বাংলাদেশ প্রতিদিন
টাকা দাও পদ নাও

টাকা দাও পদ নাও

দেশের রাজনীতিতে কমিটি বাণিজ্যের রমরমা অবস্থা চলছে। কি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, কি মাঠের বিরোধী বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সব রাজনৈতিক দলেই এখন পদ বেচাকেনা হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না ইসলামী কিংবা বাম রাজনৈতিক দলগুলোও। তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত লাভজনক এ বাণিজ্য। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, ‘টাকা দাও পদ নাও’ রীতিমতো ওপেন সিক্রেট। টাকাই এখন দলগুলোর কমিটি গঠন আর পদায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম মুখ্য যোগ্যতার মাপকাঠি। ফলে ত্যাগী, সৎ, দক্ষ, আগ্রহী ও সক্রিয় নেতা-কর্মীরা ছিটকে পড়ছেন। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সমাজসেবী, ব্যবসায়ী, এমনকি মাদক ব্যবসায়ী, ফুটপাত থেকে মাসোহারা তোলা চাঁদাবাজরাও পেয়ে যাচ্ছে পদপদবি। সে কারণে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত হিংসাবিদ্বেষ। আর অশিক্ষিত, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, সমাজে টাউট হিসেবে পরিচিতরা দখল করে নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এসব কমিটি বাণিজ্য বা পদপদবি বেচাকেনার অভিযোগের মূল কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকা। আর দলের ভিতরে গণতন্ত্রচর্চাহীনতার কারণ সার্বিকভাবে দেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি।’ ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের মধ্যে নৈতিকতা র স্খলন ঘটেছে। পেশিশক্তি, অর্থের প্রভাবও এর অন্যতম কারণ। তা ছাড়া রাজনীতি অর্থবিত্তের মালিক আর মুনাফাখোরেরা দখল করে নিয়েছে। যার ফলে আজ এ পদ বেচাকেনা বাণিজ্যের অভিযোগ উঠছে।’ *আওয়ামী লীগ :* টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এ সময়ে জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে ‘টাকা’ নিয়ে কমিটি দেওয়ার অনেক অভিযোগ জমা পড়ে কেন্দ্রে। কোনো দিন রাজনীতি না করেও টাকা দিয়ে নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা কিংবা ক্ষমতাবান কোনো নেতার ‘আশীর্বাদে’ কোনো কমিটিতে পদ বাগিয়ে নেওয়ার ঘটনা দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে ওপেন সিক্রেট। যত দিন যাচ্ছে টাকার বিনিময়ে পদ বিক্রি তত বাড়ছে। জেলা-মহানগর-উপজেলা কমিটিতে বাণিজ্যের মাধ্যমে যে কমিটি হচ্ছে, সে কথা খোদ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্যদের মুখ থেকেই উঠে এসেছে। ২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর খিলগাঁওয়ে ঢাকা মহানগরীর ইউনিট-ওয়ার্ড-থানা সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আপনারা দলটাকে বাঁচান। টাকাপয়সার লেনদেন বন্ধ করেন। কমিটি করতে টাকা লাগবে-এটা বিএনপিতে হতে পারে। আওয়ামী লীগ এটা প্র্যাকটিস (চর্চা) করতে পারে না। টাকাপয়সা নিয়ে মনোনয়ন, টাকাপয়সা নিয়ে কমিটি গঠন এ প্র্যাকটিস চিরতরে বন্ধ করতে হবে-এটা শেখ হাসিনার নির্দেশ।’ দলের সাধারণ সম্পাদকের এ নিদের্শনাকেও গুরুত্ব দেননি সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিটের নেতারা। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের থানা-ওয়ার্ড কমিটি গঠনে। অধিকাংশ থানায়ই টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে। ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ যুবলীগ একটা সময় অনেক শক্তিশালী সংগঠন ছিল। পদবাণিজ্য, মাইম্যান বসানোসহ নানা কারণে বর্তমানে দুর্বল হয়ে পড়েছে সংগঠনটি। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি গঠনে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দক্ষিণের শক্তিশালী একটি ওয়ার্ড ছিল ২০ নম্বর। এ ওয়ার্ডের অধীন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, সিটি করপোরেশন, সচিবালয়, শিক্ষা ভবন, খাদ্য ভবন, গণপূর্ত ভবন, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষসহ গুরুত্বপূর্ণ অফিস। কমিটি থাকার পরও এ কমিটি নিজের কবজায় নিতে বিতর্কিতদের দিয়ে কমিটি করা হয়েছে। ২০ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজাদ অভিযোগ করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা টাকা দিতে পারি নাই, তাই কমিটিতে ঠাঁই হয়নি। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক টাকার বিনিময়ে এ ওয়ার্ডে আহ্বায়ক কমিটি দিয়েছে।’ শুধু ২০ নম্বরেই নয়, এমনভাবে কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে ৫৪, ৩৭, ৫, ৫০ ও ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডে। মাদক ব্যবসায়ী, চিহ্নিত চাঁদাবাজ, হত্যা মামলার আসামিদের কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাইনুদ্দিন রানা বলেন, ‘আমার কাছে এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। আপনাদের কাছে থাকলে সেগুলো যাচাই করে দেখেন।’ ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রেজা বলেন, ‘রাজপথের পরীক্ষিত কর্মীদের দিয়েই আমরা যুবলীগের কমিটি গঠন করেছি। কমিটি বাণিজ্যের কোনো প্রশ্নই আসে না।’ শুধু যুবলীগ নয়, কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, ২০১২ সালে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মারা যায় ১১১ জন পোশাকশ্রমিক। সেই ঘটনার মূল আসামি তাজরীনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ঢাকা মহানগরী উত্তর মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি করা হয়েছে। