বাংলাদেশ প্রতিদিন
রাস্তায় বাসের কঙ্কাল

রাস্তায় বাসের কঙ্কাল

ঢাকার চিড়িয়াখানা সড়ক থেকে কুড়িল হয়ে মালিবাগ রুটে চলাচল করে নূর এ মক্কা পরিবহন। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে যাত্রী তোলার সময় দেখা যায়, বাসের পেছনের বাম্পার থেকে বডির অংশ খুলে পড়ছে। ভেঙে চুরমার গ্লাস। বাসের রং কোথাও উঠে গেছে, কোথাও মরচে ধরা, অসংখ্য ফুটো, কোথাও বা পোস্টার সাঁটানো। পেছনের অংশের মতো সামনের দিকেও লুকিং গ্লাস ভাঙা, চা রটির মধ্যে একটি হেডলাইট নেই। নেই কোনো দিকনির্দেশক বাতি। রাজধানীজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাসের কঙ্কাল। ভাঙাচোরা, লক্কড়ঝক্কড় বাসের দৌরাত্ম্য চলছে সড়কজুড়ে। কোনোটির রং চটা, কোনোটির ছাল ওঠা। কোনোটির জানালার গ্লাস ভাঙা, কোনোটির আবার দরজাই নেই। কিছু বাসের আসনগুলোর অবস্থাও করুণ। অনেক বাসের ভিতরে প্রস্রাবের দুর্গন্ধ পাওয়া যায়, সিটে বাসা বেঁধেছে ছারপোকা। দিনের পর দিন এসব ভাঙাচোরা বাস রাস্তায় নামাচ্ছেন মালিকরা। লক্কড়ঝক্কড় বাসের ছাল- চা মড়া খুলে পড়ছে। এসব বাসকে ফিটনেস সনদ দিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ। প্রতিদিন চোখের সামনে দেখেও রাস্তায় এসব বাস চলার অনুমতি দিচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। ফিটনেসবিহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহনে চলাচল যেমন বিপজ্জনক তেমন নগরীর সৌন্দর্যহানিও ঘটাচ্ছে। বিশৃঙ্খলভাবে চলাচল করায় বাধছে যানজট। এ ব্যাপারে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ঢাকা শহরে এসব গাড়ি তৈরির অনেক কারখানা আছে। আমি নিজে দেখেছি। গাড়িতে রং লাগাচ্ছে। ১০ দিনও থাকে না এসব রং। ঢাকা শহরে প্রাইভেট কার কত আধুনিক। কিন্তু বাসগুলোর দিকে তাকানো যায় না। মফস্বল ও চট্টগ্রামে চলাচল করা গাড়ি (বাস) এর থেকে ভালো। ঢাকার এসব লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি আমাদের উন্নয়ন অর্জনকে লজ্জা দেয়।’ সরকারের নীতিমালা না থাকায় এ সুযোগ নিচ্ছেন বাস মালিকরা। দুই দশক আগেও রাজধানী ঢাকায় রুট অনুযায়ী গণপরিবহনের জন্য সুনির্দিষ্ট রং নির্ধারণ করত বিআরটিএ। সংস্থাটির নিয়ম অনুযায়ী, কোনো বাসের রং উঠে গেলে সেটি চলাচলের অনুপযোগী হবে। বিআরটিএ’র সেই সার্কুলার পরবর্তী সময়ে নতুন করে জারি করা হয়নি। বর্তমানে রাজধানীর ২৯১টি রুটে চলাচলকারী বাসের অধিকাংশই এখন লক্কড়ঝক্কড় অবস্থায় চলছে। গত তিন দিনে রাজধানীর গুলিস্তান, মিরপুর, বাড্ডা, শ্যামলী ও গাবতলী রুটে সরেজমিনে গিয়ে এমনই দৃশ্য চোখে পড়েছে। লোকাল সার্ভিস, সিটিং সার্ভিস এমনকি টিকিট সার্ভিসের গাড়িতেও একই অবস্থা। গাবতলী থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটে চলাচল করে অছিম পরিবহন। টেকিনিক্যাল মোড়ে যাত্রী তোলার সময় দেখা যায়, বাসের জানালার কাচ ভেঙে খুলে পড়ছে। পেছনের দিকনির্দেশক বাতির খাঁ চা ও স্টিলের বডি ঝুলছে। স্টপেজসহ সব লেখা, রং মুছে গেছে। বাসের তরুণ চা লক মো. সুমন বলেন, ‘এ বাসের বয়স মনে হয় আমার বয়সের চেয়েও বেশি। পাল্লাপাল্লি কইরা চলতে হয়। অন্য বাসে ধাক্কা মারে। হুড়োহুড়িতে রং ঠিক থাকে না, গ্লাস ভেঙে যায়। মরি চা পড়েও অনেক অংশ খুলে পড়েছে। মালিক এ গাড়িগুলো কখনো সার্ভিসিংয়ে পাঠায় না, প্রতিদিনই আমাদের বের হতে তাড়া দেয়।’ সাভার, শ্যামলী ঘুরে গুলশান লিঙ্ক রোড হয়ে নতুন বাজার রুটে চলাচল করে বৈশাখী পরিবহন। সাভার থেকে শ্যামলী এসে নিয়মিত অফিস করেন জোবায়ের মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি বাসের পরিস্থিতি খারাপ। জানালা, দরজা ভাঙা। হুহু করে ধুলা এসে পোশাক নোংরা করে দেয়। সিট কোনোটা হেলে পড়েছে, অধিকাংশ সিটেই ফোম নেই। শক্ত লোহার পাতের ওপর বসতে হয় যাত্রীদের। অনেক সময় ভাঙা সিটের লোহা পায়ে লেগে কেটে রক্তাক্ত হয় পা, ছিঁড়ে যায় পোশাক। আর বাইরের চেহারা তো বর্ণনা করা সম্ভব না। কোনো বাসেই রং নেই। ছালবাকল, স্টিলের পাত উঠে বেরিয়ে এসেছে কঙ্কালের মতো ইঞ্জিন।’ তার পাশের যাত্রী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘নগর পরিবহনের এত বিশৃঙ্খল অবস্থা কিন্তু কোনো সমাধান নেই। সব সংস্থার চোখের সামনে দিয়েই রাজধানীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লক্কড়ঝক্কড় এসব বাস।’ আবদুল্লাহপুর, নতুনবাজার, পল্টন, সরদঘাট রুটে চলাচল করে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহন। রাস্তার মাঝখানে বাঁকা করে গাড়ি রেখে যাত্রী ওঠানোনামানো করাচ্ছেন হেলপার। রাস্তাজুড়ে একই কাজ করেন এ কোম্পানির বাসের চা লকরা। মাঝখানে গাড়ি রাখায় যেতে পারে না অন্য গাড়িগুলো, বাধে ভয়াবহ যানজট। এ গাড়িতে নিয়মিত খিলক্ষেত থেকে পল্টন যাতায়াত করেন ফরহাদ হোসেন। পল্টনে দোকান রয়েছে তার। তিনি বলেন, ‘বাসগুলোর অধিকাংশের রং উঠে গেছে, বিভিন্ন জায়গায় জোড়াতালি দেওয়া। বাসের ভিতরে নোংরা, সিটে বাসা বেঁধেছে ছারপোকা। গাড়ি না থামিয়ে শুধু গতি কমিয়ে রাস্তার মাঝখানে যাত্রী নামিয়ে দিচ্ছে তারা। মধ্যবাড্ডায় নামতে গিয়ে গতকাল এক বয়স্ক নারী পড়ে যান। পেছনে বাস না থাকায় অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচেন তিনি। এ নিয়ে যাত্রীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বাসের সুপারভাইজারের ওপর।’ এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ‘রাজধানীর রাস্তা থেকে লক্কড়ঝক্কড় বাস সরানো যায়নি। ফলে শৃঙ্খলা ফেরেনি গণপরিবহনে। এজন্য শক্ত রাজনৈতিক পদক্ষেপ জরুরি ছিল। এর ঘাটতি থাকায় সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশের বড় গাফিলতি আছে। স্থানীয় রাজনীতি আছে, মালিক-শ্রমিক আছে। মানুষকে জিম্মি করে কিছু মানুষ হালুয়া রুটি খাচ্ছে। সড়কে নামলে দেখা যায়, কিছু বাসের হেডলাইট নেই, ইনডিকেটর নেই, লুকিং গ্লাস নেই। কিন্তু দিনের পর দিন সবার চোখের সামনে রাস্তায় এসব বাস চলছে। দূষণে বাসযোগ্য নগরীর তলানিতে ঢাকা! অথচ কারও কোনো জবাবদিহি নেই।’
Published on: 2024-03-21 19:26:57.891199 +0100 CET