স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত ধানের বিশেষ জাত 'লাল বিরুই'। অ্যান্থোসায়ানিন উপাদানের কারণে এ ধানের চালের রঙ লাল। মানুষ দিন দিন আরও স্বাস্থ্য সচেতন ও পুষ্টির উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় বাংলাদেশে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
বেসরকারি চাকরিজীবি মেহেদী হাসান লাল বিরুই খান নিয়মিত। তিনি কারওয়ান বাজার থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে ১০ কেজি চাল কিনেছেন। মাস কয়েক হলো তিনি এই চাল খাওয়ার অভ্যাস গড়েছেন।
তিনি বলেন, 'পলিশ করার কারণে সাদা চালে পুষ্টিগুণ অনেক কমে যায়। এটা জানার পর থেকেই লাল চাল খাওয়া শুরু করি।
'শুরুতে একটু সমস্যা হয়েছে। তবে কয়েক মাস যাওয়ার পর অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন পলিশ করা দামি চালও আর খেতে পারছি না।'
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, আধুনিক চালকলগুলোতে এখন চালের ওপরের স্তর থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছাঁটাই করে ফেলা হয়। এ কারণে উল্লেখযোগ্য হারে চালের পুষ্টিমান কমে যাচ্ছে। এ কারণে সরকারও নানা প্রচারণায় এই পলিশ করা চালের বিপক্ষে মতামত দিচ্ছে। আবার শহরের কিছু মানুষ নিজেদের সচেতনতা থেকেই পলিশ করা চাল খাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে।
ঢাকার বিপুলসংখ্যক বিক্রেতা (খুচরা ও পাইকারি উভয়ই) এখন লাল বিরুই মজুত ও বিক্রি করছেন। পুষ্টিবিদরাও কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, পলিফেনল ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের জন্য এ চাল খাওয়ার পরামর্শ দেন। এ চাল ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগীদের জন্য উপকারী।
বিক্রেতারা বলছেন, বছর দুয়েক আগেও শহরে বিরুই চালের এত বিক্রি ছিল না। এখন প্রায় প্রতিটি দোকানেই দিনে ১৫ থেকে ৫০ কেজি পর্যন্ত লাল চাল বিক্রি হয়। এ কারণেই দোকানগুলোতে চাল চালের সরবরাহ বেড়েছে। সুনামগঞ্জের মতো এলাকাগুলোর কৃষকরা ঢাকার চাহিদা মেটাতে লাল বিরুই চাষ করছেন।
শুধু কারওয়ান বাজারেই নয়, ঢাকার বিভিন্ন চালের আড়ত, সুপারশপ এবং বিভিন্ন অনলাইন বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতেও দেদারসে লাল চাল বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির বিক্রেতা আনিসুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'প্রতিদিনই কিছু কিছু ক্রেতা আসে। কেউ কম কিনছে, কেউ বেশি। দুই বছর আগে এত ক্রেতাও ছিল না, আমরাও লাল চাল রাখতাম না।
'একদল লোকের দেখাদেখি অন্য লোকেরা লাল বিরুই খাওয়া শুরু করছে।'
ল্যাবএইড হাসপাতালের পুষ্টিবিদ সামিয়া তাসনিম টিবিএসকে বলেন, 'পলিশ করা চালের চেয়ে লাল চালের মধ্যে নিউট্রিশন ভ্যালু খানিকটা বেশি। প্রতিদিন এক কাপ লাল চাল খেলে ভিটামিন বি-৬, বি-১২, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, ফরফরাস, ফাইবারসহ অনেক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পাওয়া যায় যেটা দৈনিক চাহিদার বেশিরভাগটাই পূরণ করতে পারে। এটা হার্টের রোগী, ডায়াবেটিসের রোগীসহ অনেক স্বাস্থ্যসচেতন মানুষকে আমরা নিয়মিত খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি।'
তিনি আরও বলেন, 'এটি দেখতে লালচে এবং চিকন। ভাত রান্নার পর কিছুটা আঠালো ও খেতে বেশ খানিকটা সুস্বাদু।'
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর (ব্রি) তথ্য বলছে, ময়মনসিংহ অঞ্চলের একটি পুরনো জাত বিরুই চাল। এই জাতের চাষাবাদ ১৯১১ সালের পর ওই অঞ্চলে শুরু হয়েছিল। এ ধরনের জাতগুলোকে বলা হয় 'স্থানীয়ভাবে ইমপ্রুভড জাত'। এটি সাধারণত আমন মৌসুমে হয়ে চাষ থাকে।
ব্রি-র মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, 'এটা ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকালি ডেভেলপড একটা ভ্যরাইটি। অল্প পরিমাণে এর চাষ হয়। কিন্তু এই চালের পুষ্টিগুণ বেশি।
'ব্রি-ও বোরো মৌসুমের একটি চালের জাত উদ্ভাবন করেছেন, যা ব্রিধান-৮৪ নামে পরিচিতি। এটিও লাল চাল। এই ধানটি আবার জিঙ্কসমৃদ্ধ। সারাদেশেই অল্প অল্প করে এই ধানের চাষ বাড়ছে।'
বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, ময়মনসিংহ, সিলেট, সুনামগঞ্জে অল্প কিছু কৃষক এই চাল উৎপাদন করছেন। যার পুরোটাই আমন মৌসুমে।
ময়মনসিংহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মতিউজ্জামান বলেন, 'বিরুই চালের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। সামান্য কিছু কৃষক নিজেরা বীজ রেখে রেখে এর উৎপাদন ধরে রেখেছেন।'
ময়মনসিংহ জেলার কৃষি অফিস বলছে, এ জেলার হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ভালুকায় ১৫০ হেক্টর জমিতে লাল বিরুইয়ের আবাদ হয়েছিল। যেখানে চালের উৎপাদন হয়েছে ২৬১ মেট্রিক টন।
এছাড়া সিলেটে প্রায় ২ হাজার ৯৫১ হেক্টর জমিতে চাষের মাধ্যমে উৎপাদন হয়েছে ৪ হাজার ৩৭০ মেট্রিক টন চাল।
Published on: 2023-04-22 13:42:46.401236 +0200 CEST
------------ Previous News ------------