The Business Standard বাংলা
‘ভিলেজ অব চিটাগং ১৮৩৭’: একটি ঐতিহাসিক দাঙ্গা এবং পেন্সিলে আঁকা ছবির গল্প

‘ভিলেজ অব চিটাগং ১৮৩৭’: একটি ঐতিহাসিক দাঙ্গা এবং পেন্সিলে আঁকা ছবির গল্প

[রাজনৈতিক ইতিহাসের ডামাডোলে আমাদের সামাজিক ইতিহাসের ছোট ছোট অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাখ্যান হারিয়ে গেছে, যেগুলো আর কখনোই উদ্ধার করা যাবে না। উনিশ শতকের দক্ষিণ চট্টগ্রামে সে রকম হারিয়ে যাওয়া একটি উপাখ্যানকে গল্পের ছলে উদ্ধার প্রচেষ্টা। যে গল্পের সবটুকু ইতিহাস নয়, আবার সবটুকু কল্প নয়। দেশীয় চরিত্রগুলো বাদ দিলে বিদেশি চরিত্রগুলো ঐতিহাসিক সত্যের অংশ] *উড়ো সংবাদ* হেমন্তের কুয়াশা যেমন বিস্তীর্ণ প্রান্তরের উপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে ঘাসের ডগার কানে কানে আসন্ন শীতের বার্তা পৌঁছে দেয়, চাটগাঁ শহর থেকে উড়ে আসা সংবাদটিও তেমনি কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরের মানুষদের কানে অনাগত এক দুর্যোগের সংকেত পৌঁছে দিল। এ ধরনের খবরগুলো মুখ থেকে মুখে ছড়ানোর সময় ডালপালা বিস্তার করতে থাকে। এক কান থেকে অন্য কানে স্থানান্তরিত হবার সময় আকার-আকৃতি যেমন বদলাতে থাকে, তেমনি আয়তনেও বাড়তে থাকে গুণিতক হারে। মাঝে মাঝে দেখা যায় আসল খবর হারিয়ে গিয়ে আরেকটা নতুন খবরে রূপান্তরিত হয়েছে। কোনো কোনো গন্তব্যে এ সংবাদটিও সেই দশাপ্রাপ্ত হয়েছিল। আসল ব্যাপার কিন্তু সত্যিই গুরুতর। চট্টগ্রামের নতুন কমিশনার হার্ভে সাহেবের হঠাৎ ঘোষণাÑএখন থেকে জমির খাজনা চার গুণ বেশি গুনতে হবে। প্রচলিত বিশ গণ্ডায় কানির হিসেব বদলে আঠারো গণ্ডায় কানি হবে। আইন অমান্য করলে জেল, জরিমানা, জমি ক্রোক। ৭৬ বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রাম শাসন শুরু করার পর এই প্রথম বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল চট্টগ্রামের মানুষ। ঘটনার বিস্তারিত জানার জন্য আমাদের যেতে হবে পটিয়ার হুলাইন গ্রামের রাইসুদ্দিন খন্দকারের উঠোনে। *শান্তির জনপদে উত্তাপ* বহুকাল আগে শায়েস্তা খাঁর আমলে মগ ধাওনির পর থেকে আরাকানি অত্যাচার থেকে রক্ষা পেয়ে পটিয়ার হুলাইন গ্রামের মানুষেরা কয়েক পুরুষ ধরে মোটামুটি শান্তিতেই বসবাস করছিল। বেধড়ক মার খেয়ে আরাকানিরা পালিয়ে নাফ নদীর দক্ষিণে চলে গিয়েছিল। শত বছরের অত্যাচারিত কৃষককুল যেভাবে মগ ধাওনিতে অংশ নিয়েছিল, সেসব গল্পের অংশবিশেষ এখনো বংশপরম্পরায় টিকে আছে। মোগল শাসন জারির থেকে কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীর মোটামুটি শান্তির জনপদ। বাইরের দুনিয়ার তেমন কোনো খবর এখানে এসে পৌঁছায় না। মোগল বাদশার রাজত্ব শেষ হয়ে কোম্পানি শাসন শুরু হবার ব্যাপারটা গ্রামের মানুষ জেনেছিল বহুদিন পর। শাসকদের সাথে কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো রকম সম্পর্ক না থাকায় পরিবর্তনের তেমন কোনো প্রভাবও পড়েনি কৃষকদের মধ্যে। কোম্পানির সাথে তাদের কোনো লেনদেন নেই। তাদের সব কাজকারবার সালিস-বিচার থেকে খাজনাপাতি সবকিছুর গন্তব্য রাইসুদ্দিন মাতব্বরের উঠোন পর্যন্ত। সাধারণ মানুষের কাছে রেঙ্গুন, আকিয়াব, কলকাতা, বিলাত, দূরবর্তী নক্ষত্রের মতো। এমনকি কাছের শহর চাটগাঁর সাথেও তাদের তেমন যাতায়াত নেই। খাজনা বৃদ্ধির ব্যাপারটা পুরো চট্টগ্রামের মাথাব্যথা হলেও প্রথম তোলপাড়টা রাইসুদ্দিন খন্দকারের উঠোনে শুরু হবার পেছনে একটা ঘটনা আছে। প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসে ধান ওঠার সময় রাইসুদ্দিনের উঠোনে সম্পন্ন মানুষেরা বসে হুক্কা টানতে টানতে গল্প গুজব করে, পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা করে, নানান কূটকাচালি করে। সেই সব আড্ডায় দেশ দুনিয়ার নানান কাহিনির টুকরো-টাকরা অংশও ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যায়। এই গ্রামে রাইসুদ্দিন খন্দকার একমাত্র মানুষ চাটগাঁ শহরে যার নিয়মিত যাতায়াত আছে। তিনি মাসে, দুই মাসে একবার শহরে গিয়ে ঘুরে আসেন। সঙ্গে যায় তার ডান হাত আজহারউদ্দিন। আজহারের কথা একটু পরে আসছে। রাইসুদ্দিনের পরিচয়টা আরেকটু খোলাসা হোক। আঠারো শতকে মোগল শাসনের শেষ দিকে রাইসুদ্দিনের পিতামহ হাসমত খন্দকার চাটগাঁ শহরের এক মোগল থানাদারের কর্মচারী ছিলেন। রজু খাঁ নামের সেই থানাদারের সাথে সম্পর্কের সুবাদে তিনি অনেক জমিজমা টাকাকড়ির মালিক হয়েছিলেন। সেই আমলে চাটগাঁ শহরের সাথে হুলাইন গ্রামের একমাত্র সংযোগ ছিল হাসমত খন্দকার। তার কাছ থেকে গ্রামের মানুষ একদিন জানতে পেরেছিল দেশের রাজা বদলে গেছে। নতুন রাজা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। লোকমুখে শুধুই 'কোম্পানি'। কোম্পানি আমলের শুরুতে হাসমত খন্দকার কোনো একটা অনাগত দুর্দিনের আশঙ্কা করে শহরের পাঠ চুকিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিলেন। একমাত্র পুত্র শফিউদ্দিন খন্দকারকে কোনো দিন শহরে যেতে দেননি তিনি। রাইসুদ্দিনের জন্মের কয়েক বছর পর একদিন ভেদবমি করতে করতে মরে গেল শফিউদ্দিন খন্দকার। শিশু রাইসুদ্দিন তখন থেকে পিতামহের ছায়াতেই বেড়ে উঠতে থাকে। পিতামহের মৃত্যুর পর বিষয়-সম্পদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে এলে শহরে যাতায়াত শুরু রাইসুদ্দিনের। জমিদারি কায়দায় গ্রামের পাশের খালে একটা বজরা নৌকা বাঁধা থাকে সব সময়। ছগির মাঝির সাথে আরও দুই মাল্লা সেই বজরা পরিচালনা করে। বজরায় রাত্রিযাপনসহ নানান আরাম-আয়েশের বন্দোবস্ত আছে। উত্তরাধিকারসূত্রে রাইসুদ্দিন গ্রামের অঘোষিত জমিদার। কিন্তু তিনি কোনো লাঠিয়াল পোষেন না কিংবা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়েও চলাফেরা করেন না। তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী আজহারউদ্দিন নামের এক যুবক। দূর সম্পর্কের আত্মীয় আজহারের বাড়ি হুলাইন থেকে আঠারো ক্রোশ দক্ষিণে আজিমপুর গ্রামে। কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় জমিদারবাড়িতে। রাইসুদ্দিনের বোনের শ্বশুরবাড়ি ওই গ্রামের খন্দকারবাড়িতে। সেখান থেকে হুলাইন গ্রামে আজহারের আগমন তার সহকারী কিংবা দেহরক্ষী হিসেবে। একুশ বছর বয়সী আজহারের দৈহিক শক্তির মতো বিষয়বুদ্ধিও বেশ ভালো। জমিজমা, খাজনা, মামলা-মোকদ্দমা সবকিছুতে রাইসুদ্দিন তার উপর নির্ভর করে। আড়ালে তাকে রাইসুদ্দিনের সেনাপতি বলে ডাকা হয়। সম্পর্কে আত্মীয় হওয়াতে তার সাথে রাইসুদ্দিন  খন্দকারের সম্পর্ক ঠিক মনিব-কর্মচারী নয়। বয়সের তারতম্য থাকা সত্ত্বেও সম্পর্কটিতে সৌহার্দ্যের অভাব নেই। জমিদার পরিবারের সাথে আজহারের ঘনিষ্টতা সেটাকে আরও পোক্ত করেছে। রাইসুদ্দিনকে মাঝে মাঝে শহরে যেতে হয় বৈষয়িক কাজকর্ম সারার জন্য। কাজ সেরে ফেরার পথে চকবাজার থেকে নানান বিলাসবহুল জিনিসপত্র কেনাকাটা করেন তিনি। চকবাজারে কুজরা নামে পরিচিত এক জাতের দুষ্ট লোকের উৎপাত আছে। এরা হলো সংঘবদ্ধ ঠগবাজ, যারা গ্রাম থেকে আসা সম্পন্ন লোকদের ঠকিয়ে জোর করে বাজে জিনিস কিনতে বাধ্য করে। তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে তিনি আজহারকে সাথে রাখেন। যেকোনো ঝামেলায় আজহারের বিশ্বস্ততা এবং বিচক্ষণতা দুটো নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট। কিন্তু রাইসু মাতব্বরের শহরে যাওয়া-আসার পেছনে আরও একটা গোপন ব্যাপার আছে। আজহারউদ্দিন বাদে আর কেউ জানে না সেটা। মাঝে মাঝে চাঁপাকলি নামের এক বাইজির বাড়িতে রাত কাটায় রাইসুদ্দিন খন্দকার। রাইসুদ্দিনের সেই একান্ত সময়ে আজহার তার সঙ্গী হয় না। সে তখন বজরাতে রাত কাটায়। নৌকার মাঝি-মাল্লারা জানে রাইসু মাতব্বর জমিজমা দলিলপত্র করার কাজে মোক্তারের বাড়িতে রাত কাটাবে। আজহার তখন বজরার সম্রাট হয়ে সময়টা নিজের মতো উপভোগ করে। সেদিনও শহরে রাত কাটাতে গিয়েছিল রাইসু মাতব্বর। কিন্তু সকালে চাঁপাকলির বাড়ি থেকে ফেরার পর দেখা গেল মুখটা ভয়ানক গম্ভীর। চোখ দুটো টকটকে লাল। চুল উস্কোখুস্কো। রাতে ঘুম হয়নি বোঝা যাচ্ছে। গুরুতর কোনো ব্যাপার ঘটেছে নিশ্চয়ই। রাইসুদ্দিন খিটখিটে ধরনের লোক নয়, কিন্তু গাম্ভীর্যের ধরন দেখে আজহার কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। নৌকা যখন কর্ণফুলী নদী পার হয়ে বোয়ালখালী খালের মধ্যে প্রবেশ করল, তখন রাইসুদ্দিন খন্দকার মুখ খুললেন। চাঁপাকলি বাঈজি হলেও তার বাড়িতে শহরের অনেক উচ্চপদস্থ লোকদের যাতায়াত আছে। সেই সূত্রে নানান ঘাটের খবর তার মাধ্যমে এদিক-সেদিক প্রচারিত হয়। রাইসুদ্দিন মাতব্বর তার অন্যতম পছন্দের খদ্দের। ফলে কাচারির নানান গোপন খবর তার কাছ থেকেই আগাম পেয়ে যায় রাইসুদ্দিন। চাঁপাকলির কাছ থেকে জানা গেছে, চট্টগ্রামের নতুন কমিশনার পুরো জেলা নতুন করে জরিপ করাবেন। খাজনার পরিমাণ বাড়িয়ে চার গুণ করা হবে এবং বিশ গণ্ডার বদলে আঠারো গণ্ডায় কানির হিসেব হবে। মোগল আমলে খাজনা আদায় পদ্ধতিটা ছিল নড়বড়ে। তাতে যেমন জোরজবরদস্তি ছিল না, তেমনি বকেয়া খাজনা নিয়েও তেমন মাথাব্যথা