কালবেলা
বিএনপির ভেতরে নানা অস্থিরতা

বিএনপির ভেতরে নানা অস্থিরতা

সরকার পতনের একদফার টানা আন্দোলনে কাঙ্ক্ষিত ফল না আসায় বিএনপির ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় কর্মীদের যেমন হতাশা আছে, তেমনি নীতিনির্ধারকসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যেও রয়েছে মানসিক যন্ত্রণা। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকায় সংসদ বাতিল ও একদফা দাবিতে দল কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেও বিএনপিতে বর্তমানে বড় আন্দোলন করার মতো পরিস্থিতি নেই বলে অনেকের অভিমত। এমন পরিস্থিতিতে অভিমান এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে মহাসচিব ৭৮ বছর বয়সী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় পদে ‘থাকতে চান না’ বলে বিএনপিতে আলোচনা রয়েছে। কারামুক্তির পর দলীয় চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করে মির্জা ফখরুল নিজেই বিষয়টি তুলে ধরেন বলে তার ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা জানিয়েছেন। এ ঘটনায় দলে অস্থিরতা আরও বেড়েছে। তবে দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের মতে, সারা দেশের নেতাকর্মী ছাড়াও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় এই মুহূর্তে বিএনপি মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুলই অপরিহার্য। দলীয় চেয়ারপারসনও তাকে অন্য চিন্তাভাবনা ছেড়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে ফখরুলের ঘনিষ্ঠজনদের দাবি। এ ছাড়া দীর্ঘদিন কাউন্সিল না হওয়া, কেন্দ্রীয় কমিটি না হওয়া এবং জেলা কমিটিগুলো হালনাগাদ হয়নি। সেইসঙ্গে তরুণ নেতাদের প্রভাব বিস্তারসহ নানা কারণে দলের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকা এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে থাকায় দলের ভেতরে নেতৃত্বের আধিপত্য বজায় রাখা নিয়ে কয়েকটি বলয় তৈরি হয়েছে। এসব বলয়ের পক্ষ থেকেও মির্জা ফখরুলকে নানাভাবে চাপ দেওয়া হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। যদিও এসব ইস্যুতে বিএনপির দায়িত্বশীল কোনো নেতা প্রকাশ্যে কথা বলছেন না। জানা গেছে, বিএনপি মহাসচিব নানা কারণে পদে না থাকার বিষয়ে মানসিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলেও চেয়ারপারসনের নির্দেশনার পর চরম সংকটময় মুহূর্তে দেশ, নেতাকর্মী ও জনগণের স্বার্থে তিনি তার সিদ্ধান্ত বদলেছেন। তার ঘনিষ্ঠজনদের দাবি, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন মির্জা ফখরুল। ১৪৮ দিন পর গত ২৫ মার্চ নয়াপল্টনে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ দিয়ে রাজপথের কর্মসূচিতে ফেরেন তিনি। খালেদা জিয়া শারীরিক অসুস্থতা ও আইনি বাধ্যবাধকতায় বর্তমানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রয়েছেন। সাধারণত দলীয় কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন না তিনি। অন্যদিকে তারেক রহমান প্রবাসে রয়েছেন। এমন অবস্থায় সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে আন্দোলনে নামে বিএনপি। লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশনায় আন্দোলন চলতে থাকে। আর দেশে আন্দোলন সরাসরি তত্ত্বাবধান করেন মির্জা ফখরুল। একদফার আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছিল বিএনপি। দলটির অভিযোগ, পুলিশ হামলা চালিয়ে তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ পণ্ড করে দেয়। পণ্ড হওয়া সমাবেশ থেকেই পরদিন সারা দেশে হরতালের ডাক দেন মির্জা ফখরুল। ২৯ অক্টোবর সেই হরতালের সকালে গুলশানের বাসা থেকে মির্জা ফখরুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ১৫ ফেব্রুয়ারি জামিনে কারামুক্ত হন তিনি। নেতাকর্মীদের বড় অংশ রাজপথে না নামায় আন্দোলন চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছায়নি বলে বিএনপির অনেকে মনে করেন। এজন্য দলের একটি অংশের অভিমত, চেয়ারপারসন অসুস্থ ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রবাসে থাকায় দেশে