The Business Standard বাংলা
ব্রিটিশদের আনা সৌন্দর্যবর্ধক ঝোপগাছ যেভাবে বাঘেদের বিপন্ন করছে

ব্রিটিশদের আনা সৌন্দর্যবর্ধক ঝোপগাছ যেভাবে বাঘেদের বিপন্ন করছে

প্রায় ২০০ বছর আগে নিরীহ-দর্শন এক সৌন্দর্যবর্ধক ঝোপগাছ মধ্য আমেরিকা থেকে ভারতে আনা হয়। ব্রিটিশ শাসকদের বাগানের শোভা বাড়াতেই এই আমদানি। আর মুগ্ধ হবার মতোই ছিল তার রূপ। গাছের বয়সের সাথে সাথে ফুলের রঙ বদলায়– সাদা, হলুদ, কমলা ও গোলাপি নানান বর্ণে। কিন্তু, গাছটি আনার ৫০ বছরের মধ্যেই মারাত্মক এক ঘটনা লক্ষ করে মালিরা। তারা দেখে, এটি তার আশেপাশের স্থানীয় প্রজাতির গাছগুলোকে মেরে ফেলছে। বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম ক্ষতিকর আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভিদ হিসেবে গণ্য করা হয় এই 'ল্যান্টানা ক্যামেরা'কে। ভারতে এর নাম হয় 'রাইমুনিয়া'। বাংলায় 'পুটুস' বা 'লন্ঠন ফুলগাছ' নামেও পরিচিত। নাম আর ফুলের বাহার যেমনই হোক ল্যান্টানার ক্ষতির সীমা নেই। বর্তমানে বিশ্বের লাখ লাখ হেক্টর বিস্তৃত বনভূমি ছেয়ে ফেলেছে এই ঝোপগাছ। ২০২০ সালে এনিয়ে ভারতে একটি গবেষণাও হয়। এতে বলা হয়, দেশটির ৪৪ শতাংশ বনভূমিতে চলছে রাইমুনিয়ার আগ্রাসন। এতে জঙ্গলের বাস্তুসংস্থানের অবনতি হচ্ছে, বিপন্ন হচ্ছে জঙ্গলের রাজকীয় প্রাণী বাঘের প্রাকৃতিক আবাস। চলতি মাসে বাঘ সংরক্ষণে বিশ্বের অন্যতম সফল প্রকল্প 'প্রজেক্ট টাইগারের' - এর ৫০ সূবর্ণজয়ন্তী পালন করা হচ্ছে ভারতে। এই প্রকল্প নিশ্চিত বিলুপ্তি মুখ থেকে বাঘেদের শুধু রক্ষাই করেনি, বরং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও রেখেছে অবদান। দেশটির ৫৩টি টাইগার রিজার্ভে ২০১৮ সালে ২,৯৬৭টি বাঘ ছিল, সর্বশেষ শুমারিতে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩,৫০০টিতে। বাঘেরা বিছিন্নভাবে নিজ নিজ এলাকায় থাকে। একটি বাঘ সর্বোচ্চ ১৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে তার নিজস্ব শিকারের এলাকা ও বাসস্থান হিসেবে গণ্য করতে পারে। ল্যান্টানার মতো আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভিদের বিস্তার লাভ করায়- ভবিষ্যতে ভারতে বাঘেদের সংখ্যা হয়তো আর বাড়ানো যাবে না এমন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। 'ল্যান্টানা ক্যামেরা' বা রাইমুনিয়া নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন নিনাদ অভিনাশ মুঙ্গি। ২০২০ সালের গবেষণা নিবন্ধের প্রধান লেখকও তিনি। অভিনাশ বলেন, "ভারতে বাঘ সংরক্ষণের কাহিনির সবচেয়ে দুর্বল দিক এসব বিদেশি প্রজাতির আগ্রাসন। ল্যান্টানা স্থানীয় উদ্ভিদ ও ঘাসের প্রজাতির সাথে প্রতিযোগিতা করে- যা চিতল হরিণ, মায়া হরিণের মতো তৃণভোজী প্রাণীর খাদ্য। আগ্রাসী প্রজাতির কারণে এসব উদ্ভিদের চরম ক্ষতি হয়।" ল্যান্টানার পাতা ও শেকড়ে থাকে এক ধরনের রাসায়নিক, যা আশেপাশের অন্যান্য গাছকে মেরে ফেলে। এভাবেই জঙ্গলের বাস্তুসংস্থানে শূন্যতা তৈরি হয়। এর উগ্র গন্ধযুক্ত ফুল ও খসখসে, ধারালো পাতার কারণে হরিণও ল্যান্টানা