ছিল না। এই ঢিলেমির কারণে অনেকে খাজনা দিতেও ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু কোম্পানি আমল শুরু হবার পর থেকে কড়ায়-গণ্ডায় খাজনা আদায় করা হয়। তাতেও অধিকাংশ জমির মালিকের তেমন আপত্তি ছিল না। কিন্তু বাড়তি হারে খাজনা আদায় এবং জমির পরিমাপ পদ্ধতি বদলে যাবার কথাটা কৃষকের জন্য ভয়ানক দুঃসংবাদ হয়ে এল। এমনিতে গত কয়েক বছর বন্যা, খরা, পোকামাকড়সহ নানান উৎপাতে ফসল উৎপাদন কমে গিয়েছিল। সম্পন্ন কৃষকেরাও হাহাকার করছিল সংকটে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে কাচারি থেকে সদ্যপ্রাপ্ত এই দুঃসংবাদ রাইসুদ্দিন খন্দকারের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। খবরটা জমিদারের কাছে পৌঁছানোর জন্য আজহারকে সে রাতেই আজিমপুর পাঠিয়ে দেয়া হলো। এই সংবাদের জেরে রাইসুদ্দিন খন্দকারের উঠোনে এবারের অগ্রহায়ণের ধান জমায়েত পরিণত হয়েছে কৃষক সমাবেশে। কয়েক দিনের মধ্যেই খবরটা হুলাইন ছাড়িয়ে সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। পটিয়া থেকে আনোয়ারা সর্বত্র অঘ্রাণ-পৌষের ঠান্ডা হাওয়া উত্তপ্ত হয়ে থাকল। বিষয়টা চূড়ান্ত হবার আগে ইংরেজ কর্তাদের সাথে একটা আপসরফার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে বিপদটা চিরস্থায়ী হয়ে চেপে বসবে ঘাড়ের ওপর। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সব জমিদার আর জোতদার সম্মিলিতভাবে শহরে গিয়ে কাচারিতে হাজির হলো। কিন্তু কমিশনার হার্ভে সাহেব একরোখা মানুষ। কোনো কথা শুনতে রাজি হলেন না তিনি। প্রয়োজন হলে তিনি নেটিভদের পেট কেটে খাজনা আদায় করবেন। জমিদার ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের কাচারি থেকে প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হলো। অপমানে ফুঁসতে ফুঁসতে গ্রামে ফিরে গেল জমিদার-জোতদারের দল। *পাহাড়চূড়ায় বাগানবাড়ি* আরও বছরখানেক আগের কথা। আজহার তখন সবেমাত্র শহরে যাওয়া শুরু করেছে। রাইসুদ্দিনের সাথে নগর ভ্রমণ তার সব সময়ের প্রিয়। গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনে শহরের ভূমিকা খুব নগণ্য। অধিকাংশ সম্পন্ন লোকেরা ফুর্তি করার জন্য শহরে যায়। শহর-বন্দরে ভিনদেশি নানা জাতি-ধর্মের মানুষের আনাগোনা। মগ ফিরিঙ্গিদের বংশধরেরাও আছে। বাজার-হাটে দুষ্ট লোক গিজগিজ করে। গ্রামের ভদ্রলোকেরা সেখানে বাড়ি করে না। আমজনতার কাছে শহরের সুনামের চেয়ে বদনামের ভাগই বেশি। এসব বদনামে আজহারের কিছু যায় আসে না। কারণ, এই বয়সের যুবকরা যেসব ফুর্তির জন্য হন্যে হয়ে থাকে, আজহারের মধ্যে সেগুলোর প্রভাব নেই। তাকে শহরে যেতে হয় রাইসুদ্দিন খন্দকারের বৈষয়িক ব্যাপারে বিশেষ দায়িত্ব পালন করার জন্য। জমিজমার দলিল-দস্তাবেজ আগলে রাখা তার প্রধান কাজ। দেশ-বিদেশ ঘোরার একটা গোপন শখও আছে তার। বন্দরে নোঙর করে থাকা বিদেশি জাহাজগুলো তাকে হাতছানি দেয় প্রায়ই। সুযোগ পেলে একদিন ওই জাহাজে চড়ে ভিনদেশ দেখারও ইচ্ছে আছে। আপাতত সে সুযোগ নেই বলে রাইসুদ্দিন খন্দকারের সৌখিন বজরায় রাত্রিযাপন করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায়। রাইসুদ্দিনের বজরা যখন বোয়ালখালি খাল পেরিয়ে কর্ণফুলী নদীতে পড়ে, তখন দূর থেকে শহরের পাহাড়-টিলাগুলো দৃশ্যমান হয়। টিলার উপর সাহেবদের ছোট ছোট বাংলো বাড়ি। ইট-সুড়কি ফেলে কয়েকটা নতুন রাস্তা তৈরি হয়েছে শহরের নানান জায়গায়। সেসব রাস্তা দিয়ে পালকি, টনজন, ঘোড়ার গাড়ি চলে। বেহারার কাঁধে রঙিন থানজানে বসে থাকে মেমসাহেব আর তাদের পরীর মতো বাচ্চাগুলো। বড়লোকেরা হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে চলে। দেখতে খুব ভালো লাগে আজহারের। এই শহরের আসল সৌন্দর্য সবুজ পাহাড়গুলো। পুরো শহরের এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে জঙ্গলঘেরা সুন্দর সুন্দর টিলা। টিলার ওপর জঙ্গল কেটে ফাঁকে ফাঁকে তৈরি হয়েছে ঘরবাড়ি। লাল সাদা রং করা সেই সব বাড়িতে বিলেতি সাহেবদের বসবাস। আজহার ভাবে, সাহেবরা সব উঁচু জায়গায় বাড়ি করে কেন? টিলার ওপর যত বাড়ি, সবগুলোই সাহেব নিবাস। পাহাড়ের ওপর বাড়িঘর দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি ক্ষমতার প্রতীকও বটে। বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আজহার অবশ্য তাদের ক্ষমতার উৎস খোঁজার চেষ্টা করে না। সে আজন্ম জেনে এসেছে শ্বেতাঙ্গরাই দেশ শাসন করবে, নেটিভরা শুধু আদেশ পালন করবে। শ্বেতাঙ্গ মানে রাজবংশ। রাজার সেবা করার জন্যই প্রজাদের জন্ম। চাক্তাই খাল দিয়ে যখন নৌকাটা শহরে প্রবেশ করে, তখন ডান দিকে মাইলের পর মাইল ধূ ধূ চর কর্ণফুলীর তীরজুড়ে। লম্বা লম্বা ঘাস আর আগাছার জঙ্গল বাদে আর কিছুই নেই। অথচ বাম তীরে বাড়িঘর দোকানপাটে ঠাসাঠাসি শহর। সম্পূর্ণ বিপরীত একটা দৃশ্য। খালটা শহরের পেটের ভেতর দিয়ে উত্তর দিকে চলে গেছে। মোহনা থেকে কয়েক মাইল উত্তর দিকে যাবার পর চন্দনপুরা বাজার। সেটা পেরিয়ে খানিকটা গেলেই চকবাজার। ওখানেই কোম্পানির ঘাট। এটাই শহরের মূল বাণিজ্য কেন্দ্র। যাবতীয় আমদানি-রপ্তানির কাজ এই ঘাট দিয়েই চলে। যাত্রী নামার জন্য একটা ঘাট, মালামালের জন্য আরেকটা ঘাট আছে। রাইসুদ্দিন সব সময় মূল ঘাট থেকে কয়েক শ গজ উত্তরে গিয়ে নিরিবিলি জায়গা বেছে বজরা রাখে। জাফরের পুলের পাশে একটা বড় অশ্বত্থগাছ আছে। নৌকাটা তার ছায়াতে রাখে। এই ঘাটের কাছে কাস্টমসের জেটি। একটা টিলার ওপর কালেক্টরের অফিস। রাস্তার অন্য পাশে জঙ্গলাবৃত পাহাড়ের উপর কাচারি। কাচারির সামনের রাস্তাটা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। সামান্য পথ গেলেই চকবাজার। বাজারের উল্টো দিকে অলিবেগ খাঁর মসজিদ। কোম্পানির আমলে শহরের চেহারা আমূল বদলে গেছে। নতুন নতুন রাস্তাঘাট তৈরি হচ্ছে, দালানকোঠা উঠছে প্রতিনিয়ত। পরীর পাহাড়ের উত্তর দিকে একটা টলটলে জলের দিঘি আছে। দিঘির পাশ থেকে উঠে গেছে সবুজ গাছপালায় ছাওয়া একটা টিলা। কে কবে এই দিঘি খনন করেছিল, কে জানে। দিঘির পূর্ব দিকে লালকুঠি। সেখানে আটকে রাখা হয় শহরের দাগী অপরাধীদের। শহরে এলে কাজ সেরে আজহার একবার চক্কর দেয় পরীর দিঘির চারপাশে। জায়গাটা তার খুব প্রিয়। রাইসুদ্দিন যখন পাহাড়ের ওপর কাচারিতে যায়, তখন আজহারও সাথে থাকে। কিন্তু যখন একান্ত ব্যক্তিগত 'কাজে' যান, তখন আজহারকে নেন না। সে তখন স্বাধীনভাবে শহর চষে বেড়ায়। ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে কিছুদিন আগে বশীর মিয়ার সাথে পরিচয়। চকবাজারের এক দোকানে সুতার গুণাগুণ নিয়ে কথা বলতে বলতে দুজনের মধ্যে আলাপ-পরিচয়। বশীর এক বিলাতি মেমসাহেবের বাড়িতে কাজ করে। তিনি জেনি মেম নামে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। অনেক দিন ধরে এ শহরে বাস করছেন। বশীর যখন দশ বছরের বালক, তখন থেকে এ বাড়িতে বাস করতে শুরু করে। তার মা এ বাড়িতে আয়ার কাজ করত। সে-ও টুকিটাকি বাগানের কাজে লাগত। একদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মায়ের মৃত্যু হলে অসহায় অবস্থায় পড়ে যায় সে। বাপ আগেই মরেছিল। সেই থেকে সহৃদয় জেনি মেমের বিশ্বস্ত লোক হিসেবে বড় হতে থাকে সে। গত দশ বছর ধরে এ বাড়িটাই তার একমাত্র আশ্রয়। বাড়ির অন্যান্য কর্মচারীর চেয়ে তার পদমর্যাদা একটু উপরে। সে এই বাড়ির কেয়ারটেকার। পরিচয়ের পর একদিন আজহারকে টিলার ওপর মেমসাহেবের বাড়ি দেখাতে নিয়ে যায় বশীর মিয়া। জীবনে প্রথমবারের মতো একটা বিলেতি সাহেবের বাড়ি দেখার সুযোগ পেয়ে সে খুব আপ্লুত। বাড়ির সামনে এত বিচিত্র ফুলের সমাহার নিয়ে যে বিশাল বাগান, এই বাগানের মালি হতে পারলেও জীবন ধন্য। কিন্তু সেই বাগান যিনি তৈরি করেছিলেন, সেই সাহেব সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন কিছুদিন আগে। সে কারণে বাড়িটা এখন চুপচাপ। তার স্ত্রীই জেনি মেম। *জেনি মেমের স্বপ্নভঙ্গ* জেনি মেমের আসল নাম জেন ব্লেগ্রেইভ। তিনি এই শহরে এসেছিলেন তার স্বামী চার্লস ব্লেগ্রেইভের সাথে। চাটগাঁ তার মাতৃভূমি না হলেও দীর্ঘ এক যুগের বসবাসে এই শহরের প্রেমে পড়ে গেছেন। নিজের জন্মভূমি স্কটল্যান্ডকে ভুলিয়ে দিয়েছিল চাটগাঁর পাহাড়ি সৌন্দর্য। দুই যুগ আগে ১৮১১ সালে বাটাভিয়ার আম্বানিয়ায় দুজনে ছোট্ট একটা বাড়ি তৈরি করে বসবাস করার যে স্বপ্নটা ভেঙে গিয়েছিল, সেটা পূর্ণ হয়েছিল এখানে আসার পর। ১৮০৯ সালে কলকাতায় তাদের বিয়ের বছরখানেক পরেই চার্লস বদলি হয়েছিল ডাচ অধিকৃত বাটাভিয়ার একটা পার্বত্য দ্বীপ আম্বানিয়াতে। উচ্চাভিলাষী চার্লসের সুদূরপ্রসারী একটা পরিকল্পনা ছিল আম্বানিয়াকে নিয়ে। কিন্তু সেটার বাস্তবায়ন নিয়ে বাটাভিয়ার গভর্নরের সাথে তার ঝামেলা লেগে যায়। গভর্নর স্যার রাফলসের সঙ্গে যে দ্বন্দ্বটা শুরু হয়েছিল, সেটা গড়িয়েছিল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম অবধি। