The Business Standard বাংলা
আব্বাস হোটেল: ১৯৫০ সালে শুরু হওয়া চুকনগরের বিখ্যাত চুইঝালের খাসির মাংস

আব্বাস হোটেল: ১৯৫০ সালে শুরু হওয়া চুকনগরের বিখ্যাত চুইঝালের খাসির মাংস

'বিখ্যাত গান আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না'– তে প্রখ্যাত গায়ক মান্না দের গলায় শুনবেন, 'মাংসটা ঝাল হবে, মেটে হবে আশিটা'– তা হবে বৈ কী! ঝালে ঝোলে অম্বলে যে বাঙালি, সে বাঙালি মাংসে ঝাল খাবে না তা কী কখনো হতে পারে? মাংসে ঝাল যেমন রান্নার স্বাদকে করে তোলে অনন্য, তেমনি রান্নায় এনে দেয় চমৎকার রং৷  ধোঁয়া ওঠা গরম গরম ভাত আর ঝাল ঝাল খাসির মাংসের সাথে মিশে আছে বাঙালির আবেগ। আর সেই ঝাল যদি হয় চুইঝালের, তবে তো কোনো কথা-ই নেই। চুইঝাল আর খাসির মাংস একসাথে রাঁধলে যে জম্পেশ একটা স্বাদ আসবে, সে তো বাঙালির ভেতরকার ভোজনরসিক মন আন্দাজ করতেই পারে। কিন্তু আন্দাজ নয়, আব্বাস হোটেলের চুইঝালের খাসির মাংস খেলে বাঙালি তা মরমে মরমে বুঝবে। *চুইঝাল কী?* চুই লতা জাতীয় গাছ। চুইয়ের ধূসর রঙা কাণ্ড আর পাতা সবুজ। চুইয়ের পাতাগুলোকে দেখলে এক নিমেষে পান পাতার মতন মনে হয়। চুই কাণ্ড আর শেকড়ের অগোছালো চেহারা আর রঙের জন্যে যে কেউ একে আগাছা ভেবে বসতে পারে। কিন্তু চুইয়ের ঔষধি গুণ জানলে ধারণা বদলাতে বাধ্য।  চুইয়ের পাতা, কাণ্ড, ফুল, ফল থেকে শুরু করে শিকড় পর্যন্ত ঔষধি গুণসমৃদ্ধ। চুইয়ের শিকড়ে রয়েছে ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ পিপারিন। চুইঝালে আছে আইসোফ্লাভোন, পিপালারিটিন, পিপারন, পোলার্টিন, গ্লাইকোসাইডস, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সিজামিন, পিপলাস্টেরলসহ নানা উপকারী উপাদান। চুইঝালে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েড ও  অ্যালকালয়েড অন্ত্রের ক্যানসার প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এছাড়া হৃদরোগ, স্নায়ুবিক উত্তেজনা, বাত ও কোমরের ব্যথা, প্রসব বেদনা, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় চুইঝাল কাজ করে ওষুধের মতন। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর ও নড়াইলে রান্নায় চুইঝাল মশলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। লঙ্কার পরিবর্তে চুইঝালের ব্যবহার রান্নার স্বাদকে বাড়িয়ে দেয়, সাথে আনে নতুনত্ব। কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের ভর্তা ও আচারের ক্ষেত্রেও চুইঝাল ব্যবহার করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লঙ্কার ঝাল কিছুতেই খেতে পারতেন না। এদিকে বেশিরভাগ রান্নায় ঝাল না দিলে স্বাদ‌ই হয় না। এই গুরুতর সমস্যা থেকে রবি ঠাকুর বাঁচলেন চুইঝালের সন্ধান পেয়ে। ধারণা করা হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শ্বশুরবাড়ি খুলনার দক্ষিণডিহিতে চুইঝালের সন্ধান পেয়েছিলেন। কেননা, এই অঞ্চলেই চুইঝালের জনপ্রিয়তা ছিল বহুকাল আগে থেকে। *আব্বাস হোটেল: শুরুটা যেভাবে* সালটা ১৯৫০। একটি গোলপাতায় ছাওয়া ঘরে ছোটোখাটো একখানাখানা খাওয়ার হোটেল। বসবার ব্যবস্থা হিসেবে স্কুলের বেঞ্চি। তেমন মূলধন না থাকায় নেই সাজসজ্জার আতিশয্য। বলতে গেলে হাতের রান্নার কৌশলকেই মূলধন করে খুলনার চুকনগরে খাওয়ার হোটেল খুলে বসলেন আব্বাস আলী মোড়ল। সে রান্না আব্বাস আলী শিখে এসেছিলেন ভারতের মাদ্রাজ থেকে। আব্বাস ভাবলেন, দুই পদের রান্না দিয়েই শুরু করা যাক। মেনু নির্বাচনে আব্বাস ভুল করেন নি। বাঙালিয়ানার সাথে মেশালেন আঞ্চলিকতাকে। স্থির হলো চুইঝাল দিয়ে খাসির মাংস আর ভাত। ভাত-মাংসের দাম ধরলেন প্লেট প্রতি ১ টাকা।  