খেতে পারে না। হরিণের পছন্দনীয় খাদ্য – স্থানীয় উদ্ভিদের প্রজাতিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে – জঙ্গলে ল্যান্টানা ঝোপের বিস্তারের সাথে সাথে। ফলে খাদ্যের জন্য ভিন্ন উৎসমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে তৃণভোজী এই প্রাণী। হরিণের সংখ্যাতেও হচ্ছে পতন। বনবিভাগের আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনেও এনিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। এমন একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, 'হরিণের খাদ্য হওয়ার উপযুক্ত উদ্ভিদের সংখ্যায় ঘাটতি এবং ল্যান্টানা ক্যামেরার বিপুল উপস্থিতির' কারণে কর্ণাটক রাজ্যের বান্দিপুর টাইগার রিজার্ভে চিতল হরিণের সংখ্যা রেকর্ড হারে কমেছে'। অথচ হরিণ বাঘের মতো মাংসাশী প্রাণীর প্রধান খাদ্য। যেখানে ল্যান্টানার উৎপাত বেশি, সেখান থেকে হরিণের দল হয় বনের অন্য এলাকায় চলে আসছে, নাহয় বনের আশেপাশের ক্ষেতে-খামারে, পশুচারণ ভুমিতে চলে আসছে। আর তাদের অনুসরণ করে বাঘও সেখানে চলে আসছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনে ল্যান্টানার বিস্তার ঠেকাতে অবিলম্বে উদ্যোগ না নিলে, আগামী দুই-এক দশকের মধ্যে বাঘের সংখ্যাবৃদ্ধি থেমে যাবে, আর তারপরেই কমতে শুরু করবে। মধ্যপ্রদেশের কানহা টাইগার রিজার্ভ ভারতের একটি বিখ্যাত ব্যাঘ্র অভয়ারণ্য। এই বনে ল্যান্টানার আগ্রাসন নিয়ে গবেষণা করেছেন রজত রাস্তোগি। তার মতে, এই সমস্যা খুবই গুরুতর। রজতের গবেষণা নিবন্ধটি চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভারতের বন্যপ্রাণী সংস্থার জার্নাল- ফরেস্ট ইকোলজি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট- এ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, "আগ্রাসী (উদ্ভিদের) প্রজাতি ভবিষ্যতে তৃণভোজী প্রাণীদের বিলুপ্তির হুমকি তৈরি করেছে। অথচ এই বনে যে রাজকীয় মাংসাশী প্রাণীরা (বাঘ) বাস করে, তৃণভোজীরা তাদের প্রধান খাদ্য উৎস।" তবে বিষয়টি বেশ জটিল বলেও ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য ইনডিপেন্ডেন্টকে বলেন রজত। যেমন মধ্য বা দীর্ঘ মেয়াদে ল্যান্টানার উপদ্রুপ বাঘের সংখ্যা কমাবে। কিন্তু, তার আগে স্বল্প মেয়াদে এটা বাঘের জন্য সুবিধাই করছে বলে জানান তিনি। "যেসব বনে ল্যান্টানা ঝোপ অনেক ঘন, সেখানে হরিণসহ অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীদের আরো বেশি সময় ধরে খাদ্যের সন্ধান করতে হয়। খাদ্য উপযোগী ঘাস বা উদ্ভিদ খুঁজতে তারা যত ব্যস্ত থাকে, ততই শিকারি প্রাণীর থেকে সতর্ক থাকার কম সময় পায়। ফলে বাঘের সহজ শিকারে পরিণত হয়।" তিনি বলছিলেন যে, "সহজে খাদ্য পাওয়ায় টাইগার রিজার্ভে থাকা বাঘেদের আরো স্বাস্থ্যবান হতে দেখব আমরা। অন্যদিকে, তৃণভোজী প্রাণীদের স্বাস্থ্যহানি ঘটবে।  