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তার চাকরি চলে যায়, ছাড়তে হয় বাটাভিয়ার মায়া। পরবর্তীকালে স্যার রাফলস বাটাভিয়ার ওই অঞ্চলে নতুন একটা নগরী গড়ে তুলেছিলেন, যার নাম সিঙ্গাপুর। কলকাতায় ফেরার পর বেশ কিছুকাল ভয়ানক দুঃসময় পার করতে হয়েছিল চার্লস ও জেনিকে। দুবছর পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে চাকরিটা ফিরে পেয়েছিল চার্লস। তারপর ঘাটে ঘাটে বদলির পালা শেষ করে অবশেষে চট্টগ্রাম শহরের সল্ট এজেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন। এই শহরে প্রথম যেদিন নোঙর করে, সেদিন সত্যি খুব মুগ্ধ হয়েছিল জেন। বাটাভিয়ার সেই পাহাড়ি দ্বীপ আম্বানিয়ার সাথে চট্টগ্রামের বিপুল সাদৃশ্য ছিল। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে দূর থেকে শহরটা দেখেই তিনি প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। নদী-পাহাড়-সমুদ্রঘেরা এমন শহর পূর্ববঙ্গে আর একটিও নেই। জনবহুল কলকাতার চেয়ে একটা নিরিবিলি শহরে বাস করার জন্য দুজনে এই শহরকে বেছে নিয়েছিল। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৮৩২ সালে পাহাড়ের উপর এই কাঠের বাড়িটা তৈরি করেছিলেন চার্লস। কিন্তু সেই সুখের মেয়াদ পাঁচ বছরও ছিল না। চার্লসের আকস্মিক মৃত্যুতে সবকিছু ভেস্তে যায়। স্বামীকে চট্টগ্রাম শহরের উত্তরে বিবিরহাট খ্রিষ্টান কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। জেনি মেম ভেবেছিলেন এই শহর ছেড়ে কোথাও যাবেন না। প্রিয়তম স্বামীর পাশে তার সমাধি হোকÑএটাই ছিল ইচ্ছে। কিন্তু সেদিন কমিশনারের মুখ থেকে যা শুনলেন, তাতে মাথায় বাজ পড়ল তার। নতুন কমিশনার হার্ভে সাহেব জানালেন, বাড়িটা অবিলম্বে ছেড়ে দিতে হবে তাকে। এটা এখন কোম্পানির সম্পদ। চার্লস নাকি কোম্পানির কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। সেই টাকা পরিশোধ হয়নি। অতএব বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে নবাগত সার্ভেয়ার মর্টন সাহেবকে। কথাটা শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না জেনি মেম। এই শহরের সবাই জানে বাড়িটা তাদের। গত পাঁচ বছর ধরে নিজেদের বাড়ি হিসেবেই বসবাস করছে। কোম্পানির টাকা দিয়ে বাড়ি তৈরি হলে সে অবশ্যই জানত। তার সন্দেহ, এখানে ঘোরতর কোনো ষড়যন্ত্র চলছে। চার্লস বেঁচে থাকলে এমন কথা বলার দুঃসাহস কারও ছিল না। এই শহরের সাথে জেনির সম্পর্ক অনেক গভীর। এই দেশকে তিনি নিজের মাতৃভূমি স্কটল্যান্ডের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন এখন। প্রতি রোববারে তিনি দিনের অর্ধেকটা চার্লসের সমাধিতে কাটিয়ে আসেন। কত আবেগ, কত স্মৃতি জড়িত এই শহরে। এই শহর এত শিগগির ছেড়ে যেতে হবে, কল্পনাও করেননি তিনি। আসল ঘটনা হলো, এই বাড়িটা শহরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় অবস্থিত। বাড়িটার নির্মাণশৈলী কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমিশনারের বাংলোকেও হার মানাবে। চার্লস চলে যাবার পর এই বাড়িটার দিকে নজর পড়েছে অনেকের। তাদের একজন চিফ সার্ভেয়ার রবার্ট মর্টন। তিনি এই শহরে নতুন হলেও কমিশনার হার্ভে সাহেবের সাথে তার পূর্ব ঘনিষ্টতার কারণে এই বাড়িটা গ্রাস করার মতলবে পায়ে পায়ে অগ্রসর হচ্ছেন। তা ছাড়া আরেকটা বিষয়ও জড়িত আছে। চার্লসের সাথে হার্ভে সাহেবের একটা পুরোনো বিবাদ ছিল কলকাতায়। সেই বিবাদের শোধ কড়ায়-গণ্ডায় উসুল করার সুযোগ নিচ্ছেন তিনি। জেনি মেমের বাড়ি থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে যাওয়া রাস্তা ধরে সামান্য গেলেই খালের উপর একটা সেতু। সেই সেতুর পাশে একটা খেয়াঘাট। তিনি পুরোনো অভ্যেসমতো এখনো মাঝে মাঝে ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। শহরের সবচেয়ে সুন্দর এবং বড় পাকা সেতুটির নিচ দিয়ে স্বচ্ছ জলের খালটি বয়ে গেছে। ছোট ছোট নৌকা সাম্পানের যাতায়াত আছে এই খালে। নৌপথে দূরে কোথাও গেলে ওই ঘাট দিয়ে বাড়ি ফিরত চার্লস। ঘাটে দাঁড়িয়ে কথাটা ভাবতে গিয়ে জেনি মেমের বুকের ভেতর কান্না উঠে আসে। স্বামী হারানোর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই কমিশনারের কাছ থেকে এমন একটা ধাক্কা খেয়ে তিনি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন। ছেলেমেয়েদের খাওয়া-পরার দিকেও নজর দিতে পারেন না। আয়াদের ওপর সব ছেড়ে দিয়েছেন। একদম গৃহবন্দী জীবন যাপন করছেন। পাড়া-প্রতিবেশী কারও সাথে যোগাযোগ নেই। নিকটস্থ প্রতিবেশী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি পাশের টিলাতে, তার বাড়িতে যেতেও এখন সংকোচ বোধ করেন। তিনি এই শহরের সিভিলিয়ানদের কাউকে বিশ্বাস করেন না এখন। যাকে দেখেন মনে হয়, সে-ও বোধ হয় জড়িতে আছে এই ষড়যন্ত্রে। তাকে এই শহর থেকে তাড়াতে সব ইংরেজ একজোট হয়েছে। স্বদেশিদের চেয়ে জেনি মেম বেশি বিশ্বাস করেন এখানকার স্থানীয়দের। বিশেষ করে বশীর মিয়া। সংসারের প্রয়োজনীয় সব দিক দেখাশোনা করে সে। বশীর ছাড়াও পুরো বাংলোতে কাজ করে আরও অন্তত এক ডজন লোক। রান্নার কাজে দুজন, পাখাওয়ালা দুজন, খাবার টেবিলে দুজন, ধোপার কাজে দুজন, বাচ্চাদের দেখভাল করার জন্য তিনজন আয়া, পানি আনার জন্য দুজন ভিস্তিওয়ালা আছে, বাজার-সদাই করার দুজন, মেমসাহেবের সার্বক্ষণিক সঙ্গী একজন। চার্লস যখন ছিল, তখন আরও পাঁচজন বেশি লোক ছিল। এখানে সবচেয়ে বড় সুবিধা হলোÑকম টাকায় অনেক লোক পাওয়া যায়। কত অল্পতে এরা সন্তুষ্ট, ভাবলে অবাক লাগে। মাসে আট আনা বেতন দিয়েও কাজ করার লোক পাওয়া যায়। প্রবল অবসাদ এবং দুশ্চিন্তার চাপে জেনি মেম যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তখন ডাক্তার পরামর্শ দিলেন হাওয়া বদল করতে হবে। ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে হবে। লোকজনের সাথে মেলামেশা করতে হবে। সামাজিক পরিবেশের আনন্দ তাকে চাঙা করে তুলবে। ওষুধের চেয়ে ওটাই বেশি জরুরি। কিন্তু জেনি মেম জানেন এই বিষাক্ত সামাজিক পরিবেশ তাকে আরও অসুস্থ করে তুলবে। তিনি বরং একটা নৌকা নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবেন। চাটগাঁর গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়াবেন। বশীরকে বললেন তার জন্য একজন বিশ্বস্ত লোক ঠিক করতেÑযাকে নিয়ে তিনি নিশ্চিন্তে বেড়াতে পারেন। মেমসাহেব যে ধরনের লোকের কথা বলছেন, সে রকম লোকের কথা ভাবতে গিয়ে আজহারের নামই সবার আগে চলে এল বশীরের মনে। গ্রামাঞ্চলে বেড়ানোর সঙ্গী হিসেবে আজহারের চেয়ে উপযুক্ত আর কেউ হতে পারে না। সে গ্রাম থেকে যে বজরা নিয়ে শহরে আসে, তাতে করে মেমসাহেবকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে পারে। আজহারকে বলতেই সে জানালÑযদি রাইসু মাতব্বর রাজি থাকে, তাহলে তার আপত্তি নেই। সেই থেকে আজহারকে নিয়ে মাঝে মাঝে মেমসাহেব এদিক-সেদিক বেড়াতে যান নৌকা নিয়ে। নৌকায় বসে কাগজ-পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকেন আনমনে। সারা দিন নদীতে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে ফিরে আসেন। মেমসাহেবের সাথে আজহারের চমৎকার একটা বোঝাপড়ার সৃষ্টি হয়েছে কয়েক দিনের মধ্যে। নেটিভ হয়েও তার প্রতি মেমসাহেবের স্নেহ-মমতায় সে খুব মুগ্ধ। জেনি মেমের সাথে পরিচয় হবার পর আজহারের কাছে চাটগাঁ শহরও নতুন করে আকর্ষণ সৃষ্টি করল। এত দিন আকর্ষণটা সীমাবদ্ধ ছিল শহরের চাকচিক্য, দালানকোঠা, সাহেবদের সাজানো বাগানবাড়িতে। এখন সেখানে যুক্ত হলো জেনি মেমের প্রতি একটা নতুন অনুভূতি। প্রায় দ্বিগুন বয়সী ভিনদেশি এই নারীর জন্য তার মধ্যে এমন একটা মমত্ববোধের জন্ম হলো, যা তার জীবনে আগে কখনো ছিল না। *মর্টন সাহেবের অবাঞ্ছিত হাত* জেনি মেমের সাথে পরিচয় হবার পর বিলাতি সাহেবদের প্রতি আজহারের যে শ্রদ্ধাবোধটা তৈরি হয়েছিল, সেটা মারাত্মকভাবে ধাক্কা খেল একদিন দুপুরবেলা। সেই দুপুরে আজহারকে নিয়ে ঘাটের দিকে যাচ্ছিলেন জেনি মেম। নদীপথে উজানের দিকে যাবার ইচ্ছা তার। পাহাড় থেকে নামার পথেই এক সাহেবের সাথে দেখা। তিনি জেনি মেমের বাড়ির দিকে আসছিলেন। তাকে দেখামাত্র থেমে গেলেন জেনি মেম। আজহারও দাঁড়িয়ে পড়ল পাশে। জেনি মেমকে লক্ষ্য করে উদ্ধত স্বরে কিছু একটা বলল সেই লোকটা। জেনি মেম কড়া একটা জবাব দিলেন। লোকটা আবার কিছু বলল তেড়িয়া হয়ে। এভাবে দুজনের মধ্যে একটা তর্কবিতর্কের সূচনা হলো পথের মাঝখানেই। ইংরেজি বোঝে না সে। কী বিষয়ে তর্ক হচ্ছে, কোনো ধারণা নেই তার। তবে ভাষার আগামাথা কিছু না বুঝলেও এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তর্কটা ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে ঝগড়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। মারামারির পর্যায়ে চলে যায় কি না, সেটা ভেবে সে আতঙ্ক বোধ করল। লোকটা কে, তার সাথে মেমসাহেবের কী সমস্যা, কিছুই বুঝতে পারছিল না আজহার। এই অবস্থায় তার ভূমিকা কী হওয়া উচিত, সেটা নির্ধারণ করতে না পেরে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তর্কের বিষয়বস্তু বুঝতে না পারলেও লোকটার চেহারার মধ্যে হিংস্রতা এবং মতলববাজের ছাপ স্পষ্ট। চেহারা দেখে মানুষ বিচার করতে আজহারের কখনো ভুল হয়নি। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল জেনি মেমের কঠোর প্রতিরোধে টিকতে না পেরে লালমুখো সাহেবটা গজগজ করতে করতে পাহাড় থেকে নেমে যাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে এতক্ষণ পর মুখে স্বস্তির হাসি দেখা গেল আজহারের চেহারায়। কিন্তু মেমসাহেবের মুখে বিজয়ের কোনো চিহ্ন নেই। দুশ্চিন্তায় তিনি আরও ম্লান হয়ে গেছেন। তার বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে আজহারকে সব ঘটনা খুলে বললেন। ঝগড়াটে লোকটার নাম মর্টন। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি জেনি মেমের পেছনে লেগেছেন। তাকে এই শহর থেকে ভাগিয়ে বাড়িটা দখল করতে চান। তার এই মতলবের পেছনে কমিশনারের সায় আছে। ফলে মাসখানেক ধরে জেনি মেম একটা অশান্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। চাইলে তিনি কলকাতায় গিয়ে থাকতে পারতেন। কিন্তু সেখানকার নাক উঁচু সিভিলিয়ান সমাজ তার পছন্দ নয়। এখানকার স্থানীয় চাটগাঁইয়াদের সাথে তার ভালো বোঝাপড়া হয়ে গেছে এই কয়েক বছরে। চেয়েছিলেন নিরিবিলিতে এখানেই কাটিয়ে দেবেন আরও কয়েকটা বছর। স্কটল্যান্ডে ফিরতে চান না শিগগির। তার পক্ষে এই বাড়ির মায়া কাটানো সহজ নয়। বাড়ির প্রতিটি খুঁটিতে চার্লসের ছোঁয়া। হাসিখুশি জেনি মেম যে এ রকম একটা বিপদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, আজহারের কোনো ধারণাই ছিল না। বিষয়টা জেনে মেমসাহেবের জন্য খুব মায়া হলো তার। কিন্তু এই ব্যাপারে তার কিছু করার নেই বলে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল সে। পরদিন জেনি মেম গতকালের মুলতবি রাখা ভ্রমণে বের হলেন আজহারকে নিয়ে। বেশি দূরে গেলেন না। শহরের উল্টো দিকে একটা দ্বীপ আছে। কোনো জনবসতি নেই। ধূ ধূ প্রান্তরে হাওয়া খেলছে। তার দুপাশ দিয়ে কর্ণফুলী বয়ে গেছে। সেই দ্বীপটাকে স্থানীয়রা বলে লাক্ষার চর। কোনো এক ইংরেজ সন্তান ওটাকে 'লাকি আইল্যান্ড' বা ভাগ্যের চর নামে ডেকেছিল, সেটাকে বাংলা করতে গিয়ে লাক্ষার চর হয়ে গেছে। সেই চরে গিয়ে নৌকা ভেড়াল মাঝি। তীরে নেমে একটা মাদুর বিছিয়ে বসলেন মেমসাহেব। এখান থেকে পুরো শহরটা একসাথে দেখা যায়। খাতা খুলে পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন তিনি। শহরটাকে এক টুকরো কাগজের উপর তুলে এনেছেন তিনি। নদীতীরের বাড়িঘর, পাহাড়, পালতোলা নৌকা, বড় বড় মাস্তুলের জাহাজ তুমুল দক্ষতায় প্রায় হুবহু এঁকে ফেলেছেন মেমসাহেব। সে জীবনে কখনো কাউকে এভাবে ছবি আঁকতে দেখেনি বলে বিষয়টা খুব চমকপ্রদ মনে হয়। একটা সাদা কাগজের ওপর পেন্সিলের আঁকিবুঁকি কেটে জীবন্ত একটা ছবি এঁকে ফেলছেন তিনি অল্প সময়ের মধ্যে। জেনি মেমকে তার অলৌকিক শক্তিধর কোনো মানুষ মনে হয়। জেনি মেম যখন ছবি আঁকেন, তখন আজহার সুবোধ বালকের মতো চুপ করে বসে থাকে। ছবি আঁকার সময় কথা বলা একদম নিষেধ। তিনি খানিক পরপর খাতাটা তুলে আজহারকে দেখান। ওই যে গাছটা এঁকেছি, ঠিক আছে, ওই যে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, ওটার চালাটা এ রকম? আজহার সমঝদারের মতো মাথা নেড়ে সায় দেয়। সে নদীর অন্য প্রান্ত দিয়ে দাঁড় বাইতে থাকা ধীর গতির একটা সাম্পানকে দেখছিল। দেখতে দেখতে ভাবছিল মেমসাহেবকে একদিন সাম্পানে চড়াবে। তিনি কোনো দিন সাম্পান চড়েননি। প্রস্তাবটা জানালে তিনি সানন্দে রাজি হলেন। বললেন, চট্টগ্রামের সাম্পান নাকি ইতালিয়ান গন্ডোলার মতো। আজহার ইতালি চেনে না, গন্ডোলা কীÑজানে না। কিন্তু জেনি মেমকে খুশি করার জন্য সায় দিয়ে বলল, ঠিক বলেছেন, একদম ঠিক। সেই সাথে টের পেল জেনি মেমকে খুশি রাখার জন্য সে যেকোনো মিথ্যা বলতে পারবে। প্রায় দ্বিগুণ বয়সী ভিনদেশি এই নারীর জন্য তার ভেতরে যে অনুভূতির জন্ম হয়েছে, সেটা লালমুখো মর্টন সাহেবের প্রতি প্রবল ঘৃণার সৃষ্টি করেছে। এমন একজন ভালো মানুষের সাথে ওই সাহেবটা সেদিন কী কুৎসিত আচরণটাই না করল। ভাবতে ভাবতে তার ভেতরে একটা ক্রোধ জেগে উঠল। অক্ষম ক্রোধ থেকে সৃষ্টি হওয়া কল্পদৃশ্যে সে মর্টন সাহেবকে একটা বল্লম নিয়ে তাড়া করতে শুরু করল। সাহেব ছুটে পালাচ্ছে, পেছনে আজহার। ধাওয়া করতে করতে সাহেবকে নদীর কিনারে নিয়ে গেল। প্রাণ বাঁচাতে সাহেব নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আজহারও নদীতে ঝাঁপ দিল। মাছের মতো দক্ষ সাঁতারু সে। সাঁতরে গিয়ে ঝাপটে ধরে সাহেবের ঘাড় চেপে ধরে চুবিয়ে মারতে চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর নদীতে একটা কুমির ভেসে উঠল। সাহেবকে প্রাণপণে ধাক্কা দিয়ে কুমিরের হা করা মুখের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এমন সময় মেমসাহেবের ধাক্কায় বাস্তবে ফিরে এল সে। 'আজহার, এবার উঠতে হবে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাড়ি ফিরতে হবে এখন।' দিবাস্বপ্ন ঝেড়ে তড়াক করে জেগে উঠল আজহার। এ যাত্রায় ঘোরাঘুরির পালা শেষ। আগামী মাসে কর্ণফুলী নদীর উজানে আরও গভীরে পাহাড়ি জনপদের দিকে যাবে একদিন। আজহারকে বিদায় জানিয়ে মেমসাহেব ঘরে ঢুকে পড়লেন। সে চলে গেল বাগানের উল্টো দিকে বশীরের ঘরের দিকে। রাতটা এখানে কাটিয়ে পরদিন গ্রামে ফিরবে। *বগার বিলের গুপ্ত পরিকল্পনা* শীতের শুরুতে একদিন রাইসুদ্দিন খন্দকারের কাছে খবর এল হুলাইনের উল্টর দিকে বগার বিলে কয়েকটা তাঁবু পড়েছে। সেখানে শহর থেকে আসা এক সাহেব কাচারির বাঙালি কর্মচারীদের নিয়ে একটা অস্থায়ী দপ্তর খুলেছে। সেই দপ্তরে এলাকার জমিজমার মালিকদের ডেকে নতুন আইনের সবক দিচ্ছে। সাহেবের কর্মচারীরা দলিল-দস্তাবেজ আর যন্ত্রপাতি নিয়ে দিনভর এদিক-সেদিক মাপজোখ করছে। রাইসু মাতব্বরের জীবনে এমন ঘটনা দেখেনি, এমনকি তার দাদার আমলেও এমন ঘটনার কথা শোনেনি। গ্রামের মানুষের সাথে কোনো রাজা-বাদশাহর কাজকারবার বা লেনদেন ছিল না। যার যার এলাকার জমিদারকেই সব সময় খাজনাপাতি বুঝিয়ে দেবার রেওয়াজ। জমিদারের সাথেই সব লেনদেন ছিল। জমিদার ঠিক থাকলে সব ঠিক। এবারই প্রথম জমিদারকে ডিঙিয়ে সরাসরি রাজা বা কোম্পানি এসে হাজির হলো চাষের জমিতে। এই আগমন অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাক্সিক্ষত। খাজনার লোভে অন্ধ হয়ে কোম্পানি সাধারণ মানুষের গলা টিপে ধরার পাঁয়তারা করছে। গ্রামের মানুষের কাছে এটা রীতিমতো বহিঃশত্রুর আগ্রাসনতূল্য। এই অঞ্চলের লোকদের মধ্যে গোরা লোকদের ব্যাপারে একটা ঐতিহাসিক ভীতি কিংবা ঘৃণা আছে। মগ শাসনামলে গোরা ফিরিঙ্গিরা এই অঞ্চলে যে ভয়ানক তাণ্ডব চালিয়েছিল, তার গল্প এখনো লোকের মুখে মুখে। এবার যেন সেই সব হার্মাদেরা আবার ফিরে এসেছে। মানুষের মধ্যে ভয় এবং ক্ষোভ দুটোই একসাথে কাজ করতে লাগল। রাইসু মাতব্বর অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন খবরটা শুনে। তার জমির পরিমাণ এই অঞ্চলে সবার চেয়ে বেশি; যার বড় অংশই হলো খাসজমি।  কোম্পানির নজর খাসজমির দিকেও পড়েছে। এই উৎপাতের প্রতিকার শুধু একজনের কাছেই চাইতে পারে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রভাবশালী জমিদার আলী আজগর চৌধুরী। আজিমপুর থেকে ফিরে এসে আজহার জানিয়েছিল জমিদার নিজেও খেপে আছেন শহর থেকে অপমানিত হয়ে ফিরে আসার পর। তিনি লাঠিয়াল বাহিনী প্রস্তুত করছেন। যদিও লাঠিয়াল বাহিনী কার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, সেটা পরিষ্কার না তার কাছে। তবু এই সাহেবি উৎপাতের বিরুদ্ধে জমিদারের অবস্থানটা জানার পর রাইসু মাতব্বরের আত্মবিশ্বাস একটু চাঙা হলো। কিন্তু এই বিষয়ে তার কী ভূমিকা নেয়া উচিত, সেটা নিয়ে মাথায় কোনো বুদ্ধি খেলছে না। রাইসুদ্দিনের মাথায় কোনো বুদ্ধি না এলেও আজহারের মাথায় কিন্তু একটা দুর্বুদ্ধি খেলতে শুরু করেছিল। সেই দুর্বুদ্ধির পেছনে তার ব্যক্তিগত একটা স্বার্থ আছে। সে কাজে রাইসু মাতব্বরের সমর্থন পাওয়ার আশায় তার কানেই প্রথম তুলল পরামর্শটা। পরামর্শ শুনে রাইসুদ্দিনের কলিজা ঠান্ডা হয়ে যাবার জোগাড়। আর যা-ই হোক, সে কখনো ওই প্রস্তাবে রাজি হতে পারে না। সাহেবদের সাথে ঝামেলা এড়াতে তার পিতামহ শহরের পাট চুকিয়ে গ্রামে চলে এসেছিল। এখন সে নিজ থেকে সাহেবের মৌচাকে ঢিল ছুড়বে? প্রশ্নই আসে না। ইংরেজের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর কাণ্ড করে কেউ রক্ষা পাবে না। ধরে নিয়ে জেল-ফাঁসিতে ঝোলাবে রাইসুদ্দিন খন্দকারকে। এই পরিকল্পনা আত্মহত্যার শামিল। আজহারের প্রস্তাব শোনামাত্রই বাতিল করে দিলেন তিনি। কথাটা বলার আগেই আজহারের সন্দেহ ছিল রাইসু মাতব্বরকে রাজি করানো যাবে কি না। তিনি রাজি না হলেও আজহার তার নিজস্ব পন্থায় কাজটা করবে বলে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ, তার ব্যক্তিগত স্বার্থটা যার সঙ্গে জড়িত, তিনি হলেন জেনি মেম। বগার বিলে গোরা সাহেব তাঁবু ফেলার সংবাদে প্রথমে আজহারও ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাহেবের