The Business Standard বাংলা
সিটি কর্পোরেশনের উপর আস্থাহীনতার কারণেই মার্কেট ছাড়েনি বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা

সিটি কর্পোরেশনের উপর আস্থাহীনতার কারণেই মার্কেট ছাড়েনি বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা

গত মঙ্গলবারের অগ্নিকাণ্ডে আমিন পাটওয়ারির তিনটি দোকানের মধ্যে দুটি মালামালসহ সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। মহানগর মার্কেটর তার্'তোহা ফ্যাশনে'র মালামাল অধিকাংশই বাঁচাতে পেরেছিলেন কিন্তু অর্ধেরেকরও বেশি পানিতে নষ্ট ও চুরি হয়ে যায়। এ মার্কেট গড়ে ওঠার শুরুর সময় ২০০১ সাল থেকে তিনি ব্যবসা করে আসছিলেন। ১৯৯৭ সালে গুলিস্তানের পুরাতন বাজার হকার্স মার্কেটে (পোড়া মার্কেট) তখন সাড়ে চার লাখ টাকার বিনিময়ে দুটি দোকান নেন তিনি। পরবর্তীতে মার্কেটটি পুড়ে যাওয়ার পরে ২০০৭ সালের দিকে নতুন করে মার্কেট নির্মাণ শুরু হওয়ার পরে এখনও তার কোনো দোকান বুঝে পাননি। আমিন পাটওয়ারি বলেন, "সিটি কর্পোরেশন আমার ১৯৯৭ সালের দোকানই এখনও বুঝিয়ে দিতে পারেনি, আর পারবে কিনা সেটাও সন্দেহ। এরপরেও কোন বিশ্বাসে সিটি কর্পোরেশনের কাছে নিজেদের মার্কেট ছেড়ে দিবো? মার্কেট তৈরী করে দেওয়ার নাম করে ১০/১২ বছর ফেলে রাখে আবার কাজ শেষ হলে বরাদ্দ পায় দলীয় নেতারা। এটা ভেবেই আমরা বঙ্গবাজারের মার্কেট ছাড়িনি সিটি কর্পোরেশনের কাছে।" তিনি বলেন, "আমার আদর্শ মার্কেটের একটি দোকানে ৭/৮ লাখ টাকার পণ্য ছিল, কিছুই বের করতে পারিনি। এখানে একটি দোকান ২০০৫ সালে এবং আর একটি ২০১৬ সালে কিনি। ২০১৬ সালেরটা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে নেই। প্রতিটি তৈরী করতে দুই লাখ করে খরচ হয়।" তিনি জানান, "আমাদের এ মার্কেট ভেঙ্গে নতুন মার্কেট করতে অনেক আগ থেকেই কথা চলছিল কিন্তু সিটি কর্পোরেশন আমাদের দাবি কখনও মানেনি তাই ছাড়া হয়নি। কারণ আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে তো আর সিটি কর্পোরেশনকে নিজেদের টাকায় নেওয়া মার্কেট ছেড়ে দিতে পারি না।" বঙ্গবাজারে পুড়ে যাওয়া আরেকটি দোকানের মালিক মো. মেহেদী হাসান টিবিএসকে বলেন, "২০১০ সালে ২২/২৩ লাখ টাকা খরচ করে সিটি কর্পোরেশন থেকে একটি বরাদ্দ নেন আমার বাবা। ৫/৮ বর্গফুটের এ দোকানটিতে শীতের কাপড় বিক্রি হতো। মাসে ১৫ হাজার করে ভাড়া পেতাম। এ টাকাতেই আমাদের সংসারের বড় একটি খরচ চলতো। আমাদের জমানো টাকা দিয়ে দোকানটি নিয়েছিলাম।" তিনি আরও বলেন, "প্রতি মাসেই আমার বাবা দোকান মালিক সমিতির মিটিংয়ে আসতো এবং তখন দোকান ভেঙ্গে সিটি কর্পোরেশন মার্কেট করতে চায়, এমন বিষয়ে আরোচনা হতো। তবে দ্রুত মার্কেট নির্মাণ শেষে সিটি কর্পোরেশন আমরা যারা মালিক তাদের দোকান বুঝিয়ে দিবে, এমন নিশ্চয়তা দিতে না পারায় তাদেরকে কেউই মার্কেট নির্মাণের দায়িত্ব দিতে রাজি হয়নি।" শুধু আমিন পাটওয়ারি কিংবা মেহেদী হাসানই নন, বঙ্গবাজারে পুড়ে যাওয়া মার্কেটগুলোর প্রায় সকল ব্যবসায়ীদের কথা একই। তাদের দাবি তারা কখনোই সিটি কর্পোরেশন থেকে নিশ্চিয়তা পাননি মার্কেট নির্মাণ শেষে দোকান বুঝে পাওয়ার। এমনকি এ বিষয়টি সিটি কর্পোরেশনের বিগত কার্যক্রমেও উঠে এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি মার্কেটেরই নির্মাণ কাজ ঝুলে আছে কয়েক বছর ধরে। এছাড়া অধিকাংশ মার্কেটে গড়ে উঠেছে অবৈধ দোকান। মার্কেটের গাড়ি পার্কিং স্থান, টয়লেট, সিঁড়ি, ফুটপাথ, সড়কসহ বিভিন্ন স্থান দখল করে এসব দোকান গড়ে তোলা হয়েছে। মার্কেটগুলোর সমিতির নেতা ও দক্ষিণ সিটির এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বছরের পর বছর ধরে এ দোকানগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির তথ্যমতে, গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার মার্কেটের দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় ১৫ বছর আগে। সেখানে হাজারখানেক দোকান বরাদ্দ দিয়ে সিটি করপোরেশন প্রতিটি থেকে ২ লাখ করে টাকা জমাও নিয়েছে। সেই টাকা নিয়ে মার্কেট নির্মাণ না করে অন্য কাজে ব্যয় করেছে। দীর্ঘ সময় পর মার্কেটটি পুনঃনির্মাণের জন্য ২০১৮ সালে দরপত্র আহবান করে দক্ষিণ সিটি। এখনো সেই মার্কেট নির্মাণ হয়নি। কাপ্তানবাজার মুরগিপট্টির দোকানগুলো পাঁচ বছর আগে বরাদ্দ দেয় দক্ষিণ সিটি। বরাদ্দ দিয়ে সেখানে কয়েক ধাপে কিস্তির টাকাও আদায় করা হয়েছে। কিন্তু মার্কেট নির্মাণকাজে নেই কোনো অগ্রগতি। সেখানেও ৫০ থেকে ১৫০ বর্গফুটের দোকানের বিপরীতে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪ লাখ করে টাকা নিয়েছে সিটি করপোরেশন। চাঁনখারপুল মার্কেটের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে দুই বছর মেয়াদ বেধে দিয়ে তা শেষ করতে বলা হয় ২০১৯ সালের ১ অক্টোবরে। ১২ তলা ভিত্তির ওপর ছয়তলা ভবনে হবে ২৮১টি দোকান। ছয়তলা ভবন নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। প্রতিটি দোকানের আকার অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হয়েছে আয়তনভেদে ১১ থেকে ১২ লাখ টাকা। এখনো দোকান বুঝিয়ে দিতে পারেনি দক্ষিণ সিটি। গত বছর রামপুরার বনশ্রী মেরাদিয়া কাঁচাবাজার নামে একটি মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দেয় দক্ষিণ সিটি। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রথমে জামানত হিসেবে নেওয়া হয় ৪ লাখ টাকা করে। পরে দোকান বরাদ্দ দিয়ে সম্প্রতি কিস্তি হিসেবে নেওয়া হয় আরও ৩ লাখ টাকা করে। এ মার্কেটেরও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। গত কয়েক বছরে দক্ষিণ সিটি ১০টিরও বেশি মার্কেটে দোকান বিক্রি করে কয়েকশ কোটি টাকা আয় করেছে। কিন্তু দোকান বুঝে পায়নি কেউই। অনেক স্থানে মার্কেট নির্মাণ শুরুই করতে পারেনি দক্ষিণ সিটি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মার্কেট বাণিজ্য নিয়ে যখন এ হাল তখন নতুন করে কোথাও মার্কেট তৈরীর প্রস্তাব নিয়ে গেলে সেখানকার ব্যবসায়ীরা সিটি কর্পোরেশনের সাথে রাজি হতে পারছে না। ঠিক এমনটাই ঘটেছে বঙ্গবাজারের মার্কেট ব্যবসায়ীদের সাথে। ঢাকা দক্ষিণ কর্পোরেশনের চিফ এস্টেট অফিসার রাসেল সাবরিন টিবিএসকে বলেন, "সিটি কর্পোরেশন নতুন করে যেসব জায়গায় মার্কেট নির্মাণ করছে সেগুলোর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে এবং অনেক মার্কেটে দোকান বুঝিয়েও দেওয়া হচ্ছে। আগে কী হয়েছে বা কী হয়নি, সে বিষয়টি এখন বললে তো হবে না। অনেকেই আমাদের কাছে আসছে এবং তারা বলছেন তাদের মার্কেট ভেঙ্গে যাতে আমরা করে দেই।" তিনি বলেন, "গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার মার্কেটের কিছু দোকান আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি এবং বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া চাঁনখারপুল মার্কেটের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চলে যাওয়ায় কাজ থেমে যায়। বাকি মার্কেটগুলোর কাজ স্বাভাবিক গতিতে চলছে।" তিনি আরও বলেন, "আমরা হাইকোর্টের রিটের কারণে বঙ্গবাজারের মার্কেটের কাজ করতে পারিনি। আমাদের উপর আস্থা না পাওয়ার কারণ নেই ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরা যদি আমাদের কাজ করতে দিতো, হয়তো এতদিনে তারা দোকান বুঝে পেতেন।"
Published on: 2023-04-07 07:59:45.512936 +0200 CEST

------------ Previous News ------------