সমকাল
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশে প্রস্তুতি ইসির

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশে প্রস্তুতি ইসির

দেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে সুনির্দিষ্ট খসড়া প্রস্তাবনার কাজ শুরু করেছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। এ ক্ষেত্রে তারা বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিআই) ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিবেদনকে বিবেচনায় নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। তবে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী নতুন কমিশন। বর্তমান কমিশনের মেয়াদে আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় তারা এই সংস্কার প্রস্তাব সুপারিশ আকারে পরবর্তী কমিশনের জন্য রেখে যাবেন বলে ইসি সূত্র জানিয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পরে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাংবিধানিকভাবে পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব নেওয়া এই কমিশনের মেয়াদ আরও প্রায় তিন বছর বাকি রয়েছে। দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো বর্তমান কমিশনের অধীনে নির্বাচন বর্জনের ধারাবাহিকতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নেয়নি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মূল্যায়ন করতে আসা যুক্তরাষ্ট্রের দুই নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থা এনডিআই ও আইআরআইয়ের কারিগরি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংসদ নির্বাচনে দেশব্যাপী কার্যকর নির্বাচনী প্রতিযোগিতা অনুপস্থিত ছিল। নাগরিক অধিকারের চর্চা, বাক্-স্বাধীনতা ও সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতার চর্চা সংকুচিত হওয়াসহ নানা কারণে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের গুণগত মান ক্ষুণ্ন হয়েছে। অন্যদিকে ইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। ছিল না কোনো প্রকৃত প্রতিযোগিতা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার গেছে খারাপের দিকে। গণগ্রেপ্তারের কারণে বিরোধীরা ব্যস্ত ছিলেন আদালতপাড়ায়। ফলে ছিল না আন্দোলন-সংগ্রামের স্বাধীনতা। বিদেশি সংস্থার এসব প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে বর্তমান কমিশনের সদস্য মো. আলমগীর বলেন, তাদের রিপোর্ট কমিশন দেখেছে। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, বর্তমান কমিশনের মেয়াদে জাতীয় নির্বাচন তো আর হবে না। কাজেই অনেক সময় আছে। বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রাথমিক রিপোর্ট নিয়ে সদস্যদের মধ্যে আলোচনাও হয়েছে। এখন সারসংক্ষেপ করতে বলা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে ভালো দিক এবং দুর্বল দিক চিহ্নিত করা হয়েছে। ইসি সচিবালয় একটা খসড়া করেছিল। তাদের আরও বিস্তারিতভাবে প্রস্তুত করাতে বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পর্যালোচনা করে পরবর্তী কমিশনের জন্য সুপারিশ রাখা হবে। বর্তমান ত্রুটি দেখে ভবিষ্যতে তা সংশোধনের চেষ্টা করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষক সংস্থা এনডিআই ও আইআরআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিষয়ে সরকারের বাড়তি মনোযোগের কারণে অন্যান্য নির্বাচনের তুলনায় সহিংসতার ঘটনা কম হয়েছে। ফলে অহিংস রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল, সরকার এবং নাগরিক সমাজসহ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলজুড়ে নেতাদের নির্বাচনী রাজনীতির নিয়ম, অনুশীলন এবং নিয়মগুলোর সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। নির্বাচনে সহিংসতা নাগরিকদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একটি প্রধান প্রতিবন্ধক। বাংলাদেশের নির্বাচনকে পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক করতে হলে সব পক্ষকে