‘দেশবাসী যখন নিশ্চিতে ঘুমাতে যান, আমরা তখন জেগে থাকি। সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে নিশ্চিত করি দেশ ও মানুষের নিরাপত্তা। এ নিয়ে আমাদের গর্ব হয়, প্রশান্তিও বয়ে যায় বুকের ভেতর।’ বলছিলেন সিপাহী মজিবুর রহমান। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের এই জোয়ান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্য। দেশ মাতৃকার সেবায় রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি এলাকা প্যারাছড়া বিওপিতে তিনি কর্তব্যরত।
প্যারাছড়ার দূরত্ব কাপ্তাই থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার। আশপাশে উঁচু-নিচু সব পাহাড়, আঁকাবাঁকা সরু পথ। প্যারাছড়ার ওপাশে ভারতের মিজোরাম। আজ শনিবার মধ্য দুপুরে মজিবুর রহমানের সঙ্গে যখন কথা হয় তিনি তখন তপ্ত রোদে অস্ত্রহাতে বিওপিতে সতর্ক পাহারায়। চোখ মেলে তাকাতেই দেখা গেল সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া।
এই দুর্গম বিওপি থেকে স্যাটেলাইট ছাড়া সমতলে যোগাযোগের উপায় নেই। মজিবুর রহমান বলেন, ‘ঈদে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে গ্রামে রেখে আসা দুই মেয়ে, এক ছেলে, স্ত্রী আর স্বজনদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। অতন্দ্র প্রহরী হয়ে এতদূরে বিজিবি সদস্যরা জেগে আছে বলেই আমার দেশ নামক পরিবার নিশ্চিন্তে উৎসব-আনন্দ করতে পারে। সেই আমাদের আনন্দ।’
উলুছড়ি বিওপি। ছবি: সমকাল
মজিবুর রহমানের মতো বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে শনিবার দুর্গম এই পার্বত্য সীমান্ত পরিদর্শন করেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। প্যারাছড়া ও উলুছড়ি বিওপিতে গিয়ে বিজিবিপ্রধান শোনেন তাদের সুখ-দুঃখের কথা। উলুছড়ির ক্যাম্পে দুপুরে তিনি সৈনিকদের সঙ্গে এক টেবিলে খাবার গ্রহণ করেন।
এর আগে সৈনিকদের বসবাসের স্থানসহ দুই বিওপির পুরোটা পরিদর্শন করেন বিজিবি মহাপরিচালক। খোঁজ নেন সৈনিকদের পরিবারের। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করায় বিজিবি সদস্যদের আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। দেশপ্রেম ও নিষ্ঠার সঙ্গে পবিত্র দায়িত্ব পালনের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনাও প্রদান করেন।
জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী এর আগে সকালে রাঙামাটি সেক্টর সদর দপ্তর পরিদর্শন করেন। সকল পর্যায়ের বিজিবি সদস্যদের দরবার গ্রহণ করেন। দরবারে রাঙামাটি সেক্টরের আওতাধীন ব্যাটালিয়ন ও বিওপিতে কর্মরত সকল পর্যায়ের বিজিবি সদস্য ভিটিসির মাধ্যমে সংযুক্ত ছিলেন।
প্যারাছড়ার ওপাশে ভারতের মিজোরাম
*জীবন এখানে যেমন*
সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্যারাছড়া ও উলুছড়ির মতো প্রায় সব দুর্গম বিওপিতে ফোর্সরা গোসল করেন পাহাড়ি ছড়ার পানিতে। বিওপি থেকে প্রায় হাজার মিটার নিচে এসব ছড়া। কেউ অসুস্থ হলে ছড়ার পানি ওপরে বয়ে আনা হয় তার জন্য। এছাড়া বিশেষ প্রক্রিয়ায় ফিল্টারিং করে ছড়ার পানিই ফোর্সদের জন্য সরবরাহ করা হচ্ছে।
প্যারাছড়ায় রয়েছেন সিপাহী অপু। তিনি বলেন, ‘দুর্গম এলাকা হওয়ায় হেলিকপ্টার ছাড়া এই বিওপিতে রেশন পৌঁছানো যায় না। চাল-ডাল, মাংস, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে মাসে একবার হেলিকপ্টার আসে। কখনো কখনো আশপাশের পাহাড়ি পাড়া থেকে মাছ-মুরগি কেনা হয়। বিওপির কাছে ছোট্ট একটি গ্রামে পাহাড়ি বাজার বসে সপ্তাহে মাত্র একদিন। তবে ওই বাজারে তেমন কিছু পাওয়া যায় না।’
প্যারাছড়ার ক্যাম্প কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নায়েব সুবেদার এসএম মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘প্যারাছড়া বিওপির দক্ষিণে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে করদিয়া বিওপি, প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে উলুছড়ি বিওপি। প্যারাছড়া থেকে কাপ্তাই পায়ে হেঁটে পৌঁছতে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা লাগে। এক সময় রাস্তাঘাট আরও খারাপ ছিল, তখন সময় লাগত ৪ দিন। জরুরি কাজে কাপ্তাই বা বরকল যেতে হলে পথেই কোনো ক্যাম্পে রাত কাটাতে হয়। একসময় প্যারাছড়াসহ দুর্গম সীমান্তের এসব বিওপিতে নদী পথে অনেক প্রতিকূল পরিবেশে ফোর্সদের খাবার পৌঁছানো হতো। এখন দুর্গম এসব এলাকায় রেশন পৌঁছানো হচ্ছে হেলিকপ্টারে।’
বিজিবি মহাপরিচালক বিওপি পরিদর্শনকালে উপস্থিত ছিলেন বিজিবি সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (জিএস শাখা), অতিরিক্ত মহাপরিচালক (বিএসবি), বিজিবির চট্টগ্রাম রিজিয়ন কমান্ডার, রাঙামাটি সেক্টর কমান্ডার এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়নের অধিনায়কসহ অন্যান্য কর্মকর্তাগণ।
Published on: 2024-04-13 18:11:15.310219 +0200 CEST
------------ Previous News ------------