কিন্তু এই অবস্থা বেশিদিন থাকবে না। শিকারের অভাবে আগামী ১০ বা ২০ বছরের মধ্যে বাঘের সংখ্যাও কমতে থাকবে। ভারতের টাইগার রিজার্ভগুলোয় এই পরিবর্তন ঠেকানো তখন অসম্ভব হবে।" তাই বন থেকে জোর প্রচেষ্টার মাধ্যমে ল্যান্টানা গাছ নির্মূল এবং সে জায়গায় স্থানীয় উদ্ভিদের প্রজাতি রোপণের প্রতি গুরুত্ব দেন রজত। ব্যাঘ্র সংরক্ষণের সাথে জড়িত নন – এমন কিছু পরিবেশ বিজ্ঞানী অবশ্য সবুজ আচ্ছাদন বাড়াতে ভূমিকা রাখায় ল্যান্টানা ঝোপের অবদান স্বীকার করেন। তাদের মতে, ফুল-সজ্জিত এই ঝোপ পাখি ও প্রজাপতির প্রজাতিগুলোর বৈচিত্র্য বাড়াচ্ছে। তামিলনাড়ুর মাদুমালাই টাইগার রিজার্ভে ল্যান্টানা নিয়ে গবেষণা করেছেন ড. গীতা রামস্বামী। এই দাবিকে তিনি মানতে নারাজ। বরং তার গবেষণা উল্টো ঘটনারই ইঙ্গিত দেয় বলে জানান। গীতা বর্তমানে ন্যাচার কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের সিজনওয়াচ প্রকল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আগ্রাসী উদ্ভিদ নিয়ে তার আগ্রহের কারণ জানিয়ে বলেন, যেসব জায়গায় এসব প্রজাতির বিবর্তন হয়নি, সেখানে তাদের অবাধ বংশবিস্তারের ক্ষমতাই আমাকে আগ্রহী করে তোলে। ল্যান্টানার প্রধান ক্ষতির দিকটি হলো- এই মনোকালচার ঝোপ স্থানীয় প্রজাতির উদ্ভিদের জায়গা দখল করে, সবুজ আচ্ছাদন বাড়ায়। আমাদের গবেষণার উপসংহার এই যে, "বনকে আমরা আজ যেভাবে চিনি তা আমূল বদলে দিতে চলেছে ল্যান্টানার আগ্রাসন'। () বিপদের গুরুত্ব বনবিভাগের কর্মকর্তারাও জানেন। তাই ভারতের রাজ্য সরকারগুলোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারও ল্যান্টানাসহ অন্যান্য আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভিদ জাতীয় উদ্যানগুলো থেকে নির্মুলের লক্ষ্যে তহবিল বরাদ্দ দিচ্ছে। কিন্তু, একাজ যেমন শ্রমসাধ্য তেমনি ব্যয়বহুল। প্রাথমিক একটি প্রাক্কলন অনুসারে, মাত্র এক হেক্টর বনভূমি থেকে ঝোপঝাড় নির্মুলে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় হয় ৮০ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার রুপি। এখানেই শেষ নয়। পরিষ্কার করা জমিতে ল্যান্টানার পুনরায় বিস্তার ঠেকাতে প্রতি তিন বছর অন্তর একাজ নিয়মিতভাবে করতে হয়। সরকারিভাবে প্রধানত কেটে ফেলার পর ল্যান্টানার ঝোপ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কিছুক্ষেত্রে শেকড়সহ উপড়ে ফেলার মতো পদক্ষেপও দেখা যায়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এসব প্রচেষ্টা মূল সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। প্রয়োজনের তুলনায় কম অর্থ বরাদ্দও যার অন্যতম কারণ। দক্ষিণ ভারতের বনগুলোয় ল্যান্টানা আগ্রাসনের একটি মানচিত্র তৈরি করেছেন তার্শ ঠিকায়েকারা।  তিনি বলেন, দক্ষিণের রাজ্য সরকারগুলো ল্যান্টানা নির্মুলে যে অর্থ ব্যয় করছে তার পুরোটাই 'জলে যাচ্ছে'। "কেবল মাদুমালাই জাতীয় উদ্যানে থাকা ৩০ হাজার হেক্টর ল্যান্টানার ঝোপ নির্মুলে ৩০০ কোটি রুপি প্রয়োজন। সে তুলনায় তামিলনাড়ুর রাজ্য সরকার ব্যয় করছে মাত্র ৫০ লাখ রুপি" - যোগ করেন তিনি। সামান্য এসব প্রচেষ্টাও টেকসইভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। পরিষ্কারের আওতায় আসা বনভূমিকে মনিটরিং করা হচ্ছে না। ফলে সেখানে আবার গজিয়ে উঠছে ল্যান্টানা। একারণে সরকারি উদ্যোগ নিয়ে হতাশ অনেক পরিবেশ সংরক্ষণবিদ। () তবে এই সংকটের একটি বিকল্প সমাধানও আছে। ১৫ বছর আগে বিকল্প পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিআর বাবু। উত্তরাখণ্ড রাজ্যের করবেট টাইগার রিজার্ভের এক পাইলট প্রকল্পে তিনি ও তার ছাত্ররা এর প্রথম প্রয়োগ করেন। 