এভাবেই খুলনার রেস্তোরাঁ জগতে কিংবদন্তিতুল্য আব্বাস আলীর রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ে পদার্পণ। আব্বাস হোটেলের চুইঝালের খাসির মাংস মুখে তুলে নিতেই অতুলনীয় স্বাদ-গন্ধে মন জুড়িয়ে আসবে। গন্ধ যে চুইঝালের, সে আর আলাদা করে বলতে হয় না। শুধু গন্ধ নয়, ঝাল ঝাল মাংসের স্বাদটাও উপভোগ্য। গোটা রসুন আর বিভিন্ন মশলায় কষানো মাংসের সে এক অন্যরকম স্বাদ। ঝালের মাত্রাটা জিভে জল এনে দেয়। চুইঝাল চিবোতে শুরু করলে ঝালের দমকটা বাড়ে। তবু যেন অসহনীয় ঝাল নয়, এক ধরনের নরম নরম অনুভূতি। গরম ভাতে ঝোলসমেত মাংস মাখতেই মনে হবে, আরও চাই। আর চাইলেই আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে দেন হোটেলের কর্মচারীরা। দেশের দূরদূরান্ত থেকে যেমন মানুষ এখানে আসেন চুইঝালের স্বাদ নিতে, তেমনি তাদের আপ্যায়নও। বেশ একটা বাড়ি বাড়ি ব্যাপার। তবে এখানে বসার জায়গা নিয়ে ঝঞ্ঝাট। জায়গা ফাঁকা পাওয়া ই যে দায়! আব্বাস হোটেলে ভিড় লেগে থাকে রাতদিন। ২৮ বছর আগে আব্বাস আলী মোড়ল মারা যান। সালের হিসাবে তখন ১৯৯৬। এ সময় থেকে আব্বাস আলীর ৩ ছেলে আব্দুল জলিল মোড়ল, আব্দুল আলিম মোড়ল ও আব্দুল সেলিম মোড়ল হাল ধরলেন আব্বাস হোটেলের। বাবার ব্যবসাকে সুনামের সাথে ধরে রাখবার চ্যালেঞ্জ হাতে তুলে নিলেন তিন ভাই। এবারে বাবার হাতে শেখা রান্নার কৌশলকে নিষ্ঠার সাথে প্র‍য়োগের পালা। সেই ব্রত নিয়ে এই তিন ভাই আব্বাস হোটেলে বাবুর্চির কাজ শুরু করলেন। আস্তে আস্তে আব্বাস আলীর ছেলেদেরও সুনাম ছড়াতে শুরু করলো। আব্বাস হোটেলে আব্বাস আলীর ছেলেরা মিলে করলেও হোটেলের ৬/৭ জন কর্মচারী তাদেরকে রান্নার কাজে সাহায্য করে থাকেন। এই হোটেল খাসির মাংসে চুইঝাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশি চুইকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তবে দেশি চুই পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে পাহাড়ী চুই ব্যবহার করা হয়। শুধুমাত্র হোটেলে রান্না নয়, পাশাপাশি আব্বাস আলীর ছেলেরা বড় বড় অনুষ্ঠানের রান্নার অর্ডারও নিয়ে থাকেন। "আমার আব্বা বেঞ্চ পেতে যে হোটেল শুরু করেছিলেন, এখন সেই হোটেলের একটি শাখা পর্যন্ত রয়েছে। চুকনগরে আব্বাস হোটেলের মূল শাখার পাশাপাশি খুলনার সোনাডাঙায় আরেকটি শাখার সন্ধান মিলবে। ঈদের পরে সাতক্ষীরা জেলার পাটকেলঘাটায় আরেকটি শাখা খোলবার পরিকল্পনা চলছে। পাটকেলঘাটা শাখায় খাসির মাংসের পাশাপাশি গরুর মাংস পাওয়া যাবে। বর্তমানে  আমাদের হোটেলে এক পিস খাসির মাংস ২০০ টাকা আর একপ্লেট ভাত ২০ টাকা, অর্থাৎ ২২০ টাকায় মিলবে চুইঝালের মাংসের সাথে ভাত। তবে পরবর্তীতে বাড়তি ভাতের জন্যে প্লেট প্রতি ধরা হয়ে থাকে ১০ টাকা। রান্নার ক্ষেত্রে আমরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখবার শতভাগ চেষ্টা করি। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত আব্বাস হোটেলে পাবেন মাংস-ভাত," জানাচ্ছিলেন আব্বাস হোটেলের বর্তমান মালিকদের একজন, আব্দুল জলিল মোড়ল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ হিন্দু হোটেল উপন্যাসে হাজারী ঠাকুরের হাতের রান্নার সুখ্যাতি ছিল রানাঘাট জুড়ে আর তা যদি হয় মাংস, তবে তো কথাই নেই। যে হাজারী ঠাকুরের হাতের মাংস খেয়েছে, সেই জানে ওই হাতে কী জাদু! কী অপূর্ব স্বাদ, কী অপূর্ব গন্ধ! আব্বাস আলী আর তার ছেলেদের হাতের চুইঝালের মাংসকে হাজারী ঠাকুরের রান্নার সাথে তুলনা করলে খুব একটা দুর্নাম কুড়োতে হবে বলে মনে হয় না। অন্তত তাই বোঝা গেল আব্বাসের হোটেলে খেতে আসা বিভিন্ন মানুষজনের সাথে কথা বলে। ২০০৩ সাল থেকে চুইঝালের মাংস খেতে আব্বাস হোটেলে যাতায়াত করেন চঞ্চল ভট্টাচার্য। কীটনাশক কোম্পানির চাকরিসূত্রে বিভিন্ন জেলায় কাজ করতে হয় তাকে। আব্বাস হোটেলের সন্ধান পেয়েছিলেন অফিসের সহকর্মীর থেকে। প্রথম আব্বাস হোটেলে এসেই চুইঝালের নাম শোনেন।  এরপর সুদূর মেহেরপুর থেকেও চুইঝালের মাংসের টানে আব্বাস হোটেলে এসছেন কয়েকবার। এই হোটেল থেকে মাংস কিনে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছেন পরিবারের মানুষদের। ২০০৩ সালে এখানে মাংসের দাম ছিল ৪০ টাকা, এখন তা ২০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। তবু অপূর্ব স্বাদের জন্যে তিনি আব্বাস হোটেলে যান এখনো," জানাচ্ছিলেন চঞ্চল ভট্টাচার্য। সাতক্ষীরা থেকে প্রায়শই আব্বাস হোটেলের চুইঝালের মাংস খেতে আসেন ফরহাদ হোসেন। চুকনগর থেকে সাতক্ষীরার দূরত্ব খুব বেশি নয়। তাই ইচ্ছে হলেই চলে আসেন ফরহাদ। ফরহাদ জানালেন, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে এই হোটেলের সুনাম শুনেছিলেন তিনি। বছর ছয়েক আগে খেতে আসেন বন্ধুদের সাথে।  চুইঝালের মাংস আরো অনেক জায়গাতেই খেয়েছেন। কিন্তু এমন স্বাদ আর কোথাও কখনো পান নি। তাই বারেবারে ছুটে আসতে হয় আব্বাস হোটেলে।  তবে আব্বাস হোটেলে মাংসের দামটা তুলনামূলক বেশি। যারা দূর থেকে আসে তাদের জন্যে খরচটা একটু বেশিই হয়ে যায়। আরেকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, তিনি ড্রাইভারদের থেকে এই হোটেলের সন্ধান পেয়েছিলেন। এখানকার রান্না খেয়ে আব্বাস হোটেলের নাম ভুলতে পারেন নি। এরপর থেকে খুলনার দিকে কোনো কাজে এলে একবার আব্বাস হোটেলে ঢু মারেন। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সবসময়েই আব্বাস হোটেলে একটা উৎসব উৎসব ব্যাপার থাকে। একদিকে, রান্নার তোড়জোড়। কুটনো কোটা থেকে মশলার যোগাড়; অন্যদিকে, দূর দূরান্ত থেকে খেতে আসা ভোজনরসিক ক্রেতার ভিড়। এরমধ্যে মাংসের বিশাল গামলা হাতে করে নিয়ে হোটেলের কর্মচারীরা টেবিলে টেবিলে গিয়ে প্লেটে পরিবেশন করেন চুইঝালের মাংস। পরিবেশনের এই সাবেকী স্টাইলের কারণেই খানিকটা বাড়ি বাড়ি পরিবেশ মনে হয়। তবে আর দেরি কেন? আব্বাস হোটেলের চুইঝালের খাসির মাংসের অতুলনীয় স্বাদ নিতে আপনিও হাজির হতে পারেন খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে।
Published on: 2024-04-17 10:38:10.939117 +0200 CEST