অহিংস রাজনীতিকে প্রাধান্য দিতে হবে। ইইউ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর আসন ভাগাভাগি চুক্তি এবং আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও দলের সঙ্গে যুক্ত ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীদের’ মধ্যে ভোট হওয়ায় ভোটাদের ছিল না পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার সুযোগ। নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের ব্যবস্থা যোগ্যতাভিত্তিক ও স্বাধীন নিয়োগের মাধ্যমে হওয়া উচিত, যা জনস্বার্থে কাজ করার লক্ষ্যে কমিশনের হাত শক্তিশালী করবে। সর্বোত্তম অনুশীলনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি স্বাধীন প্যানেল বিষয়টি তত্ত্বাবধান করতে পারে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা আইনকে বাধা হিসেবে দেখেছে ইইউ। পূর্ববর্তী আইন থেকে কিছু উন্নতি সত্ত্বেও এটি আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অস্পষ্ট বিধানগুলো অযৌক্তিকভাবে অনলাইনে মতপ্রকাশকে সীমাবদ্ধ করে। তাই বাক্-স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বিধান মেনে সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিধানগুলোর পর্যালোচনা করতে হবে। অস্পষ্ট এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধিনিষেধগুলোকে সংশোধন করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রশ্নে ইসি আলমগীর বলেন, তারা পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে মতামত দিয়েছে। প্রার্থী, দল, সরকার, ভোটকেন্দ্র নানা বিষয়ে কথা বলেছে। কমিশনের করণীয় নিয়ে তারা সুপারিশ তৈরি করবে। যেগুলো কমিশনের পক্ষে করা সম্ভব, সেগুলো পরবর্তী কমিশনের জন্য সুপারিশ রেখে যাওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, তারা একটা (প্রতিবেদনের) জায়গায় বলেছে, ভোটে কারচুপি হয়েছে বেশ কয়েকটা কেন্দ্রে, যেখানে কমিশন ব্যবস্থাও নিয়েছে। যদি বলত কমিশন অবহেলা করেছে, এমন তো বলেনি। তারা কমিশনের বিরুদ্ধে নেতিবাচক কিছু বলেনি, যে কমিশনের এমন সক্ষমতা ছিল অথচ ব্যবস্থা নেয়নি। অথবা কমিশন এখানে ভোটের এসব কেন্দ্রে জাল ভোট হয়েছে কিন্তু কমিশন বন্ধ করেনি, এমন কোনো রিপোর্ট নেই। বরং কমিশন ব্যবস্থা নিয়েছে বলে তাদের রিপোর্টে আছে।’ গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসির নিবন্ধিত ৪৪ দলের মধ্যে ২৮টি দল অংশ নিলেও বিএনপিসহ অন্যরা ভোট বর্জন করে। এতে নির্বাচনকালীন কিছু সহিংস ঘটনাও ঘটে। রেলে অগ্নিসংযোগে প্রাণহানি হয়। তবে ভোটের দিন তেমন কোনো বড় ঘটনা ঘটেনি। অনেক শান্তিপূর্ণভাবেই নির্বাচন সম্পন্ন হয়। নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে ফের সরকার গঠন করে। উপজেলা ভোটেই শুরু হচ্ছে ডিজিটাল প্রচার দেশে প্রথমবারের মতো আইন করে ডিজিটাল প্রচারের ব্যবস্থা চালু করেছে ইসি। আগামী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেই প্রার্থীরা ডিজিটাল প্রচার চালানোর সুযোগ পাচ্ছেন। এতে প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় অনেকাংশেই কমে যাবে বলে মনে করছে ইসি। নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর জানিয়েছেন, ডিজিটাল প্রচারের ব্যবস্থা করায় খরচ কমে যাবে। ইউটিউবে, ফেসবুকে প্রচারে ব্যয় কমে যাবে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন উপজেলা নির্বাচন বিধিমালা ও আচরণ বিধিমালা সংশোধন করে বেশ কিছু পরিবর্তন আনে। সেগুলো নিয়ে ব্যাখ্যা করেন এ কমিশনার। অতীতে স্থানীয় এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করতে হলে ২৫০ ভোটারের সমর্থনসূচক সই জমা দিতে হতো। সংশোধনীতে সেই বিধান তুলে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন দলীয়ভাবে করার বিষয়ে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই তৃণমূলে রাজনৈতিক নির্বাচন হয়। বাংলাদেশে এখানে সেটা আগে ছিল না। পরে এখানেও করা হয়েছিল।
Published on: 2024-04-04 07:29:26.893618 +0200 CEST