The Business Standard বাংলা
১২ গিগাওয়াটের নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে, কিছু কেন্দ্রে থাকবে স্টোরেজ ব্যবস্থা

১২ গিগাওয়াটের নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে, কিছু কেন্দ্রে থাকবে স্টোরেজ ব্যবস্থা

২০২৫ সাল নাগাদ দেশের ১০ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পূরণের লক্ষ্য রয়েছে। এই লক্ষ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি-নির্ভর ১২৫টি গ্রিন এনার্জি প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, এসব প্রকল্পের মোট উৎপাদন সক্ষমতা ১২ হাজার ৪৭ মেগাওয়াট, যা বর্তমানে দেশের শীতকালীন মোট বিদ্যুৎ চাহিদার চেয়ে বেশি, এবং গ্রীষ্মকালের চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ। এরমধ্যে সাতটি সৌর-বিদ্যুৎকেন্দ্র সন্ধ্যায় বা রাতে পিক সময়ে ব্যবহারের জন্য উৎপাদিত বিদ্যুতের ২০ শতাংশ স্টোরেজ বা সংরক্ষণ করবে। বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে এখাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। তাতে সব মিলিয়ে ১১,০০০-১২,০০০ মেগাওয়াট রিনিউয়েবল এনার্জি পাওয়া যাবে।" সরকারি ও বেসরকারিখাতে ১২৫টি নবায়নযোগ্য জ্বালানি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলমান ও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এরমধ্যে চলমান প্রকল্প ৫১টি ও প্রক্রিয়াধীন প্রকল্প ৭৪টি। প্রায় ৯০ শতাংশই হবে সৌর-বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাকি কেন্দ্রগুলো বায়ু, বর্জ্য ও বায়োমাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। বর্তমানে মৌসুমের ওপর ভিত্তি করে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা ৮ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াট। আমদানি করা বিদ্যুৎসহ বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। এরমধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ভাগ ২ শতাংশেরও কম। বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব বলেন, "২০২৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ রিনিউয়েবল এনার্জি নিশ্চিত করার যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আমরা কাজ করছি, তা হয়তো পূরণ হবে না। তবে ২০২৭-২০২৮ সালে এটি অনেক বেড়ে যাবে। এমনকী ওই সময় আমাদের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।" "আমরা এখন যেসব প্রকল্প অনুমোদন করছি, সেগুলো থেকে বিদ্যুৎ পেতে দুই থেকে আড়াই বছর সময় লাগবে। এখন থেকে প্রত্যেক বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রিনিউয়েবল জ্বালানি-নির্ভর বিদ্যুৎ ন্যাশনাল গ্রিডে যুক্ত হবে"- তিনি আরো বলেন। গত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জীবাশ্ম জ্বালানির দরে উত্থানের ফলে সরবরাহে অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে এই বড় রুপান্তর জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে আশা করছে বিদ্যুৎ বিভাগের অধীন টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা)। কার্বন নিঃসরণ হ্রাসও এসব প্রকল্পের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সুফল হবে। বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি ক্রয়-বাবদ সরকারের শত শত কোটি ডলার সাশ্রয় করবে এসব প্রকল্প। *রাতে ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ সংরক্ষণ* কর্মকর্তারা জানান, এসব প্রকল্পের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র দিনের বেলায় জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে, এবং উৎপাদিত বিদ্যুতের ২০ শতাংশ যখন সূর্যকিরণ থাকবে না তখন সরবরাহের জন্য সংরক্ষণ করবে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ ধরণের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বাংলাদেশে প্রথম। ভারত, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সৌরবিদুৎ স্টোরেজ বা ধারণ করার ব্যবস্থা রয়েছে। রাতে কিংবা যখন সূর্যের আলো থাকে না, তখন ব্যাটারি স্টোরেজ ব্যবস্থা থেকে এসব বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, সন্ধ্যায় বা রাতে সৌরবিদ্যুৎ গ্রিডে সঞ্চালনের লক্ষ্যে অন্যান্য দেশের মতো সোলার স্টোরেজ ক্যাপাসিটি সম্পন্ন সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে সরকার উৎসাহিত করছে উল্লেখ করে বিদ্যুৎ সচিব বলেন, "আমরাও সোলার স্টোরেজ শুরু করেছি। পরীক্ষামুলকভাবে গাজীপুরে ২ মেগাওয়াটের একটা সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। স্টোরেজ ক্যাপাসিটিসহ সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বেসরকারিখাত থেকে বেশ কয়েকটি প্রকল্প প্রস্তাব এসেছে। আমরা সেগুলোও পজিটিভলি বিবেচনা করব।" *চলমান প্রকল্পগুলো* বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারিখাতের ১০টি চালু সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৪৬১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। বেসরকারিখাতে প্রক্রিয়াধীন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হচ্ছে নোয়াখালীর স্বর্ণদ্বীপে। