বাংলাদেশ প্রতিদিন
উপজেলায় এমপিদের পরিবারতন্ত্র

উপজেলায় এমপিদের পরিবারতন্ত্র

পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মেতে উঠেছেন জাতীয় সংসদের সদস্যরা (এমপি)। উপজেলা পরিষদকে নিজের মুঠোয় রাখতে আসন্ন নির্বাচনে নিজেদের পরিবার থেকে প্রার্থী দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এমপিরা। তাদের কারও কারও স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ভাই-ভাতিজা, শ্যালক, মামা-ভাগ্নের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে উপজেলার প্রার্থিতা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বজনদের জিতিয়ে নিয়ে আসতে ‘অর্থ-ক্ষমতা-প্রভাব’কে হাতিয়ার করে মাঠে অন্তত ২০ এমপি। এদের মধ্যে কয়েকজন স্বতন্ত্র এমপি রয়েছেন, যারা আওয়ামী লীগেরও নেতা। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন এবার চা র ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধাপে ৮ মে ও দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে ভোটের তারিখ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এতদিন জেলা-উপজেলার দলীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো নিজেদের পরিবারের দখলে রাখার চেষ্টায় থাকতেন সরকারদলীয় এমপিরা। এবার তাদের চোখ পড়েছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। উপজেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তারা। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড দলীয় প্রার্থী না করতে বারবার নির্দেশনা দিলেও কর্ণপাত করছেন না তারা। দলের হাইকমান্ডকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ‘এমপি লীগ’, ‘এমপিতন্ত্র’ কায়েমে আদাজল খেয়ে নেমেছেন তারা। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে দেশের উপজেলাগুলোতে এমপিদের পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রাক-নির্বাচনি তৎপরতা। কুমিল্লা-১০ আসনের এমপি, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠেয় কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তাঁর ভাই         গোলাম সরোয়ারকে চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন। মুস্তফা কামালের নির্বাচনি এলাকার লালমাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম শাহীন তার ভাতিজা। নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের এমপি, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। দ্বিতীয় ধাপে রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এ ভোটে সরকারদলীয় এই এমপি তাঁর ছেলে গাজী গোলাম মর্তুজা পাপ্পাকে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। গোলাম দস্তগীর গাজীর স্ত্রী মিসেস হাসিনা গাজী তারাব পৌরসভার মেয়র। এখানে পরিবারতন্ত্র চলছে বলে রূপগঞ্জ উপজেলার নেতারা অভিযোগ করেছেন। নাটোর-৩ আসনের এমপি, ডাক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সিংড়া উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী ঘোষণা করেছেন লুৎফল হাবীব রুবেলকে। তিনি পলকের শ্যালক। এখানে তিনজন প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু এমপি একক প্রার্থী ঘোষণা করায় নেতা-কর্মীদের ভিতরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বগুড়া-১ আসনের এমপি সাহাদারা মান্নানের ছেলে সাখাওয়াত হোসেন সজলকে সারিয়াকান্দি উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। এ নিয়ে এলাকায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সজলকে প্রার্থী না করতে উপজেলার ১২ ইউনিয়নের মধ্যে ১১ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। শুধু ছেলেকেই নয়, ছোট ভাই মিনহাদুজ্জামানকে সোনাতলা উপজেলা প্রার্থী ঘোষণা করেছেন এমপি সাহাদারা মান্নান। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা এ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক তাঁর নির্বাচনি এলাকা টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী করেছেন তার খালাতো ভাই হারুনুর রশিদকে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা করে প্রার্থী ঘোষণা দেন দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের এই নেতা। মৌলভী বাজারে র বড়লেখা উপজেলা নির্বাচনে ভাগ্নে শোয়েব আহমেদকে  চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন মৌলভী বাজার -১ আসনের এমপি শাহাব উদ্দিন। মাদারীপুর সদর উপজেলায় নিজের ছেলে মো. আসিবুর রহমান খানকে  চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা করেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাদারীপুর-২ আসনের এমপি মো. শাজাহান খান। আসিবুর রহমান জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য। নোয়াখালী-৬ আসনের এমপি মোহাম্মদ আলী। হাতিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশেক আলী ওমি একক চেয়ারম্যান প্রার্থী। মোহাম্মদ আলী পরিবারের কাছে উপজেলা আওয়ামী লীগ জিম্মি থাকায় কেউ প্রার্থী হওয়ার সাহস দেখাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সুনামগঞ্জ-৩ আসনের এমপি, সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তাঁর ছেলে সাদাত মান্নানকে চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। ছেলেও নিয়মিত গণসংযোগ করে চলেছেন। নোয়াখালী-৩ আসনের এমপি মামুনুর রশিদ কিরণ। বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে তাঁর ছেলে জিহান আল রশিদকে চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন। দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে চা পা ক্ষোভ বিরাজ করছে। মানিকগঞ্জ-৩ আসনের এমপি, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী করা হয়েছে জাহিদ মালেকের ফুফাতো ভাই ইসরাফিল হোসেনকে। মামাতো ভাইয়ের আশীর্বাদ নিয়ে নির্বাচনি মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন ইসরাফিল। পিরোজপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শামীম শাহনেওয়াজ। তাঁর ছোট ভাই বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিনকে আবারও মঠবাড়িয়ায় প্রার্থী করা হয়েছে।  নরসিংদী-৩ আসনের এমপি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেছেন, তাঁর নির্বাচনি এলাকা শিবপুর উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হবেন তাঁর স্ত্রী ফেরদৌসী ইসলাম। তিনি তাঁকে সমর্থন জানাবেন। ফেরদৌসী ইসলাম শিবপুর উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের এমপি আলী আজগর টগর। তাঁর নির্বাচনি এলাকা দামুড়হুদা উপজেলায় আপন ভাই আলী মুনসুর বাবুকে চেয়ারম্যান প্রার্থী করেন তিনি। এর আগের নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে নিজের ভাইকে প্রার্থী করেছিলেন আলী আজগর টগর। এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজন ও পরিবারতন্ত্র কায়েম করায় মাঠপর্যায়ে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। ঈদ ের পর পরিস্থিতি কী হয় সেটি নিয়েও সংকটে মাঠপর্যায়ের নেতারা। এ নিয়ে বিরোধ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ প্রতীকবিহীন ভোটেও কেন এমপিদের পছন্দের ‘একক’ প্রার্থী করতে হবে? তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সবাই। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতারা বলছেন, এবার উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দলের বার্তা পরিষ্কার। এ নির্বাচনে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। যারাই হস্তক্ষেপ করবে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহীর সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচন সম্পর্কে দলের অবস্থান পরিষ্কার করা হয়েছে। এমপি-মন্ত্রীরা তাদের আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে নিজেদের পছন্দমতো প্রার্থী করছেন। একই সঙ্গে তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর এক ধরনের চা প প্রয়োগ করছেন। আশা করছি, ঈদ ের পর এ বিষয়টি চিহ্নিত করে ওইসব এমপি-মন্ত্রীকে কঠোর বার্তা দেওয়া হবে। তা না হলে নেত্রীর যে উদ্দেশ্য অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচন- তা কতিপয় ব্যক্তির কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’ দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দল কাউকে মনোনয়ন দেবে না। যারা ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন দিচ্ছেন তারা নির্দেশনা ভঙ্গ করছেন। দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশনা ও দলের সাধারণ সম্পাদকের বিবৃতি কোনোভাবেই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেবে, যে কেউ প্রার্থী হতে পারবে। জনগণ পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থী নির্বাচিত করবে। কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।’
Published on: 2024-04-08 05:33:09.329662 +0200 CEST