'কাট রুটস্টক' নামের এই পদ্ধতিতে ল্যান্টানা গাছের মূল শেকড় মাটির একটু নিচে কেটে দিতে হয়, তারপর উপড়ে ফেলে পুরো ঝোপটিকে উলটে ফেলে রাখতে হয়। অধ্যাপক সিআর বাবু বলেন, 'আমরা (করবেট টাইগার রিজার্ভের) ঝিরনা, লাল ধাং ও ধিকালা বাফার এরিয়ায় এই পরীক্ষা চালাই। সেখানে ব্যাপকভাবে ল্যান্টানা ঝোপের বিস্তার ঘটেছিল'। 'কাট রুটস্টক' সফল হওয়ায় বন তার স্বাভাবিক বাস্ততন্ত্র ফিরে পায়, বন্যপ্রাণের বৈচিত্র্যও বাড়ে। বাঘেদেরও নিয়মিত দেখা যেতে থাকে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি রাজ্যের সরকার টাইগার রিজার্ভগুলোয় অধ্যাপক বাবুর আবিষ্কৃত পদ্ধতিটি প্রয়োগ করছে। 'কাট রুটস্টক' পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে জাঙ্গালস্কেপস নামক একটি অলাভজনক সংস্থা বান্দিপুর টাইগার রিজার্ভের ১,২০০ হেক্টর জমি থেকে ল্যান্টানার আগ্রাসন দূর করেছে। সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা রমেশ ভেঙ্কটরামণ বলেন, "ল্যান্টানা শুধু জীববৈচিত্র্যকে দ্রুত বিপন্ন করে তোলার সমস্যা নয়, একইসঙ্গে বনে দাবানলের ঝুঁকিও বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ২০১৯ সালে বান্দিপুর রিজার্ভের এক ভয়াল দাবানলের ঘটনা উল্লেখ করেন তিনি। সেসময় ১৫,৪০০ হেক্টরের বেশি বনভূমি আগুনে ধবংস হয়। পরবর্তীতে জানানো হয়, এজন্য ঝোপঝাড়ের আগ্রাসনই দায়ী। () সরকারের ঝোপ নির্মুল পদ্ধতি ও ব্যাঘ্র অভয়ারণ্যের বাস্তুসংস্থান বিপন্নতার বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে ভারতের ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ – ন্যাশনাল টাইগার কনজার্ভেশন অথরিটির কয়েকজন সদস্যের সাথে যোগাযোগ করে দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট। কিন্তু, তারা এতে সাড়া দেননি। তবে এই সমস্যা গুরুতর, যার আশু সমাধান দরকার বলেই অনেক পরিবেশবাদী মতপ্রকাশ করেন। নিনাদ অভিনাশ মুঙ্গি জানান, তার সর্বশেষ গবেষণাটি প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তীকালে ল্যান্টানার বিস্তার আরো বেড়েছে, বর্তমানে ভারতের ৬০ শতাংশ বনে তা ছড়িয়ে পড়েছে। রজত রাস্তোগিও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, আগ্রাসী প্রজাতি হিসেবে শুধু  ল্যান্টানাই একমাত্র বিপদ নয়।  উচুন্টি (বৈজ্ঞানিক নাম-  Ageratum conyzoides) এবং জূই লতা  (Pogostemon benghalensis)-র মতোন ঝোপের প্রজাতিগুলোও টাইগার রিজার্ভের প্রাকৃতিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
Published on: 2023-05-27 16:30:30.040985 +0200 CEST

------------ Previous News ------------