প্রথম আলো
চট্টগ্রামের সড়কে নৈরাজ্য বাসটি ৪৩ বছরের পুরোনো, ফিটনেস ছাড়াই চলছিল

চট্টগ্রামের সড়কে নৈরাজ্য বাসটি ৪৩ বছরের পুরোনো, ফিটনেস ছাড়াই চলছিল

৪৩ বছরের পুরোনো ‘লক্কড়ঝক্কড়’ বাসটি রাস্তায় চলছিল ফিটনেস ছাড়াই। ভাঙাচোরা গাড়িটি কিনে কিছু মেরামতকাজ করিয়ে শাহ আমানত পরিবহন নামে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে নামিয়ে দেওয়া হয়। ফিটনেস নেই, কর সনদ নেই—এভাবেই সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল বাসটি। এই বাহনের ধাক্কায় সোমবার নিহত হন চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুই শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিএ) হিসাবে, চট্টগ্রাম শহর ও জেলায় চলাচলকারী মোট নিবন্ধিত যানবাহনের মধ্যে ৭০ হাজারের বেশি ফিটনেসবিহীন। মোট নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৪ লাখ ৫৬ হাজার। অনিবন্ধিত বা ফিটনেসবিহীন এসব গাড়ির সিংহভাগই রাস্তায় চলছে। গত তিন মাসে চট্টগ্রাম বিভাগে ৩২২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৬১ জন। এ ছাড়া এপ্রিলে ঈদের সময় দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামে ৬০ জনের মৃত্যু হয়। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে বছরখানেক আগে এ রকম ভাঙাচোরা প্রায় ৩০টি গাড়ি নিয়ে চালু হয়েছে শাহ আমানত পরিবহন সার্ভিস। কাপ্তাই সড়কের রাঙ্গুনিয়া জিয়ানগর এলাকায় সোমবার চুয়েট শিক্ষার্থীদের মোটরসাইকেলটিকে এই পরিবহনের একটি বাস ধাক্কা দেয়। দুই লেনের সড়কটিতে বাস-ট্রাকের পাশাপাশি সিএনজিচালিত অটোরিকশার দাপটও কম নয়। এখানে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত মিলে ১৫ হাজারের বেশি অটোরিকশা চলে। টোকেন-বাণিজ্যে এসব অনিবন্ধিত যানবাহন বৈধ হয়ে যায়। সড়কে এই নৈরাজ্য প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কী করছে, জানতে চাইলে বিআরটিএ চট্টগ্রামের উপপরিচালক সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত চলছে। তবে তা প্রতিদিন সম্ভব নয়। এ জন্য সড়কে অবস্থানকারী অন্যান্য সংস্থাকে আইন প্রয়োগে ভূমিকা রাখতে হবে।> > গত তিন মাসে চট্টগ্রাম বিভাগে ৩২২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৬১ জন। এ ছাড়া > এপ্রিলে ঈদের সময় দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামে ৬০ জনের মৃত্যু হয়।চুয়েট শিক্ষার্থীদের ধাক্কা দেওয়া বাসটির নম্বর চট্ট মেট্রো ব-০৫-০২২৭। বিআরটিএ সূত্র জানায়, ১৯৮০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি গাড়িটির নিবন্ধন হয়। এই বাসের প্রথম মালিক ছিলেন উজ্জ্বল নন্দী, বর্তমানে অন্য একজন। বিআরটিএ এবং কাপ্তাই জেলা বাস মিনিবাস মালিক ও শ্রমিক সূত্র জানায়, বাসটি আগে অন্য পথে চলত। বছরখানেক আগে থেকে চলছে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে, চট্টগ্রাম থেকে লিচুবাগান পর্যন্ত। শাহ আমানত সার্ভিসের ৩০টির মতো বাস রয়েছে। কাপ্তাই জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, এই বাস আগে অন্য মালিকের ছিল। এটি অনেক পুরোনো। মালিকও পরিবর্তন হয়েছে। মেরামত করে সড়কে চলছিল। এ রকম পুরোনো কিছু গাড়ি দিয়ে এক বছর আগে সার্ভিসটি চালু করা হয়।৫২ আসনের বাসটির ফিটনেস মেয়াদোত্তীর্ণ। ৮ ফেব্রুয়ারি মেয়াদ পার হয়। এ ছাড়া কর সনদও ২ ফেব্রুয়ারি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ২০০৪ সালে বাসটির সর্বশেষ রেকর্ড হালনাগাদ করা হয়। বিআরটিএ চট্টগ্রামের উপপরিচালক সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরী বলেন, বাসটি অনেক পুরোনো। ১৯৮০ সালে কেনা বাসটি মেরামত করিয়ে চলছিল। তবে এখন এই বাস ফিটনেসবিহীন। অন্যান্য কাগজও হালনাগাদ নেই। দুর্ঘটনার পর বাসটির চালক ও সহকারী পালিয়ে গেছেন। চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল কি না, তা জানা যায়নি। রাঙ্গুনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) চন্দন কুমার চক্রবর্তী বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকে চালক পলাতক। তাঁকে পাওয়া গেলে বোঝা যাবে লাইসেন্স ছিল কি না।> > ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত চলছে। তবে তা প্রতিদিন > সম্ভব নয়। এ জন্য সড়কে অবস্থানকারী অন্যান্য সংস্থাকে আইন প্রয়োগে ভূমিকা > রাখতে হবে। সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরী, বিআরটিএ চট্টগ্রামের উপপরিচালকচট্টগ্রামের কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত সড়কটির দূরত্ব ৫২ কিলোমিটার। এই দূরত্বের মধ্যে প্রায় ২০টি অটোরিকশার স্ট্যান্ড রয়েছে। প্রতিটি স্ট্যান্ডের অধীনে ৫০ থেকে ১০০টির বেশি অটোরিকশা রয়েছে। সে হিসাবে দুই লেনের সড়কটিতে ১৫ হাজারের বেশি অটোরিকশা চলছে বলে জানা গেছে। তবে এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের কাগজপত্র হালনাগাদ নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের অবৈধ টোকেন-বাণিজ্যে এগুলো চলে থাকে। রোয়াজারহাট সিএনজি অটোরিকশা সমিতির নেতা আবদুস সাত্তার বলেন, ২০টির মতো সমিতি রয়েছে। সব কটি সমিতিতে কিছু গাড়ির কাগজপত্র নেই। নানা কৌশলে এগুলো চলাচল করে। এ সড়কে দুর্ঘটনার জন্য এসব অটোরিকশার বেপরোয়া গতিকে দুষছেন বাস শ্রমিক মালিক সমিতির নেতারা। সোমবার একটি অটোরিকশাকে পাশ কাটাতে গিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয় বাসটি।বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পূর্বাঞ্চলের সভাপতি মৃণাল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, শুধু বাসের দোষ দিলে হবে না। অনেক গাড়ি বা বাসচালকের যেমন কাগজপত্র নেই, তেমনি সড়কে বেপরোয়া মোটরসাইকেল ও অটোরিকশাও চলাচল করে। দুর্ঘটনাকবলিত মোটরসাইকেলটির আরোহী ছিলেন তিনজন। তাঁদের সুরক্ষা হেলমেটও ছিল না। এ সড়কে চলাচলকারী বেশির ভাগ অটোরিকশাচালকের লাইসেন্স নেই। তাঁরা পুলিশের টোকেনের মাধ্যমে গাড়ি চালান। প্রতিটি টোকেনের জন্য মাসে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা দিতে হয়। এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) এএনএম ওয়াসিম ফিরোজ প্রথম আলোকে বলেন, অনিবন্ধিত বা ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে অভিযান নিযমিত চলে। পরে বিআরটিএতে জরিমানা আদায় করা হয়। টোকেন বাণিজ্যের সঙ্গে দুই লাইনম্যান জড়িত। টোকেন বাণিজ্যে পুলিশের কেউ জড়িত থাকলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। যদি নাম আসে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।চট্টগ্রামে বিআরটিএর তিনটি বিভাগ রয়েছে। এই তিন বিভাগ মিলে বর্তমানে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৯৪০। এর বিপরীতে ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা ৪ লাখ ৫১ হাজার ১৩৭। এ ছাড়া নিবন্ধিত যানবাহনের বিপরীতে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ৭০ হাজারের বেশি। এই হিসাব বিআরটিএর জন্মলগ্ন থেকে হিসাব ধরা হয়। যানবাহনের তুলনায় ৪ হাজার ৮০৩ জন চালক কম। আবার ৫০ বছর আগের ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী অনেকে মারা গেছেন বা অনেকে গাড়ি চালান না। ফিটনেস কিংবা রুট পারমিটের মেয়াদ না থাকলে সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী জরিমানার বিধান রয়েছে। গাড়ির ফিটনেস না থাকলে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পরিবহনবিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, গাড়ি যাঁরা চালান, তাঁদের দায় দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে বেশি। চালকের ওপর অন্যদের জীবন নির্ভর করে। তিনি মনে করেন, সর্বোপরি সড়ক ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে দিন দিন দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। পর্যাপ্ত দক্ষ চালক ও পর্যাপ্ত ভালো মানের গাড়ি না থাকলে ফিটনেসবিহীন গাড়ি যেমন নামবে, তেমনি অদক্ষ চালকও গাড়ি চালাবেন।
Published on: 2024-04-24 05:18:53.395819 +0200 CEST

------------ Previous News ------------