আন্দোলন পরিচালনার পুরো দায়িত্ব ছিল মহাসচিবের। তিনি নেতাকর্মীদের মাঠে নামাতে পারেননি। ফখরুলের ঘনিষ্ঠজনদের দাবি, দলে একটি বড় বলয়ের মধ্যে এ ধরনের আলোচনা বিএনপি মহাসচিবকে ব্যথিত করেছে। এদিকে কারামুক্তির পর ১৯ ফেব্রুয়ারি গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিএনপি মহাসচিব। ওই সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে ফখরুলের ঘনিষ্ঠজনদের দাবি, খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মহাসচিব পদে আর থাকতে না চাওয়ার কথা জানান মির্জা ফখরুল। এজন্য নিজের শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি তুলে ধরার পাশাপাশি বিগত আন্দোলনে ব্যর্থতার দায় নিজের কাঁধে নেন তিনি। তবে তিনি পদত্যাগ করেছেন কিংবা করতে চেয়েছিলেন, বিষয়টি এমন নয়। মির্জা ফখরুলকে তখন কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, অসুস্থ থাকলে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করান, স্ত্রীকেও চিকিৎসা করান। ছুটি নেন, যতদিন লাগে, ততদিন বিশ্রাম নেন। আমি (বেগম জিয়া) জেলে, তারেক রহমান দেশের বাইরে। দলের এই অবস্থা। এখন অন্য কোনোকিছু চিন্তা করার দরকার নেই। ফখরুলের ঘনিষ্ঠজনদের আরও দাবি, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরও বিএসএমএমইউ হাসপাতালে গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে মহাসচিবের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন মির্জা ফখরুল। তখনো নির্বাচনের ফলে ব্যর্থতার দায় নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন তিনি। দলের প্রধান তখন বলেছিলেন, আপনাকে কে দায়ী করেছে, আমি, তারেক রহমান না দলের নেতাকর্মীরা? কারও কোনো কথায় কান দেবেন না, কাজ চালিয়ে যান। বিএনপির এক নেতা বলেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম বিএনপির মতো একটি বড় দলে মহাসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল পদে রয়েছেন। তা ছাড়া খালেদা জিয়া কারাগারে এবং তারেক রহমান বিদেশে রয়েছেন। এমন অবস্থায় আন্দোলন সফল না হওয়া কিংবা নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত ফল না আসার দায় নিয়ে পদ থেকে সরে যেতে চাওয়া রাজনীতিতে একটি গণতান্ত্রিক প্র্যাকটিস। এদিকে মির্জা ফখরুল আর পদে থাকতে চান না—বিএনপির রাজনীতিতে যখন এমন আলোচনা চলছে, তখন দলের একটি অংশ নড়েচড়ে বসে। দলের মহাসচিব হওয়ার প্রশ্নে পাঁচজনের নাম আলোচনায় রয়েছে। তারা হলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। জাতীয়তাবাদী যুবদলের মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে উত্থান মির্জা আব্বাসের। তিনি বিএনপির প্রধান এই অঙ্গ সংগঠনটির সভাপতি হন। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং একাধিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে মির্জা আব্বাসের প্রয়োজনীয়তা এখনো অপরিসীম। আব্বাসের অনুসারীরা তাকে মহাসচিব হিসেবে চান। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ও উঠে আসেন যুবদলের রাজনীতি দিয়ে। তিনি খালেদা জিয়ার সরকারের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপির রাজনীতিতে একটা আলোচনা আছে, যতই দক্ষ-বিচক্ষণ এবং দল ও নেতৃত্বের প্রতি অনুগত হোক না কেন, তাকে মহাসচিব করা হবে না। তবে বছরের অধিককালব্যাপী চলা বিগত আন্দোলনে ব্যর্থতার পরে ঘুরে দাঁড়াতে নানামুখী চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি। দীর্ঘদিন পর এবার হিন্দু সম্প্রদায়ের একজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি করা হয়েছে। বিষয়টিকে কাকতালীয় বলতে নারাজ অনেকেই। পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পদক্ষেপ হিসেবে এবার গয়েশ্বরকে মহাসচিব করে দল নতুন চমক দেখাতে পারে বলে তার অনুসারীদের দাবি। সফল ব্যবসায়ী আমীর খসরু বিএনপি থেকে এমপি এবং খালেদা জিয়ার সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির প্রধানও তিনি। কূটনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত আমীর খসরু মহাসচিব পদে জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বী। ভারতের মেঘালয়ে অবস্থানরত সালাহউদ্দিন আহমেদ এখন দলের হাইকমান্ডের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। সালাহউদ্দিনের অনুসারীরা চান, তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হোক। ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে আসা রুহুল কবির রিজভী রাকসুর সাবেক ভিপি। তার সম্পর্কে বিএনপিপন্থি একজন বুদ্ধিজীবীর মূল্যায়ন, ‘বড় কোনো বিতর্ক ছাড়া দলের দপ্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা বেশ ভালোভাবে পরিচালনা করছেন। সবচেয়ে বড় কথা, দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের প্রতি তার অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতা তাকে সবসময় এগিয়ে রাখবে।’ মির্জা ফখরুল সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব থেকে দলের মহাসচিব হওয়ায় বিএনপিতে রিজভীকেও মহাসচিব করার দাবি জোরালো হচ্ছে। জানা গেছে, শারীরিক অসুস্থতা এবং বয়স বিবেচনায় মির্জা ফখরুলের পরিবারের লোকজন চাচ্ছেন না যে, এই বয়সে তিনি আর মহাসচিব পদে দায়িত্ব পালন করুন। কারাগারে থাকা অবস্থায় তার ৬ কেজি ওজন কমেছে। তবে পারিবারিক আপত্তি সত্ত্বেও খালেদা জিয়ার নির্দেশনা এবং দেশ, দল ও নেতাকর্মীদের স্বার্থে যতদিন সম্ভব দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মির্জা ফখরুল। সম্প্রতি মির্জা ফখরুল নিজেই বলেছেন, তিনি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তিনি রাজনীতিতে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু কালবেলাকে বলেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এটি সরকারের একটি অপকৌশলও বলা যায়। একটি বড় দলের মহাসচিব হিসেবে উনি ১৫ বছর ধরে নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। তার বিষয়টি বিতর্কিত করা উচিত নয়। তিনি রাজনীতি করবেন কী করবেন না, সেটি তিনি নিজেই দলকে বলবেন, জনসম্মুখে বলবেন। কয়েকদিন আগেও তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি রাজনীতি করবেন না—এমন কোনো কথা বলেননি। বরং এই ধরনের অপপ্রচারে তিনি বিস্মিতই হয়েছেন। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, সরকার বিএনপিকে ভেঙে এবং লোক বাগিয়ে নিয়ে নির্বাচন করতে ব্যর্থ হওয়ায় নিজেদের সেই ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বিএনপির নেতৃত্ব সম্পর্কে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। এটা করে তারা বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থকসহ জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে চায়। তিনি আরও বলেন, পুনর্গঠন, নেতৃত্বের পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন—এগুলো চলমান প্রক্রিয়া। এখন বিএনপি মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার কোনো চিন্তাভাবনা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নিজের কিংবা দলের আছে বলে জানা নেই। বিএনপির নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক পর্যায়ের নেতা কালবেলাকে জানান, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন। কিন্তু এমন কেন্দ্রীয় নেতা আছেন, যাদের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কখনো ‘ওয়ান টু ওয়ান’ কথা হয়নি। এটাতেও অনেকের মাঝে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এদিকে বিগত আন্দোলনে সাংগঠনিক দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা সমাধানের দাবি জানাচ্ছেন বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। দলটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সহ-সম্পাদক প্রকৌশলী আশরাফ উদ্দিন বকুল বলেন, বিএনপি একটি বিশাল সংগঠন। ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতেই পারে। এগুলো চিহ্নিত করে সম্মিলিতভাবে নতুনরূপে এগিয়ে যেতে হবে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা কিন্তু হতাশ নন।
Published on: 2024-04-06 06:43:34.218723 +0200 CEST