কালবেলা
খালি হাতে আটক দুই যুবককে ফাঁসানো হলো অস্ত্র মামলায়

খালি হাতে আটক দুই যুবককে ফাঁসানো হলো অস্ত্র মামলায়

মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সমতল থেকে পাহাড়—দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্ধর্ষ সব অপারেশন পরিচালনা করে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করে আলোচিত হয়েছে এই এলিট ফোর্স। ক্লু-লেস অনেক মামলার রহস্য উদ্ঘাটনেও দেখিয়েছে সাফল্য। তা সত্ত্বেও কোনো কোনো সদস্যের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে নানা সময়ে সমালোচিত হয়েছে র‌্যাব। এবার র‌্যাব-৪-এর কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে উঠেছে গুরুতর অভিযোগ। রাজধানীর আগারগাঁও থেকে দুই যুবককে খালি হাতে আটকের পর অস্ত্র মামলায় ফাঁসানো হয়েছে—এমন দাবি করে মামলা করেছে ভুক্তভোগীদের পরিবার। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। ঘটনার প্রতিকার চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে সুপারিশ করেছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। তবে ১৫ দিন পার হলেও জামিন পাননি ওই দুই যুবক। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা মোটেই কাম্য নয়। মিরপুর মডেল থানায় র‌্যাবের দায়ের করা এজাহারে বলা হয়েছে, ‘গত ৩০ মার্চ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, মাদকদ্রব্য উদ্ধারসহ বিশেষ অভিযান পরিচালনাকালে রাত আনুমানিক ২১.৩০ ঘটিকায় মিরপুর গোলচত্বর এলাকায় অবস্থানকালে গোপন সূত্রে সংস্থাটি জানতে পারে, মো. রহিম সুলতান ওরফে বায়েজিদ এবং তার সঙ্গীয় অন্য একজন সন্ত্রাসীসহ একটি মোটরসাইকেলে মিরপুর মডেল থানাধীন মধ্য পীরেরবাগ এলাকার ৬০ ফিট পাকা মসজিদের উত্তর পাশে নিউ অটোকার সলিউশন ওয়ার্কসের সামনে পূর্ব পাশে পাকা রাস্তার ওপর অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রসহ দস্যুতা সংঘটনের উদ্দেশ্যে ঘোরাফেরা করছে। এরপর ফোর্সসহ রাত ২২.৩০ ঘটিকার সময় ঘটনাস্থলে পৌঁছালে র‌্যাব সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে ১ নম্বর আসামি কর্তৃক চালিত মোটরসাইকেলে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় সঙ্গীয় অফিসার ও ফোর্সের সহায়তায় মোটরসাইকেলসহ তাদের আটক করা হয়। আটককৃতদের কাছ থেকে মোটরসাইকেলের সিটের নিচ থেকে কাঠের বাঁটের একটি রিভলবার উদ্ধার করা হয়। আটককৃতরা হলেন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মো. রহিম সুলতান ওরফে বায়েজিদ ও মো. বেল্লাল হোসেন।’ তবে বায়েজিদ ও বেল্লালের পরিবারের দাবি, দুজনকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ভবনের পাশে আগারগাঁও জামে মসজিদের গেটের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কালবেলার হাতে আসা কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ভুক্তভোগী পরিবারের দাবির সত্যতা পাওয়া গেছে। একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, গত ৩০ মার্চ রাত ১০টা ১৮ মিনিটে আগারগাঁও ইসলামিক ফাউন্ডেশন ভবনের পাশের মসজিদের গেটের সামনে একটি ছাই রঙের মাইক্রোবাস এসে থামে। মাইক্রোবাস থেকে কয়েকজন নেমে বায়েজিদ ও বেল্লালকে মাইক্রোবাসে তোলেন। এ সময় হলুদ রঙের শার্ট পরিহিত এক ব্যক্তিকে মাইক্রোবাস থেকে নামতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর ওই ব্যক্তিকে সড়কের উল্টো পাস দিয়ে বায়েজিদের মোটরসাইকেল চালিয়ে নিতে দেখা যায়। এ সময় মাইক্রোবাসটিকে মোটরসাইকেলের পেছনে পেছনে চলতে দেখা যায়। এর ঘণ্টাখানেক পরের আরেকটি ফুটেজে দেখা যায়, ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে মধ্য পীরেরবাগ এলাকার ৬০ ফিট পাকা মসজিদের উত্তর পাশে নিউ অটোকার সলিউশন ওয়ার্কসের সামনে বায়েজিদের মোটরসাইকেল নিয়ে দুই ব্যক্তি আসেন। তাদের একজনের হাতে ওয়াকিটকি ছিল। এরপর আরেকটি মোটরসাইকেলে করে হলুদ শার্ট পরা সেই ব্যক্তি আসেন। কিছুক্ষণ পরে পুরো জায়গাটি খালি হয়ে গেলে আসে ছাই রঙের সেই মাইক্রোবাসটি। এরপর র‌্যাবের একটি টহল গাড়ি সেখানে উপস্থিত হয়। হাতকড়া পরা অবস্থায় বায়েজিদ ও বেল্লালকে সেখানে নামানো হয়। এ সময় আশপাশে কিছু লোকজন জড়ো হয়। র‌্যাব সদস্যরা সেখানে ৩০ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের মতো অবস্থান করেন। র‌্যাবের দায়ের করা মামলায় ২ নম্বর সাক্ষী তাবাস্সুম স্টেশনারির মালিক মো. জাহিদ। গত রোববার রাতে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এক লোক এসে র‌্যাবের কথা বলে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর হাতকড়া পরা দুই ব্যক্তি ও পাশে সিট খোলা অবস্থায় একটি মোটরসাইকেল দেখতে পাই। সিটের ভেতরে একটি অস্ত্র রাখা ছিল। সেটি দেখিয়ে র‌্যাব সদস্যরা জানান, দুজনকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর তারা সাক্ষী হিসেবে আমার নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে যান।’ গত রোববার সন্ধ্যায় আগারগাঁও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সামনে গিয়ে বায়েজিদ ও বেল্লালকে আটকের সময়ের কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীকে পাওয়া যায়। প্রত্যক্ষদর্শীর একজন বলেন, ‘সেদিন হঠাৎ করে একটি ছাই রঙের হায়েস গাড়িতে করে কয়েকজন লোক আসেন। এরপর তারা দুই ব্যক্তিকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। এ সময় তাদের শরীর চেক করে কিছু পায়নি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা একদম ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায়।’ নুর আলম নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা পাশের দোকানে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় বায়েজিদ ওখানে আসে। বায়েজিদকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। কিছুক্ষণ পরই একটি মাইক্রোবাস এবং কয়েকটি মোটরসাইকেলে করে কয়েকজন লোক এসে থামে। একজন জিজ্ঞেস করে আপনি বায়েজিদ? ও হ্যাঁ বলার সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি থেকে কয়েকজন নেমে টেনে গাড়িতে তোলে। আমি এগিয়েছিলাম কী ঘটে, সেটা দেখার জন্য। এরপর আমাকে চোখ গরম দিলে আমি পেছনে আসি। তখন তারা বায়েজিদ ও বেল্লালের কোমর চেক করে; কিন্তু কিছু পায়নি। পরে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মো. রহিম সুলতান ওরফে বায়েজিদ ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহসভাপতি। রাজনীতির পাশাপাশি ২০২১ সাল থেকে এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসা করেন। এ নিয়ে স্থানীয় শিহাবুল ইসলাম শয়নের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। শয়নের দুই সহযোগী সাইফুল ইসলাম মিঠু এবং জন র‌্যাবের সোর্স হিসেবে এলাকায় পরিচিত। আর তাদের সবার মাথার ওপরে রয়েছে শেরেবাংলা নগর থানা আওয়ামী লীগের নেতা শান্টু রহমান দুলাল। ভুক্তভোগী পরিবারের দাবি, দীর্ঘদিন ধরেই বায়েজিদকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর পরিকল্পনা চলছিল। ২০২১ সালে অজ্ঞাত মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে এ বিষয়ে বায়েজিদকে সতর্কও করা হয়েছিল। এ নিয়ে বায়েজিদ শেরেবাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেন। ২০২১ সালের ১৮ জুলাইয়ের ওই ডায়েরি নং-৮১৫। পাশাপাশি আইনগত সহযোগিতার জন্য র‌্যাব-২-কে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন। ২০২২ সালের ২ আগস্ট শেরেবাংলা নগর থানায় আরেকটি সাধারণ ডায়েরি করেন বায়েজিদ। এতে তিনি র‌্যাবের সোর্স পরিচয় দেওয়া সাইফুল ইসলাম মিঠু তাকে মাদক দিয়ে র‌্যাবের হাতে ধরিয়ে দিতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে নিরাপত্তা চাওয়া হয়। এভাবে বারবার থানা ও র‌্যাবের শরণাপন্ন হলেও নিরাপত্তা পাননি ভুক্তভোগী ছাত্রলীগ নেতা। পরিবারের অভিযোগ, ‘ইন্টারনেট ব্যবসা কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বের জেরে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বায়েজিদকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।’ এ ঘটনায় ভুক্তভোগী বায়েজিদের মা শাহনাজ সুলতানা বাদী হয়ে দুই র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে সিএমএম আমলি আদালতে (শেরেবাংলা নগর) একটি মামলা করেছেন। মামলায় আসামিরা হলেন র‌্যাব-৪-এর স্পেশাল কোম্পানি কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আক্তারুজ্জামান, র‌্যাব কর্মকর্তা গোলাম রসুল, শিহাবুল ইসলাম শয়ন, সাইফুল ইসলাম মিঠু, জন এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শান্টু রহমান দুলাল। এ ছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানকের সুপারিশসহ একটি চিঠি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে জমা দিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবার। এতে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করা হয়েছে। সেখানে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জোর সুপারিশ করেছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করে র‌্যাব মহাপরিচালকের কাছে পাঠিয়েছেন। বায়েজিদের মা শাহনাজ সুলতানা কালবেলাকে বলেন, ‘আমার ছেলেটাকে দীর্ঘদিন ধরে ওরা ফাঁসানোর চেষ্টা করতেছে। আটকের কথা শুনে আমরা রাতেই র‌্যাবের অফিসে যাই। কিন্তু সেখানে আমাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বলা হয়, থানায় যোগাযোগ করেন। পরে আমরা থানায় গেলে আমার ছেলে জানায়, তাকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সামনে থেকে আটক করা হয়েছে। গাড়ির মধ্যে বসে আমার ছেলের হাতে একটি পিস্তল দিয়ে সেটি তাকে ধরতে বলা হয়েছিল। না ধরলে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়। আমার ছেলে সেটি না ধরায় পরে অস্ত্র গাড়ির সিটের নিচ থেকে উদ্ধার দেখিয়ে মামলা দিয়েছে। আমি এর বিচার চাই।’ আরেক ভুক্তভোগী বেল্লালের স্ত্রী উম্মে ফাতেমা কালবেলাকে বলেন, ‘আমার স্বামী ড্রাইভারের চাকরি করেন। আমার তিন বছরের একটি সন্তান আছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমার স্বামী। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। আমরা এই মাসে বাসা ভাড়া দিতে পারিনি। ছোট ছেলেটা সারাক্ষণ বাবা বাবা বলে কান্নাকাটি করে। বায়েজিদের সঙ্গে চা খেতে যাওয়ায় ওরা আমার স্বামীকেও মিথ্যা অস্ত্র মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিল। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাব-৪-এর কোম্পানি কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আক্তারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘যে অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়েছে, তা বায়েজিদের কাছেই পাওয়া গেছে। র‌্যাব কোনো কিছু মেক করে না। যা ঘটনা, যা সত্যি তাই।’ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সামনে থেকে ধরে পীরেরবাগে গ্রেপ্তার দেখানো হলো কেন—এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেন। যোগাযোগ করা হলে ঢাকা-১৩ আসনের সংসদ সদস্য এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি। ওই ছেলের পরিবার আমার কাছে এসেছিল। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সঠিক তদন্ত করে সত্য ও ন্যায়বিচারের জন্য সুপারিশ করেছি।’ ঘটনাটি অবহিত করে মন্তব্য চাওয়া হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘এটি একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। যার দায়িত্ব হচ্ছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করা। সেখানে তারা নিজেরাই যদি আইন লঙ্ঘন করে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। র‌্যাবের কাছে অধিকতর শুদ্ধাচার কাম্য। তাদের মাধ্যমে যেন কোনোভাবেই আইনের না হয়, সেটি তাদেরই নিশ্চিত করা উচিত।’
Published on: 2024-04-17 04:07:48.249154 +0200 CEST