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। *বিএনপি :* দেশের রাজপথের সর্ববৃহৎ বিরোধী দল এখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। গঠনতন্ত্র অনুমোদিত নয়টি অঙ্গসংগঠনসহ বেশ কয়েকটি সহযোগী সংগঠন নিয়ে এ দলটি পরিচালিত হচ্ছে। ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছে এক যুগের বেশি সময় ধরে। মামলা-হামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড, কারাবরণসহ নানা ধরনের নিপীড়নের মধ্য দিয়ে দিন কাটছে নেতা-কর্মীদের। তার মধ্যেও বন্ধ নেই কমিটি ও পদ বাণিজ্য। দেদার চলছে টাকাপয়সার লেনদেন। কেন্দ্র থেকে শুরু করে মহানগর, জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন, পৌরসভা ও ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত তা ছড়িয়ে গেছে। এত বিপদের মধ্যেও যখনই কমিটি গঠনের প্রশ্ন আসে, তখনই লেনদেন শুরু হয়ে যায়। টাকার বিনিময়েই গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ পদপদবি বিলিবণ্টন হয়ে থাকে। মূল দল ছাড়াও অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে এ বাণিজ্য এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। সবাই জানেন, দেখেন কিন্তু কেউ এর বিরুদ্ধে কিছুই বলতে পারছেন না। দলে যেসব নেতা একটু নীতি- নৈতিকতা মেনে চলার চেষ্টা করেন, তাঁরা এসব নিয়ে রীতিমতো অতিষ্ঠ। সরাসরি না বলতে পারলেও পরোক্ষভাবে হলেও মাঝেমধ্যে কেউ কেউ দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। কিন্তু তেমন কোনো ফায়দা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। সম্প্রতি রাজধানীর আদাবরে এক ইফতার অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সদ্যকারামুক্ত প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান ঢালী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দলের ভিতরে অবিলম্বে শুদ্ধি অভিযান চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন। এর মধ্য দিয়েই দল আগাছামুক্ত হবে এবং সঠিক নেতৃত্ব বের হয়ে আসবে। মাত্র কয়েক মাস আগেই (গত বছরের ৮ নভেম্বর) দলের অভ্যন্তরে সংস্কার চেয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম। তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, দলে সংস্কার করুন। এখন যেভাবে চলে সেভাবে কোনো রাজনৈতিক দল চলতে পারে না। রাজনৈতিক দলের কাউন্সিল কেন্দ্রীয় কমিটি করবে, কেন্দ্রীয় কমিটি জেলা কমিটি করবে। পর্যায়ক্রমে এভাবেই কমিটি হবে। আজ দলে কেন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলো, কেন কমিটি বাণিজ্য হচ্ছে, কেন ত্যাগী নেতারা নির্বাসিত থাকবেন তা দেখতে হবে। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও সারা দেশে বিভিন্ন বিভাগ, মহানগর, জেলা, উপজেলা পর্যন্তও এ কমিটি তথা পদপদবি বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়েছে। তার মধ্যে প্রভাবশালীদের পছন্দ আর টাকার বিনিময়ে পদ বিক্রির গ্যাঁড়াকলে পড়েছে বরিশাল বিএনপি। যে কারণে তিন বছরের বেশি সময় ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় বাতিল হয়েছিল বরিশাল (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির কমিটি। এরপর হওয়া কমিটির বিরুদ্ধেও প্রভাবশালীদের ইচ্ছেমতো অধস্তন কমিটি ভাঙা-গড়ার অভিযোগ উঠেছে। বছরখানেক আগে বরগুনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির বিরুদ্ধে কোটি টাকার পদবাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। পদ দেওয়ার বিনিময়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা নিয়েছেন কমিটির আহ্বায়ক, সদস্যসচিবসহ চার নেতা। এখানেই শেষ নয়। বিকাশের মাধ্যমেও নেওয়া হয় টাকা। টাকার মোহে তারা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন যে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়েও বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন জেলার শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। এ নিয়ে বিএনপিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয় তখন। বিএনপির সহযোগী সংগঠনেও কমিটি গঠন নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, হবিগঞ্জ, জামালপুরসহ কয়েকটি জেলার অনেক উপজেলায় সম্মেলন ছাড়াই নগদ টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ উঠেছে। এদিকে কমিটি বাণিজ্য জাতীয় পার্টিতে স্বাভাবিক বলে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলছে দীর্ঘদিন থেকে। জাতীয় পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, নিয়মনীতি এখানে নেই। নীতিনির্ধারকরা যখন খুশি বহিষ্কার, যখন খুশি দলে ঠাঁই দিতে পারেন। গঠনতন্ত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাজনীতি-বিশ্লেষক ড. মীজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগে ছিল জনগণের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করা। এখন পাওয়ার জন্য রাজনীতি করা। সে কারণে যারা পদে আসতে চান কিংবা পদ দিতে চান অর্থের বিষয়টি সামনে আছে। এখন একজন ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটিতে আসতে ২০-৩০ লাখ টাকা ব্যয় করেন। একটি উপকমিটিতে ঢুকতে ৫-১০ লাখ টাকা ব্যয় করেন। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে-কেন ব্যয় করছেন? নিশ্চয় পদপদবি কাজে লাগিয়ে বা অপকর্ম করে টাকা কামাবেন। রাজনীতি যখন জনগণের স্বার্থে হবে, নিঃস্বার্থভাবে জনগণের কল্যাণে কাজে লাগবে তখন টাকার খেলা বন্ধ হবে। তা না হলে কমিটি বাণিজ্য বা পদবাণিজ্য চলবেই।’
Published on: 2024-04-02 20:33:29.215608 +0200 CEST