বাংলা ট্রিবিউন
২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি

২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি

কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের ঠিকাদারি কাজের দরপত্র নেওয়াকে কেন্দ্র করে ঠিকাদার মাসুদুল ইসলাম বাবুকে পেটানোর ২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ। এ ঘটনায় কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মো. জহিরুল ইসলাম রিন্টুসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনও আসামি এখনও গ্রেফতার না হওয়ায় বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী। ভুক্তভোগী ও তার স্বজনরা জানিয়েছেন, মারধরের পর ১১ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে ‘পঙ্গু হয়ে’ ঘরে আছেন মাসুদুল ইসলাম। প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঘটনার মূলহোতা ও মামলার আসামিরা। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের কার্যালয়ে সবার সামনে মারধর করা হলেও কাউকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। কার্যালয়ের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেও আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা যেতো। আসলে গ্রেফতারে আগ্রহ নেই পুলিশের। কারণ অভিযুক্তরা এমপির লোক। তবে পুলিশ বলছে, কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরকে চিঠি দিয়েও ঘটনার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া যায়নি। এজন্য মামলার আসামিদের ধরতে পারছে না পুলিশ। মারধরের শিকার মাসুদুল ইসলামের বাসা কুমিল্লার ঠাকুরপাড়া জোড়পুকুরপাড় এলাকায়। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। ৩০ বছর ধরে ঠিকাদারি করছেন। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আঞ্জুম সুলতানার সীমার অনুসারী। অভিযুক্ত জহিরুল ইসলাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কুমিল্লা-(সদর) আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীনের অনুসারী। স্থানীয় সূত্র জানায়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরসহ বিভিন্ন দফতরের ঠিকাদারি কাজের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে ছিলেন সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীনের অনুসারীরা। ২০১৯ সালে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য হন। এরপর তার অনুসারীরা ঠিকাদারি কাজ পান। বর্তমানে আঞ্জুম সুলতানা সংসদ সদস্য নেই। ফলে ঠিকাদারি নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ জোরালো হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন ধরে ঠিকাদারি কাজ নিয়ে উভয় পক্ষের দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। এরই মধ্যে গত ১ এপ্রিল দুপুরে ঠিকাদার মাসুদুল কাজের বিষয়ে কথা বলতে শিক্ষা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে যান। তখন তার পিছু নেন জহিরুল ইসলাম ও তার অনুসারীরা। ২০-২৫ জনের একটি দল তাকে পেছন থেকে ধরে ফেলেন। তারা মাসুদুলকে কার্যালয়ের দোতলায় নিয়ে যান। সেখানে বেধড়ক মারধর করেন। । পরে কুমিল্লা ট্রমা সেন্টারের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। ঘটনার পর ৩ এপ্রিল ভাইয়ের মাধ্যমে বাদী হয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন মাসুদুল। । এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন জহিরুল ইসলাম রিন্টু, তার অনুসারী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী ধর্মসাগরপাড় এলাকার সোহাগ (৪০), রেসকোর্স এলাকার ইয়াছিন (৩৭) ও শাসনগাচা এলাকার জালাল উদ্দিন (৩৮)। তবে এখনও কোনও আসামি গ্রেফতার হয়নি। এ অবস্থায় বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে ঠিকাদার মাসুদুল ইসলাম বলেন, ‘সেদিনের ঘটনা মনে হলে আঁতকে উঠি। আজও কান্না আসে। কাঠ, লাঠি, হকিস্টিক ও পিস্তলের বাঁট দিয়ে মেরেছিল তারা। স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী ইয়াছিন, সোহাগ, জালাল উদ্দিন আমাকে প্রথম মারধর শুরু করে। সবাই লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়ি পিটিয়েছে। সবগুলো লাঠি তারা আমাকে মেরেই ভেঙেছে। কয়েকজন আমার মুখে পিস্তলের বাঁট দিয়ে আঘাত করেছিল। আমি দিশাহারা হয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর কক্ষে যাই। সেখানে ওনার সামনেই আমাকে আবার মারধর করেছিল। কেউ বাঁচাতে আসেনি। পরে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ি। সেখান থেকে কয়েকজন ধরে হাসপাতালে নিয়ে যান। ঢাকার পপুলার হাসপাতালে ১১ দিন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছি। এখনও আমার হাত-পা এখনও অবশ। চলাফেরা করতে পারছি না। এত কিছুর পরও পুলিশ মামলা নিচ্ছিল না। পরে সীমা আপা (সাবেক এমপি) বহু জায়গায় কথা বলে মামলা নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু কাউকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করেনি। গ্রেফতার করবে কীভাবে? তারা সবাই এমপি বাহাউদ্দীনের অনুসারী। পুলিশও তাদের ভয় পায়। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মকর্তারাও তাদের ভয়ে আতঙ্কে আছেন।’ তারা সিন্ডিকেট ধরে রাখতে চায় উল্লেখ করে মাসুদুল বলেন, ‘তারা চায় যেন কেউ কাজ না পায়। আমাকে মেরেছিল আর বলেছিল, ‘‘তোর এমপি কই? তোরে বাঁচাইতে আসতে বল। আর টেন্ডারের জন্য আসবি? তোদের বহুত সুযোগ দিছি। আর নাহ। তার হাত–পা ভাঙ। এসব বলে মেরেছিল। আসলে তারা কাউকে টেন্ডার নিতে দেয় না। ভয়ে তাদের ছাড়া কাউকে টেন্ডার দেয় না শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর। তারা জানে তাদেরও মারবে। তাই আমাকে মারধরের সিসিটিভি ফুটেজ দিচ্ছে না। পুলিশও এই সুযোগটা পেয়েছে। সবাই জানে কারা আমাকে মেরেছিল। তবু পুলিশ গ্রেফতারের সাহস করছে না। কারণ তারা এমপির লোক।’ মাসুদুল ইসলামের স্ত্রী জিন্নাত বলেন, ‘মাসুদুলের হাত-পা মারাত্মকভাবে থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। এখন পঙ্গু অবস্থায় বাড়িতে আছে। কোনও আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় আতঙ্কে আছি আমরা।’ মামলার এতদিন পরও কোনও আসামি গ্রেফতার না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ হোসেন বলেন, ‘মামলার পরদিন কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরকে চিঠি দিয়েও ঘটনার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু আমাদের ফুটেজ দেয়নি তারা।। ফুটেজ না পেলে আসামিদের ধরবো কীভাবে।’ কেন ঘটনার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেওয়া হয়নি জানতে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আলী ইমামকে কল দিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক পরিচয় দিলে পরে কথা বলবেন বলে ফোন রেখে দেন। এরপর একাধিকবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও ফোন রিসিভ করেননি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম রিন্টুকে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি। পরে কল করলে তার মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
Published on: 2024-04-26 06:09:06.406315 +0200 CEST