The Business Standard বাংলা
শিক্ষাজীবন শেষ, তবু বহুদিন পরও পরীক্ষা নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছেন? এমন কেন হয়?

শিক্ষাজীবন শেষ, তবু বহুদিন পরও পরীক্ষা নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছেন? এমন কেন হয়?

একসময়ের অভিজ্ঞ শিক্ষক থেকে সাংবাদিক হওয়া সেলিম আহমেদ বারবার তার বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো নিয়ে বিভিন্ন স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে তিনি প্রায়ই দেখেন, তার ক্লাসে যেতে দেরি হয়ে গেছে, ভুল পরীক্ষা দিতে গেছেন, পরীক্ষার হল খুঁজে পাচ্ছেন না বা রহস্যময় সমস্যা সমাধানের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। মাঝে মাঝে ফাঁকা প্রশ্নপত্র পাওয়ার স্বপ্নও দেখেছেন তিনি। চার দশকেরও বেশি সময় আগে ১৯৮৪ সালে মাস্টার্স শেষ করে ছাত্রজীবনকে বিদায় জানালেও, স্বপ্ন তাকে এখনও সেই ক্যাম্পাসের করিডোরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। জেগে ওঠার পর অনেকক্ষণ তার বুক ধড়ফড় করতে থাকে। তিনি বলেন, 'এটি অসম্ভব আতঙ্ক এবং অনির্বচনীয় অনুভূতি।' মজার ব্যাপার হলো, সেলিম আহমেদের সাবেক শিক্ষার্থী থেকে সহকর্মী হওয়া ৫২ বছর বয়সি আলীম আজিজও একই ধরনের স্বপ্ন দেখেন। আজিজ বলেন, 'আমি অঙ্ক পরীক্ষা নিয়ে এখনও দুঃস্বপ্ন দেখি।' এই স্বপ্নের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের অনারারি অধ্যাপক ড. মেহতাব খানমের শরণাপন্ন হই। তবে তিনি নিজেও একই রকম স্বপ্ন দেখার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন! আহমেদ, আজিজ এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবনে অতীতের কোনো অভিজ্ঞতা এভাবে স্বপ্নের আকারে বারবার জীবনে ফিরে আসে। যেগুলো তাদের জীবনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। খানম বলেন, 'মূলত ট্রমা থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটে, বিশেষত শৈশবের কোনো ঘটনা থেকে সৃষ্ট ট্রমা থেকে।' নেতিবাচক শৈশব অভিজ্ঞতার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করা হয়। কেউ কেউ মনে করেন, প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতার মতো অতীতের স্মৃতিগুলো আমাদের অবচেতন মনের গভীরে লুকিয়ে থাকে, সেগুলোই স্বপ্নের মাধ্যমে ফিরে ফিরে আসে। এই অভিজ্ঞতাগুলো বিভিন্ন ট্রমা থেকে আসে। হতে পারে তা শারীরিক, মানসিক বা যৌন যেকোনো ধরনের। আমাদের ইতিবাচক স্মৃতির চেয়ে এসব স্মৃতি বেশি দিন মনে গেঁথে থাকে। ইতিবাচক স্মৃতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ম্লান হয়ে যায়। এই মনোবিজ্ঞানী বলেন, আমাদের মস্তিষ্কের এই নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলো একইভাবে ম্লান করতে অসুবিধা হয়। তাই মনোবিজ্ঞানীরা এ ধরনের স্মৃতিকে 'অপ্রক্রিয়াজাত উপাদান' বলে অভিহিত করেন, যা পরবর্তী জীবনে অপ্রত্যাশিতভাবে জেগে উঠতে পারে। এমনকি যদি বেদনাদায়ক ঘটনার সুস্পষ্ট স্মৃতি ম্লান হয়েও যায়, তবুও এ সংশ্লিষ্ট অনুভূতি বা আবেগগুলো অক্ষত থাকতে পারে এবং বিভিন্ন উপায়ে তার বিহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। খানমের মতে, শিক্ষাক্ষেত্রের চাপ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, যা অতীতের শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতার স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। তিনি আমাদের একটি ছেলের কথা জানান। সেন্ট জোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য