে পেঁয়াজের নিট উৎপাদন হয় ২৮ লাখ টন। এর বাইরে আরও ৬-৮ লাখ টন আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ভারত থেকেই আমদানি করা হয় ৫-৭ লাখ টন। বাকি ১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করে মিয়ানমার, মিসর, তুরস্ক থেকে। কিন্তু ভারতে পেঁয়াজের উৎপাদন কমে গেলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। তখনই দেশে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে এর দাম কেজিতে ৩০০ টাকায় উঠে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরেও ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করছিল। ওই সময়েও দেশের পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে উঠে। দুই বছরই ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে মিয়ানমার, তুরস্ক থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু তাৎক্ষনিকভাবে ওইসব দেশ থেকে আমদানি করা জটিল হয়ে উঠে। আমদানির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ২-৩ মাস লেগে যায়। তত দিনে দেশি পেঁয়াজ বাজারে চলে আসে। ভারত প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় এ দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির খরচ কম। মিয়ানমার থেকেও আমদানি খরচ কম। কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য খুবই কম। এছাড়া রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের শীতলতা থাকায় স্থল বাণিজ্য বন্ধ। খুবই সীমিত আকারে নৌপথে কিছু বাণিজ্য হচ্ছে। তুরস্ক থেকে আমদানিতে খরচ বেশি পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, আমাদের কখনোই উচিত হবে না একটি বাজারের উপর নির্ভরশীল হওয়া। তিনি বলেন, পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে শুধু ভারতের উপর নির্ভরশীল না থেকে বিকল্প বাজারও খুঁজতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশের ভেতরেও পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। এই অর্থনীতিবিদের মতে, পেঁয়াজের জন্য ভারতের উপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা তৈরি হওয়ার একটি দুটো কারণ রয়েছে। প্রথমত, ঐতিহাসিকভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ভারতের পেঁয়াজের গুণগত মান এবং দাম বিবেচনা করলে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক। তবে তারপরও বিকল্প বাজার খোঁজা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে বারবার ঝুঁকিতে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হয়ে যাবার পর বাংলাদেশের গরুর খামারিরা যে সফলতা দেখিয়েছে, সেটি পেঁয়াজ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে পেঁয়াজ যে পরিমাণ উৎপাদন হয়, ভারত থেকে যদি পেঁয়াজ না আসতো তাহলে হয়তো বাংলাদেশের কৃষক উৎপাদিত পেঁয়াজের ভালো দাম পেতো। বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পেঁয়াজের ক্ষেত্রে কেজি প্রতি ২৫ থেকে ৩০ টাকা পায়। ভারত থেকে পেঁয়াজ না আসলে বাংলাদেশের কৃষকরা প্রতি কেজি পেঁয়াজে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা পেতো। তাহলে দেশের চাষীদের যে সক্ষমতা আছে, তারা অনায়াসেই ৩০ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ উৎপাদন করতে পারতো। এতে হয়তো সারা বছরই দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের দাম একটু বেশি থাকবে। হয়তো কেজি প্রতি ৪০-৪৫ টাকা থাকবে, কিন্তু কখনো দুইশ’ আড়াইশ’ টাকায় উঠবে না। অথচ আমাদের দেশে কখনও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। ফলে কৃষক যখন উৎপাদন করে তখন বিদেশ থেকে এ পণ্যটি আমদানি করা হলে দাম অনেক পড়ে যাবে এ দুঃশ্চিন্তা মাথায় রেখে তারা চাষাবাদ করে। সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে বর্তমানে ২৩ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। কিন্তু পেঁয়াজ ঘরে তোলার সময় এবং পর্যন্ত সংরক্ষণাগারের অভাবে প্রায় পাঁচ লাখ টন নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ ১৯ লাখ টন পেঁয়াজ বাজারে থাকে। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ লাখ মেট্রিককটন পেঁয়াাজ প্রয়োজন হয়। ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে আমদানি হয় ১১ লাখ টন। সাবেক কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, পেঁয়াজের মতো কৃষিপণ্য আমদানি না করাই ভালো। আমাদের কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের দাম বেশি হলেও তা দিয়েই খাওয়া উচিত। সরকারের উচিত যেসব পণ্য দেশে ভালো উৎপাদন হয় তার আমদানি একেবারেই বন্ধ করে দেয়া। কৃষকের উৎপাদন খরচ অনুযায়ী তাকে টাকা দিতে হবে। এর চেয়ে কম দামে খেতে চাইলে বাজার অস্থিতিশীল হবেই। এছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে একক দেশের নির্ভরশীলতা বাড়লে দাম নিয়ন্ত্রনের ঝুঁকি বাড়বেই। এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি নির্ভরতা কমাতে এরইমধ্যে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশে ইতোমধ্যে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদ শুরু হয়েছে। এজন্য ১৬ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এ প্রণোদনার আওতায় ১৯ জেলার ১৮ হাজার কৃষক বিনা মূল্যে বীজ ও সার পাবেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বাজেট কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা খাত থেকে এ প্রণোদনা দেওয়া হবে। গত মে মাসে এসংক্রান্ত সরকারি আদেশ জারি হয়েছে। প্রণোদনা হিসেবে একজন কৃষক এক বিঘা জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ১ কেজি বীজ, ২০ কেজি ডিএপি ও ২০ কেজি এমওপি সার পাবেন। ২০২০-২১ সালে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ হয়েছিল মাত্র ৪০ হেক্টর জমিতে, উৎপাদন হয়েছিল ৩০০ টন। সরকারের প্রণোদনার কারণে ২০২১-২২ সালে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ করা জমি বেড়ে হয় ২৫০০ হেক্টর, উৎপাদিত হয় ৩৭ হাজার টন। আর ২০২২-২৩ সালে আবাদ হয়েছে ২৭০০ হেক্টর জমিতে, উৎপাদিত হয়েছে ৩৯ হাজার ৮০০ টন। এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষেও আমরা খুবই গুরুত্ব দিচ্ছি। এর সম্ভাবনা অনেক। কৃষকদের বীজ, সার, প্রযুক্তিসহ সব সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ জনপ্রিয় করতে পারলে আমরা পেঁয়াজে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন নয়, বিদেশে রপ্তানিও করতে পারব। যাযাদি/ এসএম
Published on: 2023-08-22 05:30:51.564552 +0200 CEST

------------ Previous News ------------