বাংলাদেশ প্রতিদিন
পৌরসভা যেন আবর্জনার ভাগাড়

পৌরসভা যেন আবর্জনার ভাগাড়

দেশের পৌরসভাগুলো যেন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সময়মতো নাগরিক বর্জ্য অপসারণ না করায় দূষণে-দুর্গন্ধে বিপন্ন নাগরিক জীবন। অধিকাংশ পৌর এলাকায় প্রকাশ্যে সড়ক ও জনবসতির পাশেই আবর্জনা রেখে দেওয়া হচ্ছে। পৌরসভার মেয়ররা বলছেন, অর্থাভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিতে পারছেন না তাঁরা। জমি কিনে ডাম্পিং স্টেশন বানানোর সংগতিও নেই অনেকের। দেশের অধিকাংশ পৌরসভায়ই গৃহস্থালি ও মেডিকেল বর্জ্য নিয়মমাফিক অপসারণের সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। ফলে নাগরিক সেবার পরিবর্তে নাগরিক ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠেছে পৌরসভাগুলো। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের কয়েকটি রিপোর্টে উঠে এসেছে দেশের চিত্র- *বগুড়া :* অপরিকল্পিত ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ের দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ শহরবাসী। বেশির ভাগ ভাগাড় রাস্তার পাশে হওয়ায় ময়লা-আবর্জনা চলে আসে রাস্তায়। আয়তনে দেশের বৃহত্তম বগুড়া পৌরসভায় ১০ লাখের বেশি মানুষের বাস। এসব জনবসতি থেকে প্রতিদিন গড়ে আড়াই শ টনের বেশি ময়লা-আবর্জনা জমা হয়, যেগুলো ফেলা হচ্ছে শহরের রাস্তার ধারে। সূত্র জানান, ১৮৭৬ সালে স্থাপিত বগুড়া পৌরসভায় ২০০৭ সালে ৬৯ দশমিক ৫৬ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে ২১ ওয়ার্ডে বর্ধিত করা হয়। ২০০৭ সালের আগে শহরের প্রতি মহল্লায় ডাস্টবিন থাকত। বাসিন্দারা বাসাবাড়ির আবর্জনা সেখানে ফেলত। পরে পরিবেশ রক্ষায় সব ডাস্টবিন সরিয়ে দেওয়া হয়। ভ্যানের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ ডাস্টবিন চালু করে পৌরসভা। এ কাজের জন্য গঠিত হয় মহল্লাভিত্তিক কমিউনিটি বেইজড্ অর্গানাইজেশন (সিবিও)। এ সংগঠনের মাধ্যমে ভ্যানে ময়লা নিয়ে শহরের বিভিন্ন ট্রান্সফার স্টেশনে রাখা হয়। সেখান থেকে গারবেজ ট্রাকে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ময়লা ফেলেন ভাগাড়ে। প্রায় দেড় শ বছরের প্রাচীন পৌরসভা হয়েও আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ফলে বর্জ্যগুলো ঘুরেফিরে পড়ে থাকছে লোকালয়ের মাঝেই। পৌরসভার দাবি, বড় বাজেটের প্রকল্প ছাড়া এমন পরিকল্পনা নেওয়া বগুড়া পৌরসভার পক্ষে সম্ভব নয়। বগুড়ায় প্রায় ১৭২টি সিবিও আছে। গারবেজ ট্রাক আছে ১৯টি। এর মধ্যে দুটি ছাড়া বাকিগুলো পৌরসভার ভাড়া নেওয়া। প্রতিদিন শহরের বনানী রেশম উন্নয়ন বোর্ড, ঠনঠনিয়া, সেউজগাড়ী কৃষি অফিস, রেলস্টেশন, শিববাটি শিল্পকলা একাডেমির সামনে রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় ময়লা ফেলা হচ্ছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে সপ্তপদী মার্কেটের সামনে, ফতেহ আলী বাজারের সামনে, এসপি ব্রিজে প্রতিদিনই ময়লার স্তূপ হয়। অনেক এলাকার আবর্জনা সরাসরি শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীতে পড়ছে। বগুড়া পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের অন্যতম সমস্যা লোকবল। এজন্য আমাদের কাজে একটু ঘাটতি থাকে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করি ময়লা-আবর্জনা দ্রুত অপসারণের। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের জন্য বড় ধরনের প্রকল্প প্রয়োজন।’ *টাঙ্গাইল :* ১৩২ বছরের পুরনো টাঙ্গাইল পৌরসভায় আজও গড়ে ওঠেনি আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। শহরে প্রবেশের তিনটি পথের প্রধান দুটির পাশে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। ফলে দুর্গন্ধে নাক চেপে শহরে ঢুকতে হয়। এ দুর্গন্ধ দিয়েই যেন স্বাগত জানানো হয় শহরবাসী ও শহরে আগত অতিথিদের। রাস্তার পাশে আবর্জনা ফেলায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে ওই পথে চলাচলকারী মানুষ। ২৯ দশমিক ৪৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ পৌরসভায় প্রায় ২ লাখ লোকের বাস। সাত-আট বছর ধরে শহরের আবর্জনা ফেলা হচ্ছে উত্তর দিক দিয়ে শহরের প্রবেশমুখ রাবনার টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের পাশে। দক্ষিণাংশের ময়লা ফেলা হচ্ছে শহরের আরেক প্রবেশমুখ কাগমারী বেবিস্ট্যান্ড