তার পিতামাতার ইচ্ছায় কঠোর প্রচেষ্টা করে ছেলেটির জীবনের দুটি বছর নষ্ট হয়ে গেছে। এই সময়ে সে প্রচণ্ড চাপের শিকার হয় এবং শৈশবের আনন্দ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত থাকে। শুধু কোচিং ক্লাসে বসে বা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তার বয়সের বাচ্চাদের বাইরে খেলাধুলা করতে দেখত সে। পিতামাতার অত্যধিক চাপ সন্তানের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাগুলোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে, যা বছরের পর বছর ধরে তাদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। তবে এই ধরনের প্রভাবের পরিমাণ ব্যক্তিভেদে আলাদা। প্রতিটি মানুষ তার জীবনের ঘটনাবলি স্বতন্ত্রভাবে গ্রহণ করে এবং এই ধরনের বাস্তবতাকে ভিন্নভাবে অনুভব করে। দ্য ড্রিম হ্যান্ডবুকের লেখক ও স্বপ্ন বিশ্লেষক জেন তেরেসা অ্যান্ডারসনের সঙ্গেও কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। তিনি ব্যাখ্যা করেন, স্বপ্নগুলো গত ১-২ দিনের সচেতন ও অচেতন অভিজ্ঞতাগুলোকে প্রতিফলিত করে এবং অতীতের অনুরূপ অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করে। প্রকৃতপক্ষে স্বপ্ন এই তুলনা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করে। গতকালের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অতীতের অনুরূপ অভিজ্ঞতা আলাদা হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা ওই বিষয়টি নিয়ে আগের চেয়ে নতুন বা পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি (বা রেজোলিউশন) নিয়ে জেগে উঠি। আরও সহজভাবে বললে, অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের স্বপ্নময় মস্তিষ্কের মধ্যে সুপ্ত থাকে। আমরা জীবনের প্রথমদিকে যেসব মৌলিক বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করি, তা গতকালের টাটকা অভিজ্ঞতার তুলনায় বেশি শক্তপোক্তভাবে মনে গেঁথে থাকে। আমরা এতদিন ধরে যে বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেছি, তার তুলনায় সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাগুলোকে ভুল হিসেবে বিচার করার প্রবণতা দেখা যায় আমাদের মধ্যে। আমাদের স্কুলজীবনের অভিজ্ঞতাগুলো যে কোনো কারণে আমাদের মনে তীব্র ও কঠিন চাপ ফেলতে পারে। যেমন: কটু কথা, পরীক্ষায় পাস করার চাপ, পিতামাতার প্রত্যাশা পূরণের চাপ, হতাশ বোধ করা প্রভৃতি। আমাদের সাম্প্রতিক বা গত এক-দুই দিনের কোনো অভিজ্ঞতা যখন এমন কোনো বিষয়কে জাগ্রত করে, যা আমাদের স্কুলের দিনগুলোর একই ধরনের অভিজ্ঞতা সৃষ্টিকারী ঘটনার অনুরূপ, তখন স্বপ্নময় মন সেই সময়গুলোর কথা মনে করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি কোথাও পারফর্ম করা নিয়ে চাপে থাকেন এবং এতে আপনার স্কুলজীবনের একই রকম চাপের কথা মনে করিয়ে দেয়, আপনার স্বপ্ন আপনাকে সেই চাপ অনুভব করে স্কুলের দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারে। প্রতিটি ব্যক্তির নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা বা সমস্যা থাকবে যা তাদের বর্তমান জীবনে অনুরূপ সমস্যাগুলোর দ্বারা পুনরুত্থিত হয়ে তাদের স্বপ্নে ফিরে আসে। এই স্বপ্নগুলো বিভিন্ন বয়সের জন্য আলাদা হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ব্যক্তিভেদে এর প্রভাব ভিন্ন। জেন তেরেসা অ্যান্ডারসন বলেন, 'তবে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে স্কুল ও স্কুলিংয়ের ধরন অনেকটা বদলেছে। তাই ৬০ বছর বয়সি মানুষদের এ ধরনের সমস্যা, ৩০ বছর বয়সিদের সঙ্গে মিলবে না। নিজেদের যে ধরনের স্কুলিং বা শাসনের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের স্বপ্নগুলো হবে সে ধরনের।' স্বপ্নগুলোতে আমাদের সচেতন ও অবচেতন উভয় অভিজ্ঞতাই প্রতিফলিত হয়, তাই এগুলোতে আমাদের চরিত্রের সুপ্ত বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি, আবেগ এবং বিভিন্ন সমস্যার স্মৃতি ফিরে আসে। তিনি বলেন, 'আপনি আপনার স্বপ্নগুলো পর্যবেক্ষণ করলে, আপনার অবচেতন মানসিকতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। আপনার অবচেতন মানসিকতা কীভাবে আপনার সচেতন উদ্দেশ্যকে ক্ষুণ্ণ বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে তা উপলব্ধি করতে পারবেন।' পরীক্ষার জন্য অপ্রস্তুত হওয়ার স্বপ্ন দেখা বর্তমানে পরীক্ষার মতো কোনো কাজের জন্য অপ্রস্তুত থাকার অনুভূতির (বা ভয়) সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। সাধারণত এমন লোকেরা এই ধরনের স্বপ্নগুলো দেখেন, যারা কোনো কাজ নিখুঁত না হলে কী হবে সে সম্পর্কে অচেতন মনে অপ্রস্তুত হওয়ার ভয় পান। এই জাতীয় স্বপ্ন মানুষকে তার অতীতের অভিজ্ঞতাগুলো শনাক্ত করতে সহায়তা করতে পারে। যেমন: পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশ্বাসকে দৃঢ় করে। অন্যদিকে এমন মানুষেরাও এই ধরনের স্বপ্ন দেখতে পারে যারা কখনোই ভালোভাবে প্রস্তুতি নেয় না! তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, 'সুতরাং হ্যাঁ, এই স্বপ্নগুলো অতীতের অভিজ্ঞতা বা সাম্প্রতিক চাপের পরিচায়ক।' *স্বপ্ন বুঝতে পারলে কি কোনো উপকার হয়?* অ্যান্ডারসন থেরাপিউটিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেন, স্বপ্ন অন্বেষণ এবং বোঝা স্বপ্নদর্শীদের নিজেকে আরও গভীরভাবে বুঝতে সহায়তা করে। যেমন: তাদের সচেতন এবং অবচেতন মানসিকতা বুঝতে এবং আজ তারা জীবনে যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় তা কীভাবে প্রভাবিত হয় তা বুঝতে প্রভৃতি। সুতরাং প্রথম ধাপটি অন্তর্দৃষ্টি ও বুঝতে পারা। এটির থেরাপিউটিক গুণাগুণ রয়েছে। বিশেষত যদি কোনো পেশাদার স্বপ্ন থেরাপিস্টের সাহায্য নিয়ে এর উৎস অন্বেষণ করা হয়, তাহলে আরও বেশি থেরাপিউটিক ফল পাওয়া যায়। স্বপ্নদর্শীরা জাগ্রত অবস্থায় তাদের স্বপ্নের বিভিন্ন বিষয় (প্রতীক, আখ্যান, আবেগ) নিয়ে চিন্তা করে, স্বপ্নের বিষয়গুলোকে রূপান্তরিত করে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এই পদ্ধতিটি স্বপ্নে তাদের মন নিজেকে প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত ভাষা ব্যবহার করে ব্যক্তির অবচেতন মনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে অবচেতন বিশ্বাস, আচরণগত নিদর্শন, আবেগ বা দৃষ্টিভঙ্গিগুলো পুনরায় সাজাতে সহায়তা করে। আটলান্টিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন গবেষক ডিয়ারড্রে ব্যারেট ব্যাখ্যা করেছেন, স্বপ্নদর্শী যখন জেগে থাকা অবস্থায় উদ্বিগ্ন বোধ করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বপ্নগুলো তখন উদ্ভূত হয়। তিনি বলেন, যেসব মানুষ অল্প বয়স থেকেই সংগীত সম্পাদনা বা তৈরি করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন, তারা প্রায়ই স্কুলের বদলে অডিশনের সঙ্গে সম্পর্কিত উদ্বেগময় স্বপ্ন দেখেন। প্রতিটি স্বপ্নের দৃশ্যের মধ্যে আমরা ঘুরেফিরে সেই পরিবেশগুলো দেখি, আমাদের কোনো কাজের মাধ্যমে আমরা যেখানে কোনো না কোনো সময় সাফল্য বা ব্যর্থতার স্বাদ পেয়েছি।
Published on: 2024-04-23 15:00:35.436633 +0200 CEST