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক এলেরিস লিমিটেড এই দ্বীপে মোট ১,০০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। বেসরকারিখাতে প্রক্রিয়াধীন অন্য মেগা সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে- জামালপুরের ইসলামপুরে এসএএল-জিটেক কনসোর্টিয়ামের ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, রংপুরের গঙ্গাচড়ায় যৌথ উদ্যোগে ২৫০ মেগাওয়াটের সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে সাংহাই ইলেকট্রিক ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং রাইজেন এনার্জি কোম্পানি লিমিটেড। চলমান ও প্রক্রিয়াধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে ১৭টি কেন্দ্র বায়ু, বর্জ্য ও বায়োমাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এসব কেন্দ্রের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ৯৩৩ মেগাওয়াট। বাকি ১১ হাজার ১১৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে সৌরভিত্তিক কেন্দ্র থেকে। ব্যাটারি স্টোরেজ সিস্টেমসহ নির্মাণাধীন নবায়নযোগ্য জ্বালানি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা সাতটি। এসব কেন্দ্রের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৯৪০ মেগাওয়াট। এরমধ্যে ৭৪০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার পাঁচটি সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে বেসরকারিখাতের ওরিয়ন গ্রুপের সাবসিডিয়ারি দুটি কোম্পানি– এনারগন রিনিউইয়েবলস (বিডি) লিমিটেড এবং পিডব্লিউআর এর যৌথ উদ্যোগ। যৌথ উদ্যোগের ভিত্তিতে তারা চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও নেত্রকোনায় সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। কোম্পানিটি প্রত্যেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের ২০ শতাংশ হারে স্টোরেজ করবে। অর্থাৎ, এতে পাঁচটি কেন্দ্র থেকে ১৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ স্টোরেজ করা সম্ভব হবে। এছাড়া, রামপালের বাগেরহাটে ৩০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সৌদিভিত্তিক এসিডব্লিউএ পাওয়ার।  ইউনিভার্সাল ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিংস লিমিটেড ফেনীর সোনাগাজীতে ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সোলার স্টোরেজ ব্যবস্থাসহ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। উলিং পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেড ও স্টেট পাওয়ার ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশনের কনসোর্টিয়াম রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ২০ মেগাওয়াট স্টোরেজ ক্যাপাসিটিসহ ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। সরকারি ও বেসরকারিখাতে চলমান প্রকল্পগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ৩ হাজার ৭৪৮ মেগাওয়াট। কক্সবাজারের চকরিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় বায়ু-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প নিয়েছে জেটি নিউ এনার্জি কোম্পানি লিমিটেড। সেখানে ২২০ মেগাওয়াটের বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে কোম্পানিটি। এছাড়া, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালীতে প্রতিটি ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার তিনটি বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বিনিয়োগ করবে হুইহেং উইন্ড পাওয়ার লিমিটেড, সাতক্ষীরায় বিনিয়োগ করবে সাসটেইনেবল এনার্জি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এবং পটুয়াখালীতে বিনিয়োগ করবে এইচকে ওয়েসিস পাওয়া এনার্জি ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং থিয়েন ভু হাইব্রিড পাওয়ার সিটি লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগ। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরে চারটি বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এসব কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৬৪ মেগাওয়াট। অন্যদিকে, পাবনা সদর উপজেলায় ৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি বায়োমাস বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে এমএ গ্রিন এনার্জি লিমিটেড। *জমি লাগবে ১০ হাজার একর* নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে, প্রায় ১০ হাজার একর জমির প্রয়োজন হবে। তাই সরকার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করবে নদীর কাছাকাছি এলাকায়– বালুকাময় ও অনুর্বর জমিতে। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ডিজেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে খরচ হবে ২ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে তা উৎপাদনে ব্যয় হবে ২৪ হাজার কোটি টাকা, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ব্যয় হবে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, এবং ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ব্যয় হবে ১ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। *বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের মূল্য বেশি কেন* বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের প্রতি কিলোওয়াট মূল্য ১১ টাকা বা তারও বেশি, যা ভারতসহ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এর কারণ জানতে চাইলে বিদ্যুৎ সচিব বলেন, যেসব দেশে মরুভূমি থাকে, সেখানে জমির দাম কম। সেসব দেশে রেট একটু কম হয়। ''ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ট্যারিফ বা মূল্য বেশি হওয়ার কারণ হলো – ভারতে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিড পর্যন্ত সঞ্চালন লাইন স্থাপনের খরচ সরকার বহন করে। আমাদের দেশে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে হয়। তাছাড়া, আমাদের এখানে অনেক ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন করতে হয়, রিটেনশন ওয়াল নির্মাণ করতে হয়। এসব কারণে আমাদের এখানে রেট ভারতের চেয়ে সামান্য বেশি। তবে ট্রান্সমিশন লাইনের খরচ বাদ দিলে বাংলাদেশ ও ভারতের রেটের মধ্যে তেমন কোন তফাৎ নেই"- জানান তিনি। সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি বাড়তি ঝোঁক কৃষি উৎপাদন ব্যাহত করবে কি-না, এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, " আমাদের নীতিমালা হলো কৃষিজমিতে সোলার পাওয়ার স্থাপন না করা। নদীর পাড়ে বালুময় জমিতে – যেখানে কোন ফসল হয় না, বা হলেও খুবই সামান্য হয় – সেসব স্থানে করা হয়।"
Published on: 2024-04-17 06:30:10.097769 +0200 CEST