বাংলা ট্রিবিউন
সুঁই-সুতোয় ‘স্বপ্ন বুনছেন’ ভোলার আমেনা খানম

সুঁই-সুতোয় ‘স্বপ্ন বুনছেন’ ভোলার আমেনা খানম

২০০৯ সালে বিয়ে হয় ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুরের মেয়ে আমেনা খানমের। গ্রামের অন্যসব কিশোরী-তরুণীর মতো তিনিও স্বপ্ন দেখতেন একটি সুন্দর, পরিপাটি সংসারের। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে ২০১৮ সালে। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন আমেনা। এসময় শখের বশেই শুরু করেছিলেন নকশী কাঁথা বুননের কাজ। যা ঘুরিয়ে দিয়েছে এই নারীর জীবনের গল্প। নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি তৈরি করছেন অন্যদের জন্য আয়ের পথ। তার সঙ্গে এখন কর্মসংস্থান হয়েছে গ্রামের আরও বেশ কিছু নারী। তারাও আমেনা খানমের সঙ্গে বুনছেন রঙিন স্বপ্ন। এলাকায় এখন সবার কাছেই দৃষ্টান্ত আমেনা খানম। প্রান্তিক পর্যায়ের এই নারী উদ্যোক্তা জানালেন, তার জীবনের গল্পটাও নকশী কাঁথার বুননের মতো নানান বাঁকের। ২০১৮ সালে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর এক সন্তান নিয়ে তিনি চলে আসেন বাবার সংসারে। টানাপোড়েনে সন্তানের পড়াশোনা খরচ ও পরিবারে আর্থিকভাবে সচ্ছলতা আনতে তার খুঁজতে হয় বিকল্প আয়ের পথ। ঠিক এসময় এক আত্মীয়ের কাছ থেকে নকশী কাঁথা তৈরির কাজ পান আমেনা। আমেনা খানম ছোটবেলা থেকেই এই কাজ রপ্ত করে রেখেছিলেন, তা জানতেন ওই আত্মীয়। হাতে কাজ না থাকায় শখের বশে শুরু করেন কাজ। দীর্ঘ সাত মাস ধরে নিপুণ হাতের নকশী করে কাঁথা তৈরি করে বুঝিয়ে দেন। এর বিনিময় ৩ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পান। আর এর মাধ্যমে মানসিকভাবে উজ্জীবিত হয়ে কাজের আগ্রহী হন আমেনা খানম। আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকেই তার কাছে আসতে শুরু করে নকশী কাঁথার তৈরির কাজ। আয় বাড়তে থাকে আমেনার। বর্তমানে আমেনার ‘ইউনিক নকশী হাউজে’ প্রায় ৩৫ জন নারী কাজ করেন। সরকারের সার্বিক সহযোগিতা পেলে তার প্রতিষ্ঠানটিকে একটি ব্র্যান্ডে রূপান্তর করা যাবে বলে জানান এই উদ্যোক্তা। আমেনা খানম জানান, বর্তমানে আশপাশের নারীরা বাড়িতে কাজের অবসর সময়ে আমার কাছে কাঁথা তৈরি শিখতে আসেন। অনেকেই কাজও করছেন। বাহারি সব ডিজাইনের কাঁথা বিক্রি করে বাড়তি আয়ও করছেন। বর্তমানে আমেনা খানম কাঁথা বিক্রি করে মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করে থাকেন। নকশী কাঁথার ব্যবসা করে সংসারে অভাব দূর করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বর্তমানে বাবার সংসারে এক সন্তান নিয়ে ভালোই আছেন। ব্যবসার লাভের টাকা দিয়ে ধীরে ধীরে ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। আমিনা খানম আরও বলেন, ‘আমাদের তৈরি কাঁথাগুলো একদম ইউনিক ডিজাইনের। একদমই ব্যতিক্রম আমার কাঁথার ডিজাইন অনলাইনে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার কাঁথাগুলো সম্পূর্ণই ব্যতিক্রম, সম্পূর্ণ হাতে সেলাই। এগুলোর চাহিদাও ব্যাপক। বর্তমানে অনলাইনেও আমরা নকশী কাঁথার অনেক অর্ডার পাচ্ছি। বড় সাইজের একটি নকশী কাঁথা বিক্রি হয় ৩ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে। আর ছোট সাইজের কাঁথা ১ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। ব্যবসার পরিধি বড় করার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে জানান আমেনা খানম। তিনি জানান, এর মাধ্যমে প্রান্তিক নারীদের ঘরে বসেই স্বাবলম্বী করা সম্ভব। তবে ব্যাপক আকারে এটা করার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এসব উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে ঘরে বসে থাকা নারীরাও কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়ে নিজেদের গড়ে তুলছে স্বাবলম্বী হিসেবে। স্থানীয় নারী কুলসুম বলেন, সংসারের কাজের পাশাপাশি আমি আমেনা আপার এখানে এসে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করি। সেলাই করে যে টাকা পাই তা দিয়ে আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হই। এই অর্থ দিয়ে সংসারের বাড়তি খরচ মেটাই। মিনারা নামে এক স্কুল শিক্ষার্থী বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর সময়টা হাতে সেলাইয়ের কাজ করি। কাজের পরিমাণ অনুযায়ী টাকা দেয়। সেই টাকা দিয়ে আমি আমার হাত খরচ চালাই। প্রাইভেট টিউশনির ফি দেই। মাঝে-মধ্যে পরিবারেও সহায়তা করতে পারি। স্থানীয় নারী উদ্যোক্তা লিমা রহমান জানান, আমেনা আপার কাঁথাগুলো ব্যতিক্রমী ডিজাইনের, মানও খুব ভালো। সবাই পছন্দ করেন। আমরা আমেনা আপার তৈরি কাঁথাগুলো অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিক্রি করতে সহযোগিতা করে থাকি। তবে নারীদের স্বাবলম্বী করার এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে জেলা মহিলা বিষয় অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন। বলেন, আমেনা খানমের মতো যেসব নারী উদ্যোক্তারা আছেন, যারা নিজেরা কাজ করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেন- তাদের পাশে মহিলা বিষয়ক অধিদফতর সবসময় রয়েছে। তাদের জন্য সব ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও আর্থিক সহযোগিতারা জন্য বিআরডিবি, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকসহ যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ দিয়ে থাকে তাদের সঙ্গে সংযোগ করে দিবো। যেন সহজ শর্তে ঋণ পেয়ে ব্যবসার কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে পারে। আর ভোলার এনআরবিসি ব্যাংকের ম্যানেজার আরিফুল হক রাকিব জানান, এনআরবিসি ব্যাংক অনেক আগ থেকে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে নারীর উদ্যোক্তাদের ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর জন্য এনআরবিসি ব্যাংক সহযোগিতা করছে বলেও জানান তিনি।
Published on: 2024-04-29 06:13:32.954698 +0200 CEST