Bdnews24 Bangla
‘একশ চাপেও এক জগ পানি ওঠে না টিউবওয়েলে’

‘একশ চাপেও এক জগ পানি ওঠে না টিউবওয়েলে’

বৃষ্টির অভাবে ও তীব্র দাবদাহে পদ্মা নদীর তীরের জেলা রাজবাড়ীতে নেমে গেছে পানির স্তর। এতে টিউবওয়েলে পানি না ওঠায় চরম সংকটে পড়েছেন মানুষ। কালুখালী উপজেলার নূরজাহান বেগম বলছিলেন, “টিউবওয়েল চাপতে চাপতে ক্লান্ত হয়ে যাই। গা ঘেমে পানি বের হয় কিন্তু একশত চাপেও এক জগ পানি বের হয় না টিউবওয়েল থেকে।“ গ্রামের প্রায় প্রতিটি টিউবওয়েল একই অবস্থা উল্লেখ করে উপজেলার মদাপুর ইউনিয়নের দামুকদিয়া গ্রামের এই নারী আরও বলেন, “কী করে রান্না করবো আর কী খাবো? নিজেদের কষ্টতো হয়ই গরু-ছাগলেরও কষ্ট হচ্ছে। এই কষ্টের শেষ নেই।” সরেজমিনে জেলার সদর, পাংশা, কালুখালী ও বালিয়াকান্দি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পদ্মা, গড়াই, হড়াই, চন্দনা নদী বিধৌত এলাকা হলেও দৈনন্দিন ব্যবহার ও সুপেয় পানির জন্য এসব এলাকার মানুষের মূল ভরসা টিউবওয়েল। কিন্তু সেসব টিউবওয়েলে পানি না ওঠায় মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে টিউবওয়েল বন্ধ রয়েছে। কিছু টিউবয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করা গেলেও তা পর্যাপ্ত না। সুপেয় পানির চাহিদা মেটানোর জন্য এক পাড়া থেকে অন্য পাড়াতে গিয়ে পানি আনতে হচ্ছে। অনেকেই আবার পাম্প বসিয়ে নিয়েছেন পানি তোলার জন্য। তবে সেখানেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। কারণ রাতে পানি উঠলেও দিনে পানি উঠছে না। এদিকে তীব্র দাবদাহে অধিকাংশ পুকুর, খাল ও ছোট নদীতে পানি শুকিয়ে গেছে। ফলে সংকট আরও বেড়েছে। গবাদিপশু লালন-পালন ও পরিবারের রান্না গোসলসহ অন্যান্য প্রয়োজনে পরিমাণ মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এতে হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। দামুকদিয়া গ্রামের আরেক বাসিন্দা অমল কুমার বিশ্বাস বলেন, “আমার টিউবওয়েল ২৭০ ফুট গভীর তবুও দুই মাস ধরে পানি ওঠে না। পাশের বাড়ি থেকে সকালে গিয়ে পানি নিয়ে আসি। “বার বার তো তাদের বাড়িতে পানি আনতে গিয়ে বিরক্ত করা যায় না। তাই খাবার পানি, গোসলসহ পরিবারের বিভিন্ন কাজে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।” ওই গ্রামের রোকেয়া বেগম বলেন, “খুবই সমস্যায় আছি। আমার বাড়ির আশপাশের দশ বাড়ির একটাতেও টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। অনেক দূরের এক বাড়ি থেকে পানি আনতে হয়। কিন্তু ওই বাড়ির মানুষও পানি দিতে চায় না। বলে যে- তোমাদের পানি দিলে আমাদের টিউবওয়েলের পানি শেষ হয়ে যাবে।” পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আছিয়া বেগম, নাজমা বেগম ও হাজেরা বেগম। তারা বলেন, টিউবওয়েলে পানি না ওঠায় সমস্যায় তো আছিই, তারওপর খাল ও পুকুরেও পানি নাই। তারা তো কষ্ট করছেন, সঙ্গে গরু-ছাগলসহ অন্য প্রাণীরও কষ্ট করছে। কিন্তু চেয়ারম্যান-মেম্বাররা কেউ খোঁজ নিচ্ছে না। পাংশা উপজেলার সরিষা গ্রামের পলাশ হোসেন বলেন, “টিউবওয়েল থেকে এক বালতি পানি ওঠাতে গেলে কমপক্ষে কত চাপ দিতে হয় সেটা জানি না। তবে হাত ব্যথা হয়ে গেলেও যে পানি ওঠে তা দিয়ে শান্তি মত গোসলও করতে পারি না। “এভাবে কত দিন চলবে জানি না। মাস খানেক আগে একটু উঠলেও এখন তাও উঠতে চায় না।” একই উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়নের আনিছুর রহমান বলেন, “আমাদের বাড়ির টিউবওয়েল থেকে পানি ওঠা বন্ধ হয়েছে আরও এক মাস আগেই। বাড়ি থেকে কয়েক বাড়ি পরে একটি টিউবয়েল থেকে পানি নিয়ে এসে খাওয়াসহ রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। “আমরা ছেলেরা না হয় দূরে গিয়ে পুকুর অথবা নদী থেকে গোসল দিয়ে আসি কিন্তু বাড়ির মেয়েদের অবস্থাতো আরও খারাপ।” সদর উপজেলার চন্দনী ইউনিয়নের বাসিন্দা খাইরুল ইসলাম বলেন, “কলে পানি ওঠে না বলে মটর বসাইছি। এখন দেখি দিনে মটর ঘুরতে থাকে কিন্তু পানি উঠে না। তাই রাত দশটা এগারোটার দিকে মটর ছেড়ে পানি বালতি, ড্রামে ভরে রাখি সারাদিনের জন্য। এই হলো পানির অবস্থা।”মদাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, “আমার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে পানির সংকট চলছে। অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। সুপেয় পানির জন্য মানুষ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গিয়ে পানি আনছে।” তিনি  আরও বলেন, “মানুষের পানির কষ্টের খবর পেয়ে আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় দশটি গভীর নলকূপ বসিয়েছি। আরও কিছু এলাকায় পানির সংকট রয়েছে সেখানেও গভীর নলকূপ বসিয়ে দিব।” রাজবাড়ীর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু জাকারিয়া বলেন, “পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ব্যক্তিগত অগভীর টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে জেলায় কি পরিমাণ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না সেটার কোনো তথ্য নেই। তিনি জানান, সরকারিভাবে জেলায় গভীর, অগভীর, তারা নলকূপ, সাব-রিংওয়েলসহ মোট ১৯ হাজার ২২৮টি টিউওবয়েল বসানো আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৪১টি টিউবওয়েল অকেজো হয়ে আছে। অপর প্রশ্নের জবাবে আবু জাকারিয়া বলেন, সদর উপজেলার চন্দনি, মিজানপুর, খানগঞ্জ, দাদশী, আলিপুর, বানিবহ ইউনিয়ন এবং পাংশা ও কালুখালী উপজেলায় সব থেকে বেশি পানির সংকট চলছে। তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে রাজবাড়ীতে পানির স্তর আগের তুলনায় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। যে কারণে হস্তচালিত টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। আমরা জনগণকে উৎসাহ দিচ্ছি আমাদের যে সরকারি টিউবওয়েল আছে সেখান থেকে পানি সংগ্রহের জন্য। ” আর জেলায় যে পানির সংকট তৈরি হয়েছে সেটা বৃষ্টি হলেই স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসবে বলে আশা করেন এই কর্মকর্তা।
Published on: 2024-04-28 08:49:35.979389 +0200 CEST