The Business Standard বাংলা
‘ভোগ বিজনেস ১০০ ইনোভেটরস’ তালিকায় স্থান পাওয়া তৌহিদা শিরোপার মনের বন্ধুর গল্প

‘ভোগ বিজনেস ১০০ ইনোভেটরস’ তালিকায় স্থান পাওয়া তৌহিদা শিরোপার মনের বন্ধুর গল্প

বছর চারেক আগে সংবাদপত্রের কাজ ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন উদ্যোক্তা জীবন। চেয়েছিলেন সকল শ্রেণির মানুষের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে সহজলভ্য করতে। নিজের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান 'মনের বন্ধু'র মাধ্যমে তৌহিদা শিরোপা সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকা অসংখ্য মানুষের কাছে। আশপাশের মানুষজন তার চাকরি ছাড়ার খবর শুনে বলেছিলেন, 'মাথা খারাপ হয়ে গেছে! জীবনের সব চাইতে ভুল সিদ্ধান্তটি নিয়েছ তুমি।' কিন্তু কারও কথায় নিরুৎসাহিত হওয়ার পাত্রী ছিলেন না শিরোপা। ৩৫ জন বিশেষজ্ঞ মনোবিদসহ মোট ৭৫ জনের দল নিয়ে মনের বন্ধুর মাধ্যমে এ পর্যন্ত দুই লাখ ১০ হাজার মানুষকে দলভিত্তিক সেবা দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি স্বল্প খরচে পোশাক শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেওয়ার স্বীকৃতি হিসেবে 'ভোগ বিজনেস ১০০ ইনোভেটরস' তালিকার 'সাসটেইনেবিলিটি থট লিডারস' শ্রেণিতে জায়গা করে নিয়েছেন তৌহিদা শিরোপা। মনের বন্ধুর পথচলা আর প্রান্তিক নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নানান চড়াই-উৎরাইয়ের গল্প উঠে এসেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সঙ্গে শিরোপার এক আলাপচারিতায়। মায়ের অসুস্থতা থেকে শুরু '২০১৫ সালের দিকে হঠাৎ করেই আমার মায়ের খুব শরীর খারাপ হতে থাকে। অনেক বেশি চুপচাপ হয়ে গেছিলেন তিনি, কথা বলতেন না কারও সাথে। জ্বর বা অন্য কোনো অসুখ-বিসুখ হলেও ভালো হচ্ছিল না। চিকিৎসকেরা কোনো রোগও ধরতে পারছিলেন না। মাসখানেক পর একজন ডাক্তারের পরামর্শে আমরা আম্মুকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাই। অ্যাকিউট ডিপ্রেশন ধরা পড়ে তার,' বলছিলেন তৌহিদা শিরোপা। মায়ের গুরুতর বিষণ্ণতা ধরা পড়ায় নিজেও বেশ মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি। এ নিয়ে পরিবারের কারও পূর্ব অভিজ্ঞতাও ছিল না। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পরিবারের সবাই পুরো জীবনযাত্রাই বদলে ফেলেছিলেন তখন। মাকে সাহায্যের জন্য মানসিক অবসাদ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন শিরোপা। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রাথমিক বিষয়সমূহের ওপর ডিপ্লোমা ডিগ্রিও নেন তিনি। নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে ১৪ মাস পর মানসিক অবসাদ থেকে সারিয়ে তুলতে পারেন তার মাকে। এ সময়টাতেই মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারেন তৌহিদা শিরোপা। তার ভাষ্যে, 'নিজেকে যেখানে অনেক জানা-বোঝা মানুষ ভাবতাম, সেখানে দেখলাম কিছুই জানিনা। তাহলে নিশ্চয়ই এরকম অসংখ্য মানুষ আছেন যারা বুঝতে পারেন না এ পরিস্থিতিতে কোথায় যাবেন, কী করবেন। তাদের গোপনীয়তা বজায় রেখে সর্বোচ্চ সহযোগিতা পাবেন কি না এমন নিশ্চয়তাও পান না কোথাও। এর পাশাপাশি অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিকে যারা দেখাশোনা করেন তাদেরও যে সহযোগিতা দরকার, সেটিও কেউ বুঝতে পারেন না। মানসিক স্বাস্থ্যের এ বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা বাড়াতেই মনের বন্ধু শুরু করার চিন্তা করি।' মনের বন্ধুর মূল পরিকল্পনা শুরু হয় ২০১৬ সালে। তখন থেকেই রেডিও, ফেসবুক পেজ আর নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা ছড়াতে শুরু করে মনের বন্ধু। পরের বছর থেকে স্কুল-কলেজে গিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝাতে শুরু করেন তারা। ২০১৮ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের স্টার্টআপ বাংলাদেশের এক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হন শিরোপা ও তার দল। প্রতিযোগিতা থেকে পাওয়া পুরষ্কারের তহবিল দিয়েই মনের বন্ধুর কাজ এগিয়ে নেওয়ার সাহস পান তৌহিদা শিরোপা। ২০১৯ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে শুরু করেন মনের বন্ধুর কার্যক্রম। বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যায় বিশেষজ্ঞ কাউন্সেলিং সেবা ও পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে মনের বন্ধু। অনলাইন ও সরাসরি দুইভাবেই কাউন্সেলিং করে তারা। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে মেটা'র সঙ্গে পার্টনারশিপও রয়েছে মনের বন্ধুর। মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব নিয়ে নিয়মিত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রশিক্ষণের আয়োজন করে এ প্ল্যাটফর্মটি। আত্মহত্যা প্রতিরোধে তাদের কার্যক্রম চলছে দেশের ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়াও স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সহায়তা, প্রান্তিক অঞ্চলে দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ ও জেন্ডার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে মনের বন্ধু। