বাংলা ট্রিবিউন
কেন ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা?

কেন ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা?

২১ এপ্রিল রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকায় চার বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে ১২ বছরের এক কিশোরের বিরুদ্ধে। দুই দিন আগে ১৯ এপ্রিল রাজধানীর মিরপুরে ১১ বছরের এক শিশুকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে তিন কিশোরের বিরুদ্ধে, যাদের সবার বয়স ১২ থেকে ১৪ বছর। অভিযুক্ত তিন কিশোরকেই গ্রেফতার করা হলে তারা আদালতে দায় স্বীকার করে। পরে আদালত তাদের পাঠায় কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে (সংশোধনাগার)। সম্প্রতি শিশু ধর্ষণের বেশ কয়েকটি মামলায় দেখা যায়, অভিযুক্তদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। যে কিশোরদের মাঠে খেলাধুলা করার কথা, যাদের হাতে থাকবে বই-পুস্তক, যারা স্কুল কলেজে হৈ-হুল্লোরে মেতে থাকবে, তারা কেন ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে‌? বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা কিশোরদের এ ধরনের অপরাধে জড়ানো প্রধান কারণ। তবে কোনও অপরাধের পেছনে শুধু একটি কারণ দায়ী থাকবে তা নয়। একের অধিক কারণও থাকতে পারে এবং সেগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এ বছরের গত তিন মাসের (জানুয়ারি থেকে মার্চ) তথ্য বলছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ১৮ বছরের নিচে অন্তত ৫০টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ছয় জন। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে দুই জনকে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে একজন। এছাড়াও ১০টি শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২০২২ সালে প্রকাশিত মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও বেসরকারি সংস্থা ইনসিডিন বাংলাদেশ ‘বাংলাদেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা পরিস্থিতি’ শীর্ষক একটি জরিপ প্রকাশ করে। ঢাকাসহ মোট ১১টি জেলায় ৫ হাজার ৭৪টি শিশুর ওপর ২০২০ সালের জুন থেকে মে ২০২১ পর্যন্ত জরিপ চালানো হয়। জরিপে বলা হয়, ৫৫ শতাংশ শিশু পরিবারের ভেতরেই যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। জরিপে উঠে আসে, শতকরা ৩৪টি শিশু বিভিন্নভাবে পর্নোগ্রাফি দেখেছে। এর চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে শতকরা ৭৫ দশমিক ১টি শিশু মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি দেখছে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে পারিবারিক মূল্যবোধ হ্রাস পাচ্ছে। যার কারণে উঠতি বয়সের কিশোরদের মধ্যে বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। তবে কিশোরদের মধ্যে যৌন নির্যাতনমূলক অপরাধ বৃদ্ধির প্রধান কারণ প্রযুক্তি ও ইনটারনেটের অপব্যবহার। শিশু-কিশোররা মাঠে শারীরিক চর্চার বিপরীতে ডিভাইসের বিভিন্ন সেক্সুয়াল গেমসে আশক্ত হচ্ছে। ফলে তাদের মধ্যে এ ধরনের অপরাধ সৃষ্টি হচ্ছে। প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণের কথা উল্লেখ করে সালমা আলী বলেন, অনলাইনে বিভিন্ন গেমসের নামে যে অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিশোরদের খেলার মাঠগুলোকে বন্ধ করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। এরফলে কিশোররা ডিভাইসমুখী হয়ে এমন অপরাধের দিকে ঝুঁকছে। এটা প্রতিরোধ করতে হবে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. রাহেনুল ইসলাম বলেন, শিশু-কিশোরদের কাছে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা তাদের এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার একটি বড় কারণ। কিশোররা ডিভাইসের অপব্যবহার করে অনলাইনে বিভিন্ন অশ্লীল গেমসে আশক্ত হয়ে পড়ছে। যার কারণে তারা অল্প বয়সেই যৌন বিষয়ে আগ্রহী হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শহরের শিশু-কিশোরদের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় নেই বললেই চলে। একদিকে ডিভাইসনির্ভর কৈশোর, অন্যদিকে দৈনন্দিন সামাজিক জীবন না থাকার কারণে তাদের বেড়ে ওঠাটা ভিন্ন। এই সুযোগে তারা যেন অপরাধপ্রবণ হয়ে না ওঠে সেজন্য করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের পুলিশ সুপার ইনামুল হক সাগর বলেন, কিশোর অপরাধ নির্মূলে ও শনাক্তকরণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি থানা, বিট ও কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায় সচেতনতামূলক কাজ করা হচ্ছে যাতে গোড়া থেকেই অপরাধ নির্মূল করা যায়। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পুলিশের সাইবার টিম প্রতিনিয়ত সাইবার পেট্রলিংয়ের মাধ্যমে সাইবার ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে অপরাধমূলত সাইটগুলোর কান্ট্রিলকসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে হবে। সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে তাদের গতিবিধি লক্ষ রাখতে হবে। অপরাধ নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করতে হবে। তিনি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ তথ্য দিয়ে সহায়তা চাওয়ার অনুরোধ জানান অভিভাবকদের প্রতি। প্রয়োজনে পরিচয় গোপন রাখা হবে বলেও এই কর্মকর্তা উল্লেখ করেন।
Published on: 2024-04-27 10:18:39.744837 +0200 CEST