নামটা শোনার পর ভয় কেটে গিয়ে দুর্বুদ্ধিটা মাথায় ঢুকে গেল। কারণ, বগার বিলে যে সাহেব তাঁবু ফেলেছে, তার নাম মর্টন। জেনি মেমের সাথে ঝামেলা পাকানো লালমুখো লোকটা। সেদিন মেমসাহেবের বাড়ি থেকে ফেরার পথে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যদি কোনো দিন সুযোগ পায় বদমাশটাকে একটা উচিত শিক্ষা দেবে। শহরে বসে গোরা সাহেবের গায়ে ফুলের টোকা দেয়াও সম্ভব না। এবার সেই মহাসুযোগ নিজেই ধরা দিতে এসেছে। এখানে তার হাত অনেক লম্বা। এলাকার মানুষ এমনিতে তেতে ছিল। আজহার গোপনে তাদের নতুন করে তাতিয়ে তুলল। ১৮ গণ্ডায় কানি কিছুতে মানতে রাজি না গ্রামের মানুষ। চার গুণ খাজনা তো অসম্ভব ব্যাপার। এই সাহেব যদি জরিপ করে কাগজপত্রে জমিজমার তথ্য লিখে নিয়ে শহরে ফেরত যায়, তাহলে সেই আইন আর বদলানো যাবে না। ইংরেজের জরিপ খুব কঠিন বিষয়। খাতায় একবার লেখা হয়ে গেলে সেটা বদলানোর সাধ্য নেই কারও। এই ঝামেলা গোড়াতেই আটকে দিতে হবে। জরিপ কাজটা কিছুতে করতে দেয়া যাবে না। *সাহেব পিটুনির প্রথম ধাপ* মুখে যতই বলুক, বাধা দেবার শক্তি কারও নেই, সেটা সবাই জানে। সুতরাং প্রথমদিকে গুজগুজ ফিসফাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল গ্রামবাসীর কার্যক্রম। বগার বিলে এক এক করে ডাকা হচ্ছে জমির মালিকদের। সাহেবের তাঁবুতে ডাক পড়লে যেকোনো জোতদারের বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায়। খাসজমি যার যত বেশি, মাথাব্যথাও তার সে পরিমাণ বেশি। সাহেব যা বলে, ভয়ে তাতেই সায় দিচ্ছে সবাই। তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবার সাহস কারও নেই। এলাকায় সবচেয়ে বেশি খাসজমির মালিক রাইসুদ্দিন খন্দকার। যেদিন রাইসু মাতব্বরের ডাক পড়ল, সেদিন ভয়ে তার ঘন ঘন পেচ্ছাব পেতে লাগল। তলপেটে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। অসুস্থতার ভান করে বগার বিলে গেলেন আজহারের কাঁধে ভর দিয়ে। তাঁবুর মধ্যে লালমুখো সার্ভেয়ার মর্টন সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। মর্টন সাহেব আজহারকে চিনে ফেলেন কি না, সেটা নিয়ে একটু ভয় ছিল। কিন্তু রাস্তার মাঝে একবার দেখে চেনার কথা না। চিনতে পেরেছে বলে মনে হলো না। মর্টন সাহেব ভদ্র ভাষার ইংরেজিতে যা বললেন, তার কিছুই বুঝলেন না রাইসুদ্দিন। বাঙালি দোভাষী সেটার সাথে কিছু হুমকি-ধমকি যোগ করে চাটগাঁইয়া ভাষায় অনুবাদ করার পর বুঝতে পারলেন। কথাগুলো শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আজহার রাগে জ্বলতে থাকল নিঃশব্দে। জেনি মেমের সাথে সম্পর্কের প্রভাবে আজহারের ইংরেজভীতি অনেকখানি কমে গেছে। এখানে আসার আগে সে রাইসু মাতব্বরকে বুদ্ধি দিয়েছিল, সাহেব যা-ই বলুক মুখে কিছু না বললেও অন্তত ডানে-বামে মাথাটা নাড়ার জন্য। ডানে-বামে নাড়ার অর্থ অসম্মতি। কিন্তু মুকবুল দেখল, সাহেব যা-ই বলছে, তাতেই রাইসুদ্দিন উপরে-নিচে মাথা নাড়ছে। যার অর্থ সম্মতি। মর্টন সাহেব খুব খুশি হলেন তার মতো বড় জোতদারকে এককথায় রাজি করাতে পেরে। সাহেবের তাঁবু থেকে মাথা নত করে বের হয়ে এলেন রাইসুদ্দিন। আজহার হতাশ। বুঝল এই বুড়োদের নিয়ে কিছু হবে না। সেই রাতেই পাড়ার তরুণ-যুবাদের সাথে বৈঠক করল আজহার। রাইসু মাতব্বরকে কিছু জানানো হলো না। যদি জনা পঞ্চাশেক লোক জোগাড় করা যায়, তাহলে কাজটা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা সম্ভব। যেদিন জরিপকাজ শেষ হবে, সে রাতেই একটা ঝটিকা আক্রমণ চালানো হবে। তবে শর্ত হলো, খুনখারাবি করা যাবে না। পিটুনি দিয়েই কাজ হাসিল করতে হবে। কাজটা হলো দলিল-দস্তাবেজ লুট করে কাগজপত্রে আগুন ধরিয়ে জরিপের সব রেকর্ড নষ্ট করে দেয়া। ভয় দেখানোই আসল কথা। পৌষের মাঝামাঝি। শীতে জর্জরিত গ্রামের মাঠঘাট। প্রচণ্ড কুয়াশায় তিন হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। সমগ্র হুলাইন গ্রাম ঘুমিয়ে। জেগে থাকলেও কুয়াশার আড়াল ভেদ করে কারও দেখার উপায় নেইÑবগার বিলের চার দিক থেকে প্রায় চল্লিশজনের একটা দল লাঠি-সড়কি-বল্লম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সাহেবের তাঁবুর দিকে। খোঁজ নিয়ে জেনেছে, রাতের বেলা তাঁবুর বাইরে বল্লম হাতে একজন পশ্চিমা পাহারাদার বাদে আর কেউ থাকে না। তাঁবুর সামনে মশাল জ্বলছে টিমটিম করে। সাহেবের তাঁবুর পাশে আরও দুটি বড় তাঁবুতে দেশীয় কর্মচারীরা নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। পাহারাওয়ালা নিজেও শীতে কাবু হয়ে খড়ের গাদার উপর বসে ঝিমোচ্ছে। রাতভর হুক্কা টেনে জেগে কাটালেও শেষ রাতের ঘুমটা উপেক্ষা করা যায় না। প্রথমে আক্রমণ হলো পাহারাওয়ালার উপর। একজন তাকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরল, অন্যজন তার বল্লমটা কেড়ে নিল। পাহারাওয়ালা ধড়মড় করে জেগে উঠে দিশেহারা হয়ে 'ডাকু ডাকু' বলে চিৎকার শুরু করল। চিৎকার শুনে তাঁবুর ভেতর থেকে ঘুমন্ত লোকজন বেরিয়ে এল। কিন্তু তাকে রক্ষা করার বদলে লোকজন অন্ধকারে বেদিশা হয়ে নানান দিকে ছোটাছুটি শুরু করল। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে মর্টন সাহেব জেগে উঠলেন। তার তাঁবুতেও ঢুকে পড়েছে কেউ। বালিশের পাশ থেকে পিস্তলটা নিয়ে গুলি করার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু পিস্তলের ঘোড়া টানার আগেই মাথার উপরে বেদম আঘাত খেয়ে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। আজহার আরও তিনজনকে নিয়ে সাহেবের তাঁবুর ভেতরে ঢুকে পড়েছিল।  লাঠির আঘাতে সাহেবকে কাবু করার পর চ্যাংদোলা করে ধরে তাঁবুর বাইরে নিয়ে এল। ওদিকে ততক্ষণে অন্য তাঁবুগুলো তছনছ করে ফেলেছে বাকিরা। সবগুলো তাঁবু থেকে যাবতীয় খাতা-রেজিস্টার কাগজপত্র লুট হয়ে গেল। অন্ধকারে বেধড়ক মার খেয়ে বাঙালি কর্মচারীরা কে কোন দিকে পালাল, কেউ জানে না। সাহেবকে ধরে পাশের একটা গর্তে ফেলে দেয়া হলো। তারপর তার উপর এমন মারধর চলতে লাগল, তাতে মনে হচ্ছিল ঔপনিবেশিক শক্তির উপর মানুষের যত ক্ষোভ ছিল, সব যেন এই সাহেবের ওপর উশুল করার চেষ্টা চলছে। আজহার দেখল লোকটাকে প্রাণে মেরে ফেলবে এরা। সেটা বিরাট বিপদ ডেকে আনতে পারে। গোরা সৈন্য এসে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে লোকজনকে চিৎকার করে বলল থামার জন্য। বেদম পিটুনি খেয়েও তখনকার মতো প্রাণে বেঁচে গেলেন সার্ভেয়ার মর্টন সাহেব। আধমরা সাহেবকে ফেলে গ্রামের যুবকরা সবাই সটকে পড়ল অন্ধকারে। *অপারেশন হুলাইন* ভয়ানক এই ঘটনার খবর পরদিন যখন শহরে পৌঁছাল, তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন কমিশনার সাহেব। সামান্য নেটিভদের এত বড় সাহস ইংরেজ সন্তানের গায়ে হাত দেয়! দুনিয়ার সবাই এটাকে ডাকাতি বললেও তিনি সেটা বিশ্বাস করার মতো গর্দভ নন। জরিপকাজে বাধা দেবার জন্যই এই আক্রমণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই তার। ডাকাতিকর্ম হলে কাগজপত্র লুট করে নেয়া হতো না। জরিপের যন্ত্রপাতি ভেঙেচুরে নষ্ট করা হতো না। আহত মর্টন সাহেবের সাথে কথা বলে একটা নাম উদ্ধার করা গেল। মার খেতে খেতেও ওই নামটা কয়েকবার উচ্চারিত হতে শুনেছে মর্টন। নামটা ছিল আজহার। ওই আজহার লোকটাই নিশ্চয়ই এই অপকর্মের হোতা। তাকে ধরে আনলে সবগুলাকে পাওয়া যাবে। আজহারের হদিস বের করা কঠিন হলো না। সিদ্ধান্ত হলো শিগগিরই হুলাইন গ্রামে অভিযান পরিচালনা করা হবে। গ্রামের লোকদের এমন শিক্ষা দিতে হবে, যেন ইংরেজ কী জিনিস সেটা হাড়ে হাড়ে টের পায়। কাচারির চামচা ধরনের বাঙালিরাও সাহেবকে উৎসাহিত করল। এই অভিযানে নেতৃত্ব দেবেন স্বয়ং হার্ভে সাহেব। এটাও নজিরবিহীন একটা ব্যাপার। অতীতে কখনো কোনো অভিযানে কমিশনার নিজে অংশ নেননি। কিন্তু এবার একজন ইংরেজ সন্তানের গায়ের রক্ত ঝরেছে। যে সাহেবের রক্ত ঝরেছে, সেই মর্টন সাহেব কমিশনারের বিশেষ প্রিয়পাত্র। সুতরাং, নিজ হাতে তিনি প্রতিশোধ নিতে চান। চাটগাঁ অঞ্চল শাসন করতে শুরু করার পর থেকে কখনো কোনো ইংরেজ সন্তানের গায়ে কেউ হাত দেবার সাহস করেনি। এখানকার নেটিভরা চিরকালই মাথা নিচু করে সাহেবদের হুকুম তামিল করে, প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি তোষামোদি করে। তার বিপরীত ঘটনা দেখতে অভ্যস্ত নয় সাহেবদের চোখ। যদি এই ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এদের সাহস আরও বেড়ে যাবে। পুরো চট্টগ্রাম শহরের ইংরেজ সমাজের মধ্যে ঘটনাটা ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। এতকাল তাদের ধারণা ছিল, ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় মানুষের বসবাস এই চট্টগ্রাম পরগনায়। ১৭৬১ সালে ইংরেজ শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে কোথাও এমন ঘটনার নজির নেই। বার্মিজদের সাথে ১৮২৬ সালের যুদ্ধে জয়ী হবার পর আরাকান প্রদেশও চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত হয়েছিল কোম্পানির নতুন উপনিবেশ হিসেবে। বার্মার যুদ্ধের পর এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে