কালের কণ্ঠ
২৩ বছরে ৪২ বাঘের মৃত্যু

২৩ বছরে ৪২ বাঘের মৃত্যু

খুলনার দাকোপ উপজেলাধীন সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের আন্ধারিয়া খাল থেকে উদ্ধার করা বাঘটির মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার ময়নাতদন্তকারী দল ও বন বিভাগ জানায়, বাঘটির দেহে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। প্রাণীটি রোগাক্রান্তও ছিল না। চলমান দাবদাহে বাঘটি হিট স্ট্রোকে মারা গেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে বাঘের মৃত্যুর সঠিক কারণ বলা যাবে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেতে প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে। গত মঙ্গলবার বিকেলে আন্ধারিয়া খালে ভাসমান অবস্থায় বাঘটির অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ। তারা জানায়, পুরুষ প্রজাতির বাঘটির বয়স আনুমানিক ১১ বছর, দৈর্ঘ্য সাত ফুট আট ইঞ্চি এবং উচ্চতা তিন ফুট। এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের টাইগার পয়েন্ট খাল এলাকা থেকে একটি বাঘের মরদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ। ২০০১ থেকে ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ২৩ বছরে সুন্দরবনে নানাভাবে ৪২টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী খুলনার দা‌কোপ উপ‌জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. ব‌ঙ্কিম কুমার হালদার গতকাল সন্ধ্যায় জানান, কয়েক ‌দিন আ‌গে বাঘ‌টি মারা গেছে। ফলে এটির শরী‌রের অ‌নেকাংশ প‌চে গে‌ছে। প্রাথ‌মিকভা‌বে ধারণা করা হ‌চ্ছে, প্রচণ্ড গর‌মের কারণে হিট স্ট্রো‌কে আক্রান্ত হ‌য়ে বাঘ‌টির মৃত্যু হয়ে‌ছে। মৃত্যুর স‌ঠিক কারণ উদঘাটনে বা‌ঘের শরীর থেকে সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় ফ‌রেন‌সিক ল্যা‌বে পাঠা‌নো হয়েছে। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম জানান, বন বিভাগের সদস্যরা মঙ্গলবার বিকেলে সুন্দরবনের জোংড়া এলাকার আন্ধারিয়া খালে টহলে ছিলেন। এ সময় তাঁরা একটি বাঘের মরদেহ ভাসতে দেখে উদ্ধার করেন। পরে রাতে করমজল বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্রে বন বিভাগ ও দাকোপ উপজেলা প্রশাসনের উপস্থিতিতে প্রাণিসম্পদ বিভাগ বাঘটির ময়নাতদনন্ত সম্পন্ন করে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রচণ্ড গরমের কারণে তিন-চার দিন আগে বাঘটি হিট স্ট্রোকে মারা গেছে। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের করমজল বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির জানান, প্রচণ্ড গরমের কারণে তৃষ্ণার্ত বাঘটি খালে পানি খেতে এসে মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাঘটির দাঁত ও হাড়গোড় সংরক্ষণ করা হয়েছে। ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষার জন্য বাঘের লালা, চামড়া, লিভার, রক্তসহ আলামত সংরক্ষণ করা হয়। বাঘের দেহাবশেষ করমজল বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্রে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। ডিএফও কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম জানান, বাঘ রক্ষায় সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। সুন্দরবনে বাঘসহ বন্য প্রাণীর আবাসস্থল বাড়ানো হয়েছে। মোট ছয় লাখ এক হাজার ৭০০ হেক্টর বনের মধ্যে এখন তিন লাখ ১৭ হাজার ৯০০ হেক্টর অভয়ারণ্য এলাকা। আগে ছিল মাত্র এক লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর। ২০১৭ সালে সরকার সুন্দরবনে অভয়ারণ্য এলাকা সম্প্রসারণ করে। সুন্দরবনে বাঘের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টহল ফাঁড়ির কার্যক্রমের পাশাপাশি স্মার্ট প্যাট্রল করা হচ্ছে। বাঘ যাতে সুন্দরবন ছেড়ে লোকালয়ে যেতে না পারে সে জন্য বনের সীমানা এলাকায় বন বিভাগের টহল বাড়ানো হয়েছে। সার্বক্ষণিক বন বিভাগ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০০১ থেকে ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ২৩ বছরে সুন্দরবনে ৪২টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে ২৬টি এবং পশ্চিম বিভাগে ১৬টির মৃত্যু হয়। কখনো চোরাশিকারির হাতে, কখনো সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে বের হলে লোকজনের পিটুনির শিকার হয়ে বাঘ মারা গেছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসেও বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া অসুস্থ হয়ে এবং বার্ধক্যজনিত কারণে বাঘ মারা গেছে। এই সময়ে প্রায় ২০টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে। ২০১৮ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুসারে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ১১৪। বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা জানতে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ গণনার কাজ চলছে। বাঘ রক্ষায় নানামুখী উদ্যোগ নেওয়ায় সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে বলে বন বিভাগ আশা করছে। জানা গেছে, সুন্দরবনে প্রতিটি বাঘ তাদের আবাসস্থলের জন্য ১৪ থেকে ১৬ বর্গকিলোমিটার (হোমরেঞ্জ) চিহ্নিত করে সেখানে বাস করে। আর গোটা সুন্দরবনেই বেঙ্গল টাইগার বিচরণ করে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকির কারণে লবণাক্ততা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও নদীর স্রোত প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করছে বাঘ। নদী-খাল ভরাট হওয়ার কারণে বাঘ মাঝেমধ্যে সুন্দরবন ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। বনসংলগ্ন গ্রামে ঢুকে পড়লে গ্রামবাসীর হাতে কখনো কখনো বাঘের প্রাণহানি ঘটে। আর সুন্দরবনে চোরাশিকারিদের তৎপরতা একেবারে বন্ধ করা যায়নি। বিভিন্ন সূত্র বলছে, বাঘের আটটি উপপ্রজাতির তিনটি এরই মধ্যে বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের মাত্র ১২টি দেশে বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব রয়েছে। সারা বিশ্বে বন উজাড়, শিকারি ও পাচারকারীদের কারণে বাঘ মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
Published on: 2024-05-03 04:30:42.245196 +0200 CEST