The Business Standard বাংলা
বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের বকেয়া পরিশোধের পথ খুঁজে পেয়েছে সরকার

বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের বকেয়া পরিশোধের পথ খুঁজে পেয়েছে সরকার

ভর্তুকি বকেয়া থাকার কারণে স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) এবং সার আমদানিকারকদের ব্যাংকে জমে যাওয়া দায় নিষ্পত্তির জন্য স্পেশাল বন্ড ইস্যু করা শুরু করেছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী, সার আমদানিকারক এবং ব্যাংকগুলোকে তাদের দেনা-পাওনার হিসেব স্বাভাবিক করতে সহায়তা করা। এজন্য বিদ্যুৎ বিভাগ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে কোন ব্যাংকে আইপিপি কোম্পানি ও সার আমদানিকারকদের দেনা কত তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়া এসব বন্ডের মেয়াদ এবং সুদের হার নির্ধারণসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে সরকারের পক্ষে বন্ড ইস্যুয়ার হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধি, বিদ্যুৎ বিভাগ, ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। গত সপ্তাহে কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগকে 'খুবই ভালো' বলে উল্লেখ করেন বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড কে বলেন, 'এতে সরকারের তাৎক্ষণিক অর্থঘাটতি কেটে যাবে, ব্যাংক ও আইপিপিগুলোও কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে।' সোনালী ব্যাংকের সিইও এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম টিবিএস কে বলেন, স্পেশাল বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকের দায় নিষ্পত্তি করা একটি ভালো ধারণা। এতে ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন সূচকের উন্নতি ঘটবে এবং ঋণ দেওয়ার ক্ষমতাও বাড়বে। তিনি বলেন, বন্ডের কুপন রেট মার্কেট রেট অনুযায়ী নির্ধারণ করা হলে ব্যাংকগুলো এ নিয়ে কোনো আপত্তি তুলবে না। এ বিষয়ে কমিটির প্রধান এবং অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মফিদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ)-এর হিসেব অনুযায়ী, সরকারের কাছে আইপিপিগুলোর পাওনা বকেয়া ভর্তুকির পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এসব কোম্পানির ব্যাংকে দেনার পরিমাণ কত, তা জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। সম্ভাব্য বিস্তারিত অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কোনো আইপিপি কোম্পানির সরকারের কাছে ১০০ কোটি টাকা ভর্তুকি বকেয়া থাকার কারণে যদি ওই কোম্পানির ব্যাংকে ১০০ কোটি টাকার দায় সৃষ্টি হয়, তাহলে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে সরকার ওই ব্যাংককে সম্পূর্ণ ১০০ কোটি পরিশোধ করবে। এতে ওই আইপিপি যেমন ব্যাংকের দেনা থেকে রেহাই পাবে তেমনি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থানও দুর্বল হবে না। কিন্তু আইপিপি কোম্পানিটির যদি ব্যাংকে দেনার পরিমাণ ২০০ কোটি টাকা হয়, সেক্ষেত্রে সরকার বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ১০০ কোটি টাকা (বকেয়া ভর্তুকির সমপরিমাণ) অর্থ পরিশোধ করবে। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, যদি কোনো আইপিপি'র বকেয়া ভর্তুকির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা এবং ওই কোম্পানির ব্যাংকে দেনার পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা হয়, তাহলে সরকার বন্ড ইস্যু করে ওই ব্যাংককে ৫০ কোটি টাকা দেবে। বকেয়া ভর্তুকির বাকি ৫০ কোটি টাকা এখনকার মতো ধীরে ধীরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)-এর মাধ্যমে আইপিপি কোম্পানিকে দেওয়া হবে। স্পেশাল বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে আইপিপিগুলোর পুরো বকেয়া পরিশোধ না করে কেবল ব্যাংকের দায় সমন্বয়ের উদ্যোগ যৌক্তিক হবে না বলে উল্লেখ করেন বিআইপিপিএ-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম। টিবিএস কে তিনি বলেন, সরকারের উচিত বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে আইপিপিগুলোর সম্পূর্ণ বকেয়া বিল পরিশোধ করা। 'শুধু ব্যাংকের দায় পরিশোধ করা হলে যার দেনা বেশি, তারা বেশি লাভবান হবে। ভালো কোম্পানি, যারা কষ্ট করে অন্যান্য উৎস থেকে অর্থ নিয়ে ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করে আসছে, সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।' গত অর্থবছরে বিদ্যুতের ভর্তুকি বেড়ে হয়েছিল ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা এখনো ছাড় দেওয়া হয়নি। এদিকে চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে নতুন ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। সাবেক অর্থসচিব মুসলিম চৌধুরী টিবিএস কে বলেন, এই স্পেশাল বন্ড ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি করতে পারবে না। ব্যাংকগুলোর কস্ট অভ ফান্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে যদি এই বন্ডের সুদহার নির্ধারণ করা না হয়, তাহলে ব্যাংকগুলোর খুব বেশি লাভ হবে না। 'বন্ডের সুদহার কম হলে ব্যাংকের কস্ট অভ ফান্ড রিকভার হবে না,' বলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে সরকারের দিক থেকে লায়াবেলিটি ডেফার করে হবে। 'এ ধরনের বন্ড ইস্যুর পর সেগুলো পরিশোধ করা না হলে সরকারের ঋণ পরের প্রজন্মের কাছে স্থানান্তর করা হচ্ছে।' সার আমদানির দায় মেটাতে পারছে না বিসিআইসি গত জুন পর্যন্ত আমদানি করা ইউরিয়ার ভর্তুকি বাবদ আট হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা বকেয়া আছে সরকারের। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) কাউন্টার গ্যারান্টি সীমা অতিক্রম করায় এলসি খোলা সম্ভব হবে না বলে জানিয়ে গত ২১ নভেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। সার আমদানির জন্য সরকার সাধারণত ব্যাংকগুলোকে কাউন্টার গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। গ্যারান্টির বিপরীতে ব্যাংকগুলো ছয় মাস মেয়াদে এলটিআর (ট্রাস্ট রিসিপ্টের বিপরীতে ঋণ) সৃষ্টির মাধ্যমে সারের মূল্য পরিশোধ করে। ইতোমধ্যে চলতি ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সোনালী, জনতা, বাংলাদেশ কৃষি এবং অগ্রণী ব্যাংকের অনুকূলে ১৫ হাজার কোটি টাকার কাউন্টার গ্যারান্টি ইস্যু করেছে সরকার। তবে এরই মধ্যে ব্যাংকগুলোর কাছে বিসিআইসি'র ঋণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। তার মধ্যে তিন হাজার ১৬৭ কোটি টাকার ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ দায় বা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি ঋণগ্রহীতার অনুকূলে নতুন ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের কারণে ব্যাংকগুলো নতুন করে এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না। এছাড়া সরকারের কাউন্টার গ্যারান্টির সীমা অতিক্রম করলে কোনো ব্যাংকেই আর এলসি খোলা সম্ভব হবে না। এ কারণে ভর্তুকির বকেয়া টাকা জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। বিসিআইসি জানিয়েছে, গত ২ নভেম্বর সৌদি আরব থেকে ৩০ হাজার টন সারের এলসি খোলার আবেদন করলেও খেলাপি ঋণ থাকায় প্রথমে সাড়া দেয়নি সোনালী ব্যাংক। পরে বারবার যোগাযোগ এবং অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ বিবেচনায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে গত ৯ নভেম্বর এলসি খোলা হয়।
Published on: 2024-01-01 07:52:52.364844 +0100 CET

------------ Previous News ------------