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রফেশনাল কাউন্সেলিং সেবা নেওয়া যায় ৫০০ থেকে ১,৫০০ টাকায়। শিক্ষার্থী ও সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে ডিসকাউন্টের সুবিধা। এ বছরের শুরু থেকে 'মনের বন্ধু' নামক মোবাইল অ্যাপ চালু করেছেন তারা। পোশাক শ্রমিকদের জন্য টপ-আপ কার্ড দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম কারিগর তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকেরা। যাদের বড় অংশই নারী শ্রমিক। এ শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবা দিতে কাজ করছে মনের বন্ধু। শিরোপার ভাষ্যে, 'পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কাজ করার আগে অনেক গার্মেন্টস মালিকদেরই ধারণা ছিল তারা হয়তো কেবল বেতন-ভাতা নিয়েই কথা বলতে চাইবে। কিন্তু সরাসরি কাজ করতে গিয়ে পুরোপুরি বিপরীত দৃশ্যই দেখতে পেয়েছি আমরা। শ্রমিকেরা তাদের পরিবার, সন্তানসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা ও মানসিক অবসাদে ভোগেন বেশিরভাগ সময়। আমাদের সঙ্গে এসব সমস্যা নিয়ে মন খুলে কথা বলতে পারেন তারা।' তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের কাছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করার উদ্যোগ নেওয়ায় বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড টমি হিলফিগারের আয়োজনে 'টমি হিলফিগার ফ্যাশন ফ্রন্টিয়ার চ্যালেঞ্জ-২০২২'-এর বিজয়ী হয়েছে মনের বন্ধু। বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দিতে দেশের ৭৫টির বেশি তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার সঙ্গে কাজ করছে শিরোপার দল। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৭ হাজার পোশাক শ্রমিককে একক মানসিক কাউন্সেলিং সেবা দিয়েছেন তারা। সম্প্রতি পোশাক শ্রমিকদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করতে সুলভ মূল্যে টপ-আপ কার্ড চালু করেছে মনের বন্ধু। ২৯ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকার ভেতর পাওয়া যাবে এ কার্ড। নিজেদের কর্মস্থল থেকে এ টপ-আপ কার্ড সংগ্রহ করে অনলাইনে কাউন্সেলিং সেবা গ্রহণ করতে পারেন পোশাক শ্রমিকেরা। প্রান্তিক নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা খুলনা, সাতক্ষীরার উপকূলবর্তী অঞ্চল, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিনিয়িত বিপর্যস্ত হয় সাধারণ জীবন, সেসব জায়গায় নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে মনের বন্ধু। সৈয়দপুর-রংপুরের দলিত সম্প্রদায় ও নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়েও কাজ করছেন তারা। 'প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর সমস্যা শহরের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতিও ভিন্ন। যে ভাষায় বা যে পদ্ধতিতে শহরের শিক্ষিত মানুষদের বোঝাতে পারব সেই একই পদ্ধতিতে কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বোঝানো যাবে না। তাই যেকোনো প্রান্তিক এলাকায় যাওয়ার আগে সেখানকার পরিবেশ অনুযায়ী রিসার্চ করে সচেতনতা কার্যক্রম সাজিয়ে নিয়ে যাই আমরা। প্রান্তিক নারীদের শুরুতেই বিশ্বাস করাতে হয় যে আমরা তাদের সমস্যাগুলো বুঝতে পারছি,' বলেন শিরোপা। বিশ্বজুড়ে সম্মাননায় ভূষিত মনের বন্ধুর কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে-বিদেশে অসংখ্য পুরষ্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন শিরোপা ও তার দল। উল্লেখযোগ্য সম্মাননাগুলোর তালিকায় ভোগ বিজনেস ১০০ ইনোভেটরস তালিকা, টমি হিলফিগার ফ্যাশন ফ্রন্টিয়ার চ্যালেঞ্জ জয় ছাড়াও রয়েছে ২০২২ সালের ইউএন–উইমেন এশিয়া–প্যাসিফিক অ্যাওয়ার্ড ফর জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি, জিজিইএস ইকো গেম চেঞ্জার অ্যাওয়ার্ড, ২০২১ সালের কমনওয়েলথ ডিজিটাল হেলথ অ্যওয়ার্ড, ২০২০ সালের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগে কল ফর নেশন অ্যাওয়ার্ড। অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির তালিকা লম্বা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের জায়গা আরও কঠিন হচ্ছে বলে মনে করেন তৌহিদা শিরোপা। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো বিশ্বের মানুষের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে সুলভ করতে করতে চায় মনের বন্ধু। শিরোপার ভাষ্যে, 'পৃথিবীব্যাপী যেকোনো মানুষের মন খারাপের দিনে যেন সর্বপ্রথম মনের বন্ধুর নামটা মাথায় আসে, সে লক্ষ্যেই কাজ করছি আমরা।'
Published on: 2023-09-20 07:32:39.638465 +0200 CEST

------------ Previous News ------------