সমকাল
নাথান বম, ভাপুওয়াল ও মইয়াকে দায়ী করছেন অনেকে কেএনএফের অর্থের নেশা নাকি অন্য কিছু

নাথান বম, ভাপুওয়াল ও মইয়াকে দায়ী করছেন অনেকে কেএনএফের অর্থের নেশা নাকি অন্য কিছু

সমতলের জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবানের কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে চুক্তি করেছিল জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। মাসে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে জঙ্গিদের গেরিলা কায়দায় প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছিল তারা। বিভিন্ন জেলা থেকে তরুণদের ‘হিজরত’-এর নামে ঘর থেকে বের করে পাহাড়ে কেএনএফের আস্তানায় নেওয়া হয়। ২০২১ সালে তিন বছরব্যাপী এ প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম এ চুক্তিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এর পর অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গহিন জঙ্গল থেকে জঙ্গি ও কেএনএফের অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। মূলত সংগঠনের তহবিল বাড়াতে টাকার নেশায় এ উগ্রবাদী সংগঠন পাহাড়ে প্রশিক্ষণের মতো গুরুতর অপকর্মে জড়ায়। এবার বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের তিনটি ব্রাঞ্চে নজিরবিহীন ডাকাতির পর অনেকের প্রশ্ন– ফের কেএনএফ কি টাকার নেশায় পড়েছিল, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে? বিশেষ করে সংগঠনটি যখন একটি শান্তি প্রক্রিয়ায় অনেক দূর এগিয়েছে; এই সময় কেন আবার তারা নিজেদের শক্তির জানাল দিল? সমকালের পক্ষ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নানা ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। ব্যাংক ডাকাতি চেষ্টার পর ম্যানেজারকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করায় তাদের টাকার নেশার বিষয়টি নতুনভাবে সামনে এলো। এর আগেও পার্বত্য এলাকা থেকে অনেককে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করেছিল তারা। কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়ার আলোচনায় ছিলেন এমন চারজনের সঙ্গে কথা হয় সমকালের। তাদের মধ্যে একজন জারলম বম। তিনি বলেন, ২২ এপ্রিল তৃতীয় দফায় কেএনএফের সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা ছিল। এর আগে দুই দফার বৈঠকে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তিও হয়। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে কেন তারা ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের মতো ঘটনায় জড়াল– বোধগম্য নয়। এমনকি শান্তি প্রক্রিয়া থেকে তাদের বের হয়ে যাওয়ার কোনো ইঙ্গিতও তারা দেয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৮ সদস্যের একটি কমিটি শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কেএনএফের সঙ্গে বৈঠক করে আসছিল। ওই কমিটির আরেক সদস্য হলেন লেলুং খুমী। তিনি জানান, কেএনএফের সঙ্গে ৫ মার্চ সর্বশেষ বৈঠক হয়। সেখানে মোটা দাগে চারটি শর্ত ছিল– সংলাপ চলাকালে কেএনএফ কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারবে না; চাঁদাবাজি থেকে বিরত থাকবে। আর তাদের পক্ষ থেকে শর্ত ছিল– আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান বন্ধ রাখা বা বমদের মধ্যে যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের পুনর্বাসন এবং নিজ ভিটেমাটিতে ফেরত আনা। এই শর্ত পুরোপুরি পালন করা হচ্ছিল। এমনকি কেএনএফ যখন পাহাড়ে সশস্ত্র কর্মকাণ্ডে জড়ায়, তখন বমপাড়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এসব প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি চালুর দাবি ছিল তাদের। সেই দাবির আলোকে গত নভেম্বরের পর থেকে বমপাড়ায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। এ ছাড়া সংগঠনের আরেক দাবি ছিল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বমদের কোনো কাজে ব্যবহার করলে, তার জন্য পারিশ্রমিক দিতে হবে। সেই দাবিও মেনে চলা হচ্ছে। শান্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেক সদস্য চলমান বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করলেন। নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, কেএনএফের সঙ্গে দুটি বৈঠকের কোনোটিতে নাথান বম ছিলেন না। তবে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী ভাপুওয়াল ও সংগঠনের সেকেন্ড-ইন কমান্ড মইয়া উপস্থিত ছিলেন। প্রথম বৈঠকে তারা ‘রাজনৈতিক’ কিছু দাবিদাওয়া তুলে ধরে। এসব দাবি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ দাবির মধ্যে ছিল পার্বত্য এলাকায় কয়েকটি উপজেলা মিলে ‘টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল’ গঠন। এ কাউন্সিলে বাংলাদেশ সরকারের কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। কোনো মন্ত্রণালয়, জেলা পরিষদের আওতাধীন থাকবে না কাউন্সিল। সেখানে কেএনএফের নিজস্ব একটি ব্যাটালিয়ন থাকবে। এমন দাবির সঙ্গে তাদের আট সদস্যের প্রতিনিধি ছাড়া স্বাভাবিকভাবে কেউ একাত্মতা প্রকাশ করেনি। এমন কাল্পনিক দাবির মধ্য দিয়ে তাদের একটি ভ্রান্ত ধারণা পাওয়া গিয়েছিল। আরও একাধিক পাহাড়ি বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণ বম সম্প্রদায়ের অনেকেই কেএনএফের এমন দাবির সঙ্গে একাত্ম নন। এমনকি তারা কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চান না। কারণ তাদের সশস্ত্র গ্রুপ কুকি ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) অনেকে সাধারণ বমদের বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে, বমদের মধ্যে অনেকে বাংলাদেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘চর’ হিসেবে কাজ করে। এ কারণে একাধিক বমকে অপহরণ করে হত্যা করেছিল কেএনএ। এ ছাড়া তাদের বাড়িঘর লুটও করা হয়। এমন বাস্তবতায় কেএনএফের নেতৃত্বের একটি অংশ সংঘাত ছেড়ে পুরোপুরি শান্তি প্রক্রিয়ায় যেতে চায় না। শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে কেএনএফের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যেও আছে দ্বিমত। এ ছাড়া মিয়ানমারের চিন প্রদেশের চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং পার্শ্ববর্তী আরেকটি দেশের কুকিদের সঙ্গে কেএনএফের কোনো অশুভ যোগাযোগ রয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার কথা বলছেন অনেকে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে পলাতক নাথান বমসহ তাঁর সহযোগীদের প্রশ্রয়দাতাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি বলে অনেকে মত দিয়েছেন। জঙ্গি প্রশিক্ষণের ঘটনায় নাথানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। নাথান, ভাপুওয়াল ও মইয়ার সবুজ সংকেত ছাড়া বান্দরবানে দুর্ধর্ষ ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। মইয়া নিজেকে কথিত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও ভাপুওয়াল ‘কর্নেল’ হিসেবে পরিচয় দেন। কেএনএফের সঙ্গে সংলাপ সম্ভব নয় দুই দিনে বান্দরবানের তিন ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায় কেএনএফের নাম আসায় সশস্ত্র এ গোষ্ঠীর সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন পাহাড়ের নৃগোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের নিয়ে গঠিত শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা মারমা। বৃহস্পতিবার জেলা পরিষদের সম্মেলনে কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘কমিটি মনে করে, এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে কেএনএফ শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গে সংলাপ করার সব ধরনের পথ বন্ধ করে দিয়েছে।’ চুক্তি ভঙ্গ করে সশস্ত্র কার্যক্রম অব্যাহত রাখার অভিযোগ করে তিনি বলেন, কমিটির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে বারবার অবহিত করা হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। বিভিন্ন সময় স্থানীয়দের ওপর হামলা, অপহরণ ও চাঁদাবাজি চালিয়ে যায় তারা। সাম্প্রতিক কেএনএফের ঘটনায় কমিটি তীব্রভাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। এসব ঘটনায় চলমান সব ধরনের প্রচেষ্টা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কেএনএফের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে পাহাড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে ২০২৩ সালের ৩০ মে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্যকে নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। ওই বছরের জুলাই ও আগস্টে কমিটির সঙ্গে কেএনএফের দু’বার ভার্চুয়ালি আলোচনাও হয়। পরে ৫ নভেম্বর রুমা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মুনলাইপাড়ায় প্রথমবারের মতো কেএনএফের সঙ্গে কমিটির সরাসরি দুটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। কেএনএফের ফেসবুক পোস্ট ডাকাতির ঘটনার পর কেএনএফ তাদের ফেসবুকে বেশ কয়েকটি পোস্ট দেয়। সেখানে বলা হয়– অভিযান ও সশস্ত্র যুদ্ধ দিয়ে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে আনার প্রচেষ্টা সরকারি উচ্চ মহলের নির্দেশ একটি শিশুসুলভ ও অসমাধানযোগ্য পদক্ষেপ। তারা দাবি করে– ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম সৃষ্টি হয়েছিল কুকি বিদ্রোহের কারণে। সেই যুদ্ধে কয়েক হাজার ব্রিটিশ বাহিনী বিপুল পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আবার ২০২১-২২ সালে কুকি-চিন জনগোষ্ঠী তাদের পূর্বপুরুষের ভূমি রক্ষার্থে বিদ্রোহ শুরু করে এবং এতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কেএনএফের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনো সশস্ত্র ফোর্স লাভবান হয়নি, বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেএনএফের দাবি মেনে নিলে সরকার কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নিয়ে আলোচনা দেশের বিজ্ঞ মহলের করা উচিত। অভিযান পরিচালনা করে কেএনএফের সশস্ত্র আন্দোলন সমাধান হয়ে যাবে না। বরং সমস্যা চিরতরে অসমাধান হয়ে থাকবে।
Published on: 2024-04-05 06:42:12.180338 +0200 CEST