আর কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না বলে চট্টগ্রামের গ্যারিসনে সৈন্যসংখ্যা দশ হাজার থেকে কমিয়ে এক হাজারে নামিয়ে আনা হয়। এখন এ রকম প্রজাবিদ্রোহ যদি বাড়তে থাকে, তাহলে চট্টগ্রামের নিরাপত্তা নিয়ে কোম্পানিকে নতুন করে ভাবতে হবে। শহরের ইংরেজ সমাজে দুশ্চিন্তা ও ক্ষোভ একসাথে কাজ করতে শুরু করে। কিছুদিন আগে আনোয়ারা এলাকাতেও এই জরিপের ব্যাপার নিয়ে প্রজা অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। পটিয়ার মতো মার খাওয়ার ভয়ে জরিপ দলকে সেখানে কাজ অসমাপ্ত রেখেই ফিরে আসতে হয়েছিল। *খ্যাতির বিড়ম্বনা* কাচারিতে পটিয়ার লোক বেশি হবার কারণে কাচারির অনেক খবর যেমন পটিয়া চলে যায়, তেমনি পটিয়াসংক্রান্ত স্থানীয় তথ্য দেওয়ার লোকের অভাব ছিল না কাচারিতে। আজহারের ঠিকানা খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না হার্ভেকে। সব খোঁজ নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার পর অভিযানের তারিখ চূড়ান্ত করা হলো। ওদিকে হুলাইন গ্রামেও উত্তেজনার কমতি ছিল না। হুলাইনের আশেপাশের গ্রাম শাকপুরা, ধলঘাট, গোমদন্ডি, খরণদ্বীপ থেকে দলে দলে লোকজন বগার বিল এসে ঘুরে যেতে লাগল। অখ্যাত গ্রামটা রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল। আনোয়ারা থেকেও কয়েকটা দল এসে দেখে গেল। যে গর্তে সাহেবকে ফেলে পেটানো হয়েছিল, সেই গর্তের চারপাশে সব সময় ছেলেপিলেদের ভিড় লেগে থাকে। এটা রাজবিদ্রোহ নাকি স্বদেশপ্রেম, সেটা কেউ বিচার করছে না। মূল কথা হলো, আমাদের বাপ-দাদার রক্ত পানি করা চাষের জমিতে হাত দিলে তার ঠ্যাং ভেঙে দেয়া হবে, সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন? আজহারের খ্যাতি আকাশ ছুঁয়ে দিল রাতারাতি। আজহারের এই খ্যাতি তার জন্য যতই সুখবর বয়ে আনুক না কেন, রাইসুদ্দিনের মনে আতঙ্ক গিজগিজ করছে। তিনি আজহারকে ডেকে প্রচণ্ড বকাবকি করেছেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ করলে তার চাকরি চলে যাবে বলে হুমকি দিলেন। ইংরেজ চরিত্র সম্পর্কে তার ধারণা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি জানেন ইংরেজ খুব প্রতিহিংসাপরায়ণ একটি জাতি। পিতামহ তাকে বলত, যে যা-ই বলুক, ইংরেজ কোনো দিন আঘাতের কথা ভোলে না। তাৎক্ষণিক জবাব না দিলেও সময়মতো কড়ায়-গণ্ডায় শোধ নেয়। শোধ নেবে এবারও। সুতরাং, বিচক্ষণ রাইসুদ্দিন অভিযানের আগেই নিজের পরিবার নিয়ে আজিমপুরে বোনের বাড়িতে সরে গেল। কিন্তু আজহার পালাল না। সে রয়ে গেল হুলাইন গ্রামে। প্রথম কারণ রাইসুদ্দিন খন্দকারের মা। তিনি নিজের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি হননি। তাকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আজহারকে। তাতে আজহার আপত্তি করেনি দ্বিতীয় কারণটির জন্য। দ্বিতীয় কারণ হলো, বড় সাহেবের অভিযান উপলক্ষে তার মাথায় আরেকটা পরিকল্পনা ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। *বড় সাহেবের পলায়ন* সপ্তাহখানেক ধরে গ্রামে ইংরেজি পেটানোর যে উৎসবের রেশ চলছিল, শনিবার বিকেল নাগাদ সেই উল্লাস এক ফুৎকারে নিভে গেল। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে বোয়ালখালী খাল বেয়ে মাইলখানেক যাবার পর খালের পাশে বিশাল পরিত্যক্ত একটা বাড়ির ভিটার ধ্বংসাবশেষ আছে। মালভূমির মতো দেখতে সেই জায়গার কাছে শনিবার বিকেলে নোঙর করল তিনটা নৌযান। একটা বজরায় আছেন দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত কমিশনার। বাকি সবগুলো নৌকাভর্তি লাল পাগড়ি পরা পুলিশ বাহিনী। হুলাইন থেকে জায়গাটা কয়েক মাইল উত্তরে। বাতাসের আগে খবর ছুটল রাইসু মাতব্বরের গ্রামে। আধা ঘণ্টার মধ্যে অর্ধেক গ্রাম খালি হয়ে গেল। আজহার পড়ল দোটানায়। বুঝতে পারছিল নাÑকী করবে। বুড়িকে একা রেখে পালিয়ে গেলে রাইসুদ্দিন খন্দকার তাকে আস্ত রাখবে না। অবশেষে বুড়ির জন্য একটা ব্যবস্থা করে আজহারও বাড়ি ছেড়ে পালাল। পালিয়ে অবশ্য বেশি দূর গেল না। পাশের হিন্দুপাড়ার সুবল সাহার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিল। এই পাড়ার লোক ইংরেজ পেটানোতে অংশ নেয়নি বলে এদিকটা নিরাপদ মনে হচ্ছে। গ্রামের আরও অর্ধশতাধিক লোক ওই পাড়ার পেছনের জঙ্গলে আশ্রয় নিল। দূর থেকে পথের ওপর নজর রাখার জন্য দুই কিশোরকে নিয়োগ করা হলো। প্রথম রাতে কোনো অভিযান হলো না। সাহেবের পেয়াদারা নদীতীরে নেমে পাহারা বসাল। শুকনো ডাঙায় দশটা বড় বড় মশাল জ্বালিয়ে রাতের নিরাপত্তা জোরদার করা হলো। হার্ভে সাহেব দেহরক্ষীদের নিয়ে তার বিলাসবহুল বজরার মধ্যে রাত কাটালেন। সাহেবের সঙ্গে এসেছে কাচারির পটিয়া এলাকার কর্মচারীও; যারা এলাকা সম্পর্কে ভালো মতন খোঁজখবর জানে। এখান থেকে  হুলাইন গ্রামে যেতে হলে অন্তত চার মাইল পথ হাঁটতে হবে। শীতকালে বেলা পড়ে আসে দ্রুত। অভিযান সেরে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। রাতের অন্ধকারেই গতবার ঘটনা ঘটেছিল। তাই অভিযান সেদিনের মতো মুলতবি রাখা হলো। পরদিন সকালে কয়েকজন বন্দুকধারী পেয়াদাকে নৌকা পাহারায় রেখে কমিশনার সাহেব অভিযানে রওনা দিলেন। ২৫ জন বন্দুকধারী পুলিশসহ ৪৫ জনের একটা বাহিনী। লাল পাগড়ি বাহিনী দেখে পথে পথে গ্রামের পর গ্রাম পুরুষশূন্য হতে থাকল। এই অঞ্চলে কখনো এত বড় অভিযান দেখেনি কেউ। সাহেব একটা পালকিতে চড়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। চার বেহারার একটা দল সেই পালকিটা কাঁধে বয়ে নিচ্ছে। পৌষের সকালে বাংলাদেশের গ্রামগুলোর সজীব দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে যাবার মতো। সাহেব সেই দৃশ্য উপভোগ করতে পারছেন না। তিনি প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিলেন। বেলা ১১টার দিকে কমিশনার সাহেবের দলবল যখন রাইসুদ্দিন খন্দকারের উঠোনে পা রাখল, তার অনেক আগেই পাখি উড়ে গেছে। সমস্ত বাড়িঘর খাঁ খাঁ করছিল। কয়েকটা হাঁস-মুরগি কক কক করে অতিথিদের স্বাগত জানাল। এ বাড়িতে কখনো পাগড়ি পরা অতিথি দেখেনি বলে গৃহপালিত পক্ষীকুলের মধ্যে যুগপৎ উদ্বেগ এবং কৌতূহল দেখা দিয়েছিল। বাড়ির মধ্যে কাউকে না পেয়ে পুলিশ বাহিনী খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে জিনিসপত্র তছনছ করে করে ফেলল। বাড়ির আগাপাশতলা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কাউকে পেল না। রাইসুদ্দিন খন্দকারের বাড়িতে কেউ না থাকলেও আশেপাশের বাড়িগুলোর মধ্যে বেশ কিছু বয়স্ক মানুষ, নারী ও শিশু রয়ে গিয়েছিল। সেই সব বাড়ি থেকে নিরীহ মাঝবয়সী ৩৫ জন লোককে পাকড়াও করা হলো। একদম খালি হাতে তো ফেরা যায় না। ৩৫ জনের দলটাকে ধরে নিয়ে যখন কমিশনার সাহেব গ্রাম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, দূরের জঙ্গলের আড়াল থেকে তাদের দেখতে পাচ্ছিল পলাতক তরুণের দল। তাদেরই অনেকের বাপ চাচাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ বাহিনী। আজহার তার দলবল নিয়ে সতর্কভাবে সাহেবের দলটাকে অনুসরণ করতে লাগল। সাহেবের নৌকা যেখানে নোঙর করেছে, সেটা কয়েক মাইল দূরে। নিরপরাধ বয়স্ক লোকদের ধরে নিয়ে যাবার খবর বিদ্যুৎ-গতিতে ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে গ্রামে। সাহেবের সামনের পথ আটকানোর কেউ না থাকলেও পেছন দিকে দলে দলে গ্রামবাসী বেরিয়ে এল পথে। সাহেবের দলটিকে দূর থেকে অনুসরণ করছিল উৎসুক গ্রামবাসী। ব্যাপারটা হার্ভের চোখে ভালো ঠেকল না। তিনি দুরবিন ছাড়াই দেখতে পেলেন অন্তত শ পাঁচেক লোক পেছন দিক থেকে তাদের অনুসরণ করছে। কিন্তু তেমন কোনো কোলাহল শোনা যাচ্ছে না। চুপচাপ পিছু পিছু হেঁটে আসছে। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। তিনি বেহারাদের তাগিদ দিলেন একটু দ্রুত ছোটার জন্য। তারপর পিস্তল দুটো তৈরি রাখলেন। পালকির গতি বেড়ে গেলে পেছনে পুলিশদের হাঁটার গতিও বেড়ে গেল। একপর্যায়ে ছুটতে শুরু করল সাহেবের দলটা। সাহেবের দলটাকে ছুটতে দেখে পেছনে অনুসরণকারী দলটার মাঝে সাহসের সঞ্চার হলো। তারাও গতি বাড়িয়ে দিয়ে ছুটতে লাগল। এতক্ষণ যেটা ছিল নীরব অনুসরণ, এবার সেটা পরিণত হলো সরব পশ্চাদ্ধাবন। নদীর ঘাটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হাজার পেরিয়ে গেল অনুসরণকারী লোকসংখ্যা। তুমুল হইচই-চিৎকার চেঁচামেচিতে পুরো এলাকা কুরুক্ষেত্রে পরিণত হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে হার্ভে সাহেব পালকি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে বজরায় উঠে পড়লেন। কিন্তু বন্দীদের নৌকায় তুলতে গিয়ে বিপত্তি দেখা দিল। কাকে কোন নৌকায় তুলবে, এসব চিন্তা করতে করতে পেছনের জনতার ভিড় থেকে উড়ন্ত বস্তুসমূহ সাহেবের দলটার ওপর এসে পড়তে শুরু করল। গাছের ডাল, ইট-পাথর, মাটির ঢেলা, যার যা আছে তাই ছুড়তে লাগল। জনতা উন্মত্ত হয়ে উঠছিল ক্রমে। হাজারো জনতার সামনে সাহেবের ৪৫ জনের দলটি নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়ল। তারা এখন বন্দীদের ফেলে নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর ব্যাপার নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বজরায় ওঠার পর সাহেব চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল, 'খবরদার কেউ নৌকায় ওঠার চেষ্টা করবে না, গুলি করব তাহলে।' সাহেবের ইংরেজি বয়ান বোঝার ক্ষমতা জনতার নেই। বুঝতে পারলেও কী। কে শোনে কার কথা? মানুষ তখন ভয়ানক উত্তেজিত। কদিন আগে ছোট সাহেব পিটিয়ে সাহস বেড়ে গেছে। এবার বড় সাহেবকে পানিতে চুবিয়ে দেবার জন্য তারা প্রস্তুত। সাহেবের হুংকার তলিয়ে গেছে জনতার ক্রোধের আগুনে। হঠাৎ করে বজরা থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করল পুলিশ বাহিনী। সরাসরি ভিড়ের মধ্যে এলোপাতাড়ি গুলিতে লুটিয়ে পড়ল কয়েকজন। থমকে গেল জনতা। গুলিগোলার শব্দের সাথে আহত মানুষের ত্রাহি চিৎকার। গুলি খেয়ে মানুষ একটু পিছু হটতে শুরু করলে ইংরেজের নৌকাগুলো সে অবকাশে দ্রুত নোঙর তুলে পালাতে শুরু করল। গুলির মুখে আজহারও পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাহেবের নৌকা সরে যেতে শুরু করলে আজহারের পুরোনো জেদ আবারও মাথাচাড়া দিতে শুরু করল। চোখের সামনে লুটিয়ে পড়ে আছে গ্রামবাসী। রক্তে ভেসে যাচ্ছে নদীতীর। কতগুলো লাশ পড়েছে তখন, কেউ জানে না। কিন্তু রক্ত-কাদায় মাখামাখি দেহগুলো দেখে আজহারের মাথা ওলটপালট হয়ে গেল। গোরা সাহেব তাদের এত মানুষকে হত্যা করে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে, এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। সে ভয়ডর ভুলে অন্ধের মতো ছুটে গিয়ে হাতের বড় লাঠিটা ছুড়ে মারল হার্ভে সাহেবের বজরার উদ্দেশে। তার সঙ্গী-সাথিরাও অনবরত ঢিল-পাথর ছুড়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে কোনো একটা পাথর উড়ে গিয়ে সোজা আঘাত করল হার্ভে সাহেবের পায়ে। আঘাতে কুপোকাত হয়ে সাহেব পড়ে গেলেন বজরার পাঠাতনে। পিস্তল ফেলে খোঁড়া পা নিয়ে বজরার ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিলেন তিনি। উন্মত্ত জনতা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নৌকাগুলো আটকানোর জন্য।  আবার গুলি করে লোকগুলোকে ঠেকানো হলো। হার্ভে সাহেবের নেতৃত্বে তিন নৌকার যাত্রী কোনোমতে প্রাণ নিয়ে শহরে ফিরতে পারল। পরদিন সকালে পল্টনের সেনানিবাস থেকে একদল সৈন্যকে পটিয়ায় অভিযান চালাতে পাঠানো হলো। সৈন্যরা পথঘাট থেকে কিছু লোককে ধরে নিয়ে এসে জেলে পুরে দিল। কিন্তু মূল আসামিরা সব গ্রাম ছেড়ে লাপাত্তা। অতীতেও জমিজমা নিয়ে উটকো ঝামেলা হয়েছে কোম্পানির কর্মচারীদের সাথে। কিন্তু এবারের ঘটনা অতীতের সব ঘটনাকে হার মানিয়েছে। এত শীর্ষ পর্যায়ের কোনো ইংরেজ সাধারণ মানুষের মার খায়নি। এটা প্রায় রাজ বিদ্রোহ। এদের চূড়ান্ত শাস্তি না দিলে পুরো চট্টগ্রাম একদিন বেহাত হয়ে যেতে পারে বলে শহরের সিভিল সমাজ আশঙ্কা প্রকাশ করল। *সমাচার দর্পণে চট্টগ্রাম দাঙ্গা* ঘটনার উত্তাপ চট্টগ্রাম শহর পেরিয়ে সুদূর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। নেটিভদের উচিত শিক্ষা দেবার জন্য কমিশনার একটা বড় ধরনের সেনা অভিযান চালাবার অনুমতি চাইলেন হেডকোয়ার্টারে। তার জবাবে এক সপ্তাহের মধ্যেই ফোর্ট উইলিয়াম থেকে দুটো চিঠি এল। একটিতে ছিল হার্ভে সাহেবের তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ। দ্বিতীয়টি ছিল নতুন কমিশনার নিয়োগের নির্দেশ। শাসনকার্যে অযোগ্যতার কারণে হার্ভে সাহেবকে অপসারণ করে নতুন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হলো হেনরি রিকেটকে। বলাবাহুল্য, নেটিভদের শিক্ষা দেবার ভার নতুন কমিশনারের হাতেই থাকল। নতুন কমিশনার হেনরি রিকেট যথেষ্ট বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। কাজে যোগ দেবার পরপর তিনি বিষয়টা গুরুত্বের সাথে বিচার করে দেখলেন। তিনি নিরপেক্ষভাবে খোঁজখবর নিয়ে যা দেখলেন, তাতে বুঝতে পারলেন অন্যায় সিদ্ধান্তের কারণে মানুষ খেপে উঠেছিল। অতঃপর ঘটনাটি যেন আরও বড় না হয়, তিনি সেদিকে মন দিয়ে স্থানীয় জমিদার, মাতব্বরদের ডেকে বৈঠকে বসলেন কয়েকবার। হার্ভে সাহেবের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়ে পূর্বের ব্যবস্থা বহাল রাখলেন। চট্টগ্রামের মানুষ বারবার নানামুখী আগ্রাসনের কবলে পড়ে কাবু হয়ে থাকলেও তাদের রক্তে একটা ঐতিহ্যবাহী গোয়ার্তুমি আছে। সেটাকে বশে না রেখে শাসন করা যাবে না। রিকেট সাহেব সেটা ভালো করেই বুঝতে পারলেন। সেনা অভিযানের অনুমতি এলেও শেষমেষ অভিযানটা তেমন জোরদার হলো না। কয়েকটা বজরায় করে একদল সৈন্য দক্ষিণ চট্টগ্রামে মার্চ করল কয়েকটা দিন। কিন্তু ধরপাকড় কিংবা গোলাগুলির ঘটনা তেমন ঘটেনি। হেনরি রিকেট পরবর্তীকালে বিচক্ষণ প্রশাসক হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন সমগ্র চট্টগ্রামে। তার জনপ্রিয়তার কারণে তার নামে চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থল লালদীঘিতে একটি ঘাট তৈরি করে দিয়েছিল স্থানীয় জমিদারেরা। রিকেট ঘাটের অস্তিত্ব এখনো বর্তমান। ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ ছাপা হয়েছিল ১৮৩৭ সালের ২৮ জানুয়ারি তারিখের 'সমাচার দর্পণে': *চট্টগ্রামের দাঙ্গা* সম্প্রতি চট্টগ্রামে যে দাঙ্গা উপস্থিত হইয়া দুইজন হত ও কয়েকজন আঘাতী হয় তদ্বিষয়ে কিয়ৎকালাবধি নানা জনরব হইতেছে। এই অশুভ ব্যাপার বিষয়ে সর্ব্বাপেক্ষা প্রামাণিক যে বার্ত্তা বোধহয় তাহা নীচে প্রকাশ করা গেল। বিশেষতঃ বঙ্গদেশ ও বিহার ও উড়িষ্যার অন্যান্য জিলাতে যদ্র্রুপ এলোমেলো দশাসনী বন্দোবস্ত হইয়াছিল চট্টগ্রাম জিলার তদ্রুপ না হইয়া তদনুসারে বন্দোবস্ত হয় অতএব স্পষ্টই দৃষ্ট হইতেছে যে জরীপের অতিরিক্ত যে সকল ভূমি তত্রস্থ জমিদারেরা ভোগ দখল করিতেছেন তাহার রাজস্ব সরকারে দেওয়া উচিত। গবর্নমেন্টের নিতান্ত অভিপ্রায় এই যে এইক্ষণে যে সকল ভূমির রাজস্ব না দেওয়া যায় সেই ভূমির সংখ্যার যথার্থ হিসাব জ্ঞাত হন। অতএব সামান্যতঃ তাবৎ জিলা জরীপ না করিলে এই অভিপ্রেত সিদ্ধ হইতে পারে না। মধ্যে মধ্যে গবর্নমেন্ট স্থান বিশেষে কতক কতক ভূমি জরীপ করিয়াছেন তাহাতেই অশেষ গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে। অতএব এইক্ষণে গবর্নমেন্ট একেবারে জেলাসুদ্ধ জরীপ করিয়া তাবৎ গোলমালের শেষ করিবেন। ফলে ইহাতে জমিদারেরদের নিতান্তই অসম্মতি। যেহেতুক তাঁহারা জ্ঞাত আছেন যে ভূমি জরিপ করিলেই একেবারের লিখিত হইতে অতিরিক্ত যে সকল ভূমি আপনারা ভোগদখল করিতেছেন তাহা আর পারিবেন না। সম্প্রতি রেবিনিউ সরবেয়রদের একজন শ্রীযুত মর্টন সাহেব কোন গ্রামের নিকটস্থ একটা মাঠ জরীপ করিতেছিলেন। তৎসময়ে দলবদ্ধ বহুসংখ্যক লোক আক্রমণপূর্ব্বক তাঁহাকে একটা পরিখার মধ্যে নিক্ষেপ করত লৌহ যষ্টির দ্বারা এমত প্রহার করিল যে তাহাতে সাহেব মৃতকল্প হইলেন এবং জরীপ করণীয় তাবৎ যন্ত্রাদি ভাঙ্গিয়া হিসাবপত্র সকল লইয়া গেল তাহাতে প্রাণ ভয়ে সাহেবের লোকেদের পলাইতে হইল। পরে এই দাঙ্গাতে যারা নিযুক্ত ছিল তাহাদের সরদারকে গ্রেফতারকরণার্থ পোলিস হইতে কএক জন বরকন্দাজ প্রেরিত হয়। কিন্তু তাহারা ঐ দাঙ্গাবাজদিগকে গ্রেফতার করিলে পর অন্যান্য লোকেরা ঐ বরকন্দাজগণের উপর আক্রমণ করিয়া ধৃত ব্যক্তিদিগকে ছাড়াইয়া দিল। ঐ জিলার অন্যান্য স্থানেও এতদ্রুপ ঘটনা হয়। তাহাতে শ্রীযুত ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এই ব্যাপার দেখিয়া তথায় স্বয়ং গমনপূর্ব্বক আপনার হুকুম জারি করিতে স্থির করিলেন এবং যে ৩৫ জন ঐ দাঙ্গাতে নিযুক্ত ছিল তাহাদের সকলকে ধৃত করিয়া পোলিসে পাঠাইলেন। কিন্তু জমিদারেরদের কুমন্ত্রণাতে ঐ জিলাস্থ লোকেরা দলবদ্ধ হইয়া ডঙ্কা বাজাইতে বাজাইতে প্রায় দুই ক্রোশ ব্যাপিয়া শ্রীযুত কালেকটর ও শ্রীযুত রেবিনিউ সরবেয়র সাহেবের পশ্চাদ্ধাবমান হইল। তাহারদের ভরসা ছিল যে সাহেবদিগকে নদীর মধ্যে ফেলাইয়া ধৃত ব্যক্তিদিগকে মুক্ত করিব। কিন্তু কালেকটর সাহেব যাতে স্বীয় শিবিরে ফিরতে পারেন এ নিমিত্ত পূর্ব্বেই ঐ নদীতে নৌকা নিযুক্ত ছিল এবং সেই নৌকাতে বন্দুকধারি ১২/১৪ জন বরকন্দাজ ও কএকজন চাপড়াশীর অধীনে ঐ ধৃত ব্যক্তিরা নীত হইল পরে পশ্চাতবর্ত্তি চাপড়াশী নৌকারোহণের উদ্যোগকরণ সময়ে দাঙ্গাকারি লোকসকল তাঁহাদের প্রতি আক্রমণ করিল। তাহাতে শ্রীযুত ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব উচ্চস্বরে কহিলেন যদ্যপি তোমরা নৌকাতে উঠ তবে আমার বন্দুক চালাইতে হইবে। কিন্তু তাহারা সাহেবের কথা না মানিয়া তাহারদের উপর পড়িল। ফলত ইহাতে দাঙ্গা উপস্থিত হইয়া দুইজন হত ও পাঁচজন আঘাতী হয়। নৌকা খুলিয়া দিলে পরেও ঐ দাঙ্গাবাজেরা শ্রীযুত ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের উপরে যষ্টি ও ইস্টক প্রস্তরাদি নিক্ষেপ করিতে লাগিল এবং শ্রীযুত হারবি সাহেব স্বীয় নৌকায় উপবেশনকালে ঐ ইষ্টকের দ্বারা পদে আঘাতী হইলেন। ভূমি জরিপকরণে সময়ে দুই থানাতে এতদ্রুপ গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে। অতএব তাহারদিগকে দমন করণার্থ সৈন্যের আবশ্যক হইল। তদনুসারে পঞ্চান্ন রেজিমেন্টের তিন কোম্পানি সিপাহীকে তৎক্ষণাৎ শ্রীযুত ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের ছাউনিতে গমনার্থ হুকুম দেওয়া হলো। তাহারা ঐ রাজবিদ্রোহীদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ দুই তিনবার ধাবমান হইয়া এই ব্যাপারে যাহারা বিশেষরূপে লিপ্ত ছিল তাহারদের কএক জনকে ধৃত করিল এবং সৈন্যদের গুলি না করিতে করিতেই পুনর্ব্বার ঐ জিলার শান্তি হইল। [সমাচার দর্পন, ১১২৪ সংখ্যা। ১৯ বালাম। ২৮ জানুয়ারি ১৮৩৭ সাল। শনিবার। ১৬ মাঘ ১২৪৩] *'ভিলেজ অব চিটাগং ১৮৩৭'* হার্ভে সাহেবের অভিযানে বেশ কিছু লোক হতাহত হবার পর পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রাম এলাকা থমথমে হয়ে পড়েছিল। হুলাইনের অর্ধেকের বেশি লোক সরে গিয়েছিল আরও দূরের গ্রামে। আজহার নিজের গ্রামে না গিয়ে শঙ্খ নদী পার হয়ে সাতকানিয়ায় খালার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। মাস দেড়েক পর পরিস্থিতি শান্ত হলে হুলাইনে ফিরে এসেছিল। রাইসু মাতব্বর অবশ্য দুই সপ্তাহ আজিমপুর কাটিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। তত দিনে সরকারের হুকুমে নতুন আইন বাতিল হয়ে পুরোনো আইন বহাল হয়ে গেছে। ফাল্গুনের শেষভাগে আজহার শহরে গেল মেমসাহেবের খোঁজ নিতে। বশীর মিয়ার কাছ থেকে জানা গেল, নতুন কমিশনার জানিয়েছেন মেমসাহেবকে বাড়ি ছাড়তে হবে না। তিনি যত দিন খুশি থাকতে পারবেন। কিন্তু তিনি আর বেশি দিন থাকবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কলকাতায় গিয়ে বিলেতের জাহাজে উঠে পড়বেন। দাঙ্গার পর থেকে আজহারের খোঁজখবর না পেয়ে তিনি ভেবেছিলেন, হার্ভে সাহেবের আক্রমণে সে-ও মারা পড়েছে কি না। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। বশীরকে বারবার খোঁজ নিতে বলেছিলেন। কিন্তু বশীর তো তার বাড়িঘর চেনে না। কারও কাছ থেকে খবর পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। গোলমালের সময়টা আজহার একবারও শহরে আসেনি। কেন আসেনি, এত দিন কেন নিখোঁজ ছিল, সেটা জেনি মেম বা বশীর কেউ জানে না। দীর্ঘ দুই মাস নিখোঁজ থাকার পর আজহারকে দেখে নতুন করে আনন্দিত হলেন জেনি মেম। অক্ষত অবস্থায় আজহারের ফিরে আসা তার জন্য খুব আনন্দের ব্যাপার। দেশে ফেরার আগে তাকে নিয়ে তিনি শেষবারের মতো একটা নৌভ্রমণ করতে চান। তবে এবারের ভ্রমণের জন্য তিনি বেছে নিলেন সাম্পান। দুপুর বারোটার দিকে খাওয়ার পর্ব সেরে আজহারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। বশীর আগেই সাম্পান মাঝিকে বলে রেখেছিল। শীতের হালকা রোদ মেখে শহর থেকে বেরিয়ে পড়লেন চাক্তাই খাল বেয়ে। সাম্পানটা কর্ণফুলীতে পড়তেই একটু বড় ঢেউয়ের কবলে পড়ে দুলতে থাকল সাম্পানটা। জেনি মেম খানিক ভয় পেলেন। শক্ত করে মকবুলের হাত ধরে রাখলেন। উত্তর দিকে ঘণ্টাখানেক চলার পর একটা খালে ঢুকে পড়ল নৌকাটা। এই পথে কিছুদূর গেলেই বগার বিল। জেনি মেমকে সেই বিলটা দেখাতে নিয়ে যাবে আজ। যেতে যেতে ভাবছিল মেমসাহেবকে খুলে বলবে কি না, মর্টনকে কীভাবে নাকাল করেছে তার বাহিনী। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তাটা বাদ দিল। জানাজানি হলে তাকে নতুন করে ঝামেলায় পড়তে হবে। কে জানে ধরে নিয়ে গারদে পুরে দেবে পুলিশ। গ্রামের মধ্য দিয়ে খালটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে। মাঝিকে বললেন সেদিকে নিয়ে যাবার জন্য। হঠাৎ করে জেনি মেম আজহারের চোখের দিকে অদ্ভুত একটা মায়া নিয়ে তাকালেন। ধরে রাখা হাতটার ওপর একটু চাপ দিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, 'আজহার, আই ওয়াজ সো হ্যাপি উইথ ইউ। ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। আই উইল মিস ইউ।' আজহার ইংরেজি বোঝে না। কিন্তু জেনি মেমের চোখের ভাষা পড়তে সমস্যা হচ্ছিল না। সংকোচে মাথা নামিয়ে নিল সে। জেনি মেম তখন নিজস্ব বাংলায় বললেন, 'এই ছেলে, কী বলেছি বোঝোনি, তাই না? বলেছি তোমার সঙ্গে আমি খুব আনন্দিত সময় কাটিয়েছিলাম। তুমি আমার সত্যিকারের বন্ধু। আমি তোমাকে সারা জীবন মনে রাখব।' জবাবে আজহার কী বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। কিন্তু কিছু একটা তো বলা উচিত। এ রকম কথা আর কোনো নারী তাকে বলেনি। এ দেশে নারী-পুরুষ এভাবে মেলামেশাও করে না। অসমবয়সী এই ভিনদেশি মেম যে কথাটা বলছে, সেটা কোন অর্থে বলছে, সেটাও তার কাছে পরিষ্কার নয়। এটা হয়তো তার স্নেহের প্রকাশ। সে যেমন ভাবছে সে রকম কিছু নয়। তবু সে সংকোচে জড়োসড়ো হয়ে আছে। কথাগুলো তার ভালো লাগছে। কিন্তু সে তো কিছু বলার ভাষা পাচ্ছে না। প্রচণ্ড সুখানুভূতিরও একটা চাপ আছে। সেই চাপ কাটানোর জন্য আজহার পেটে জমিয়ে রাখা গুরুতর কথাগুলো প্রকাশ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিল। জেনি মেমকে সে বিশ্বাস করে। তিনি আর কাউকে বলবেন না বলে আশা করা যায়। ধীরে ধীরে এত দিনের জমিয়ে রাখা কথাগুলো বলতে শুরু করল। মর্টন সাহেবের ঘটনা থেকে শুরু করে হার্ভে সাহেবের ওপর হামলা পর্যন্ত সব কথা একনিশ্বাসে বলে ফেলল। তারপর জেনি মেমের চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করল। সবকিছু বলে ফেলে কোনো ভুল করল কি না। কিন্তু জেনি মেমের চোখে এমন একটা কৃতজ্ঞতার ছায়া দেখতে পেল, তাকে অবিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই। তিনি শুধু বললেন, 'তুমি একটা অদ্ভুত ছেলে আজহার। আমি সত্যিই ভাগ্যবান তোমার সঙ্গ পেয়ে।' মাঝিরা ততক্ষণে খালের মধ্য দিয়ে অনেকটা ভেতরের দিকে নিয়ে গেছে নৌকাটাকে। নদীর খরস্রোত নেই এখানে। ধীরে ধীরে বাইতে লাগল নৌকা। চারদিকে সবুজ সবজির খেত। পাকা টমেটোগুলো ফুলের মতো ফুটে আছে সবুজের মাঝে। কোথাও মরিচের খেত। বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম। সতেজ শাকসবজিতে ভরপুর সমস্ত প্রান্তর। এ দেশের সবচেয়ে সুন্দর সময় এখন। এ দেশে শীত-বসন্তের এই সন্ধিক্ষণের মতো আরামদায়ক ঋতু আর একটিও নেই। জেনি মেম আনন্দিত চিত্তে গ্রামীণ দৃশ্যাবলি উপভোগ করতে থাকেন। কিছুদূর যাবার পর একটা জায়গায় নৌকা থামাতে বলল আজহার। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আজহারের দিকে তাকাতেই সে সামনের খোলা প্রান্তরটি দেখিয়ে বলল, 'ওইখানে, ঠিক ওইখানে মর্টন সাহেব আত্মাহুতি দেবার জন্য তাঁবু খাঁটিয়েছিলেন।' আজহারের বলার ধরন দেখে জেনি মেম হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন। তারপর বললেন, 'দাঁড়াও, এই স্মরণীয় জায়গার একটা ছবি আঁকি। তুমি চুপ করে বসে থাকো।' ওরা যেখানে নৌকা থামিয়েছে, সেখানে জলামতন জায়গার মাঝে ছোট্ট একটা ভগ্নপ্রায় বেড়ার কুটির আছে। কুটিরের পাশে বেশ তাগড়া ধরনের একটি ষাঁড় গামলা থেকে খাবার খাচ্ছিল। পাশে ধুতি পরা দুজন লোক উদাম গায়ে বসে গল্প করছে। কুটিরের পেছনে একটা খেজুরগাছে হাঁড়ি ঝুলছে। নানা রকমের পাখপাখালি উড়ছে নদীতীরে। কিছুক্ষণ পর মেমসাহেব আজহারকে হাত বাড়িয়ে ডাকলেন। ছবি আঁকা শেষ। আজহার কাছে গিয়ে দেখল, তার সামনে নদীতীরের যে দৃশ্যটা খালি চোখে দেখতে পাচ্ছে, হুবহু সেই জিনিস এঁকে ফেলেছেন মেমসাহেব। প্রতিবার নতুন ছবি দেখে মুগ্ধতায় ডুবে যায় আজহার। মেমসাহেব বললেন, 'ছবিটার একটা নাম দাও দেখি।' ছবির আবার নাম কী? আজহার মাথা নাড়ল। এসব তাকে দিয়ে হবে না। জেনি মেম একটু ভাবলেন। তারপর পেন্সিলটা নিয়ে ঘসঘস করে একটানে ছবির নিচে লিখলেন, Village of Chittagong 1837. সেদিনই ছিল আজহারের সাথে শেষ ভ্রমণ। কয়েক দিন পর আজহার যখন শেষবার দেখা করতে এসেছিল, তখন তার হাতে একটা ছোট একটা গয়নার বাক্স তুলে দিয়েছিলেন। বিদায় নেবার আগে আজহার তার কাছে একটা ছবি চেয়েছিল। তিনি ছবি আঁকার একটা খাতা দিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে অসমাপ্ত অনেক ছবির খসড়া ছিল। কয়েক মাস পর তিনি চট্টগ্রাম শহরকে বিদায় দিয়ে সদরঘাট থেকে জাহাজে চড়লেন কলকাতার উদ্দেশে। কিছুদিন কলকাতায় কাটিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডে ফিরে গিয়েছিলেন। আজহারের পরবর্তী বংশধরেরা গয়নার বাক্স থেকে পাওয়া সম্পদে স্বচ্ছল জীবন যাপন করলেও ছবি আঁকার খাতাটা কেউ সংরক্ষণ করেনি। দেশে ফেরার সময় জেনি মেম যে কয়েকটি ছবি নিয়ে গিয়েছিলেন, তার অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। অল্প কয়েকটি ছবি এখনো টিকে আছে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। তার মধ্যে ভিলেজ অব চিটাগং ছবিটা অন্যতম। ছবিটা দুই শ বছর পরও এক অলিখিত উপখ্যানের সাক্ষী হয়ে আছে। *পাদটীকা:* চট্টগ্রাম শহর নিয়ে ১৮৩৭ সালে জেন ব্লেগ্রেইভের আঁকা বেশ কয়েকটি চমৎকার পেন্সিল স্কেচ এখনো ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। এই গল্পে ব্যবহৃত ছবিগুলো সেখান থেকে সংগৃহীত।
Published on: 2024-04-15 07:41:56.967178 +0200 CEST