এলাকায়। শহরের আশেকপুরে আবর্জনা ফেলা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলায় ওই এলাকায় বসবাসকারী ও এ পথ দিয়ে চলাচলকারীরা দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ। এ ছাড়া মৃত জীবজন্তু, গরু-ছাগল, কুকুরও এ ময়লা-আবর্জনার সঙ্গে ফেলা হচ্ছে। এতে দুর্গন্ধে ওই এলাকায় দাঁড়ানো যায় না। বাসাবাড়িতে বসবাস করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এদিকে প্রায়ই আবর্জনায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তখন ধোঁয়া ও গন্ধে আশপাশের মানুষকে পোহাতে হয় চরম কষ্ট। একই চিত্র দেখা যায় বেবিস্ট্যান্ড এলাকায়। সেখানে আবর্জনার ভাগাড় অতিক্রম করে দক্ষিণাংশের মানুষকে মূল শহরে ঢুকতে হয়। বেবিস্ট্যান্ড এলাকায় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় পেরিয়েই যাতায়াত করতে হয় মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এম এম আলী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের। এম এম আলী সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক শেখ মো. রওশন আলমের স্ত্রী শাহিনা আক্তার বলেন, ‘বেবিস্ট্যান্ড কাগমারী এলাকায় যেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে এখানেই আমার বাসা। পরিবার নিয়ে অনেক দুর্গন্ধের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে। আমরা খুবই সমস্যার মধ্যে আছি।’ টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র এস এম সিরাজুল হক আলমগীর বলেন, ‘আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। শহরের উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। ময়লা ফেলার ডাম্পিং স্টেশন করার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা আমাদের নেই। জেলা প্রশাসনের কাছে জায়গা চেয়েছি। জায়গা পেলে ময়লা রিসাইকেল করে পরিবেশ সুন্দর করব।’ শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। *কালিয়াকৈর :* গাজীপুরের কালিয়াকৈর দেশের প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় ময়লার গন্ধে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর। পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির জমিতে রাখা হয়। আবর্জনা থেকে ছড়ানো দুর্গন্ধের মধ্য দিয়েই চলাচল করতে হয় হাজারো মানুষকে। বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির জমিতে ময়লার ভাগাড়ে গিয়ে দেখা যায়, এটি আবর্জনায় ভরে গেছে। পৌরসভার ময়লা পরিবহনের গাড়ি সারা দিন শহরের আবর্জনা এনে সেখানে ফেলে। এমনকি হাসপাতাল-ক্লিনিকের বর্জ্যও এখানে ফেলা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রাণীর মৃতদেহও ভাগাড়ে ফেলা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আসিফ বলেন, ‘ময়লার গন্ধে আমাদের ক্লাসে নাক চেপে বসতে হয়। বারবার বলার পরও পৌরসভা এখানেই ময়লা-আবর্জনা ফেলছে।’ কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে বিষয়টিতে পদক্ষেপ নিয়েছি। খুব তাড়াতাড়ি ময়লা-আবর্জনার ডাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।’ *ফরিদপুর :* ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার কলেজ রোড সংলগ্ন ২ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের শেষ সীমানায় রাস্তার পাশ দিন দিন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। ময়লার স্তূপ থেকে বের হওয়া উৎকট দুর্গন্ধ ও ধোঁয়ায় চরম বিপাকে পথচারীসহ পৌরবাসী। স্থানীয়দের অভিযোগ, অপরিকল্পিতভাবে দিনের পর দিন পৌরসভা থেকে এসব ময়লা-আবর্জনা ফেলায় দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। নাকে কাপড় না দিয়ে কিংবা নিঃশ্বাস বন্ধ না করে এ রাস্তা দিয়ে চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া এখানে সব সময় ময়লায় উৎপন্ন মিথেন গ্যাসের আগুন জ্বলতে থাকে। পাশে রয়েছে বৈদ্যুতিক খুঁটি তাতে রয়েছে তিনটি ট্ রান ্সমিটার। যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র নিমাই চন্দ্র সরকার বলেন, ‘পৌরসভার তহবিলে জমি কেনার মতো টাকা নেই। সরকারিভাবে জমি কেনার একটা প্রস্তাব দিয়েছি। সেটা পাস হলে আমরা জমি কিনে দ্রুত ময়লা ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করব।’
Published on: 2024-04-03 21:09:44.4062 +0200 CEST