Bdnews24 Bangla
জীবন আর প্রতিবেশ পাল্টানোর ৫ উদ্যোগ পেল ব্র্যাকের পুরস্কার

জীবন আর প্রতিবেশ পাল্টানোর ৫ উদ্যোগ পেল ব্র্যাকের পুরস্কার

চট্টগ্রামের নিউ মার্কেটে এক বান্ধবীর জন্য জামা কিনতে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সৈয়দা নুজহাত জাবিন; কিন্তু একটা ফ্ল্যাট আকারের কাপড় পেতে তাদের টানা চার ঘণ্টা ঘুরতে হয়েছিল। এর মাঝে দোকানিদের হাসাহাসি আর কটু কথাও মুখ বুজে সইতে হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী ও তার সঙ্গীকে। সেই অপমানের কথা মনে রেখে পরে কয়েকজনে মিলে নিলেন এক উদ্যোগ; যেখানে  মিলবে সব বয়সীদের সব আকারের জামাকাপড়। ‘মুক্ত’ নামে তাদের সেই উদ্যোগ শনিবার পেয়েছে ব্র্যাকের ‘ইয়াং চেইঞ্জমেকার্স অ্যাওয়ার্ড’, যা তুলে দিয়েছেন স্পিকার শিরিন শারমীন চৌধুরী। চলতি বছর ব্র্যাকের ইয়থ প্ল্যাটফর্মের ‘আমরা নতুন নেটওয়ার্ক’ এর আওতায় নির্ধারিত কমিউনিটিভিত্তিক প্রকল্পগুলোর মধ্য থেকে উদ্ভাবনীমূলক ধারণা উপস্থাপনের মাধ্যমে শীর্ষ ১০টি প্রকল্প নির্বাচিত হয়। এগুলোর মধ্যে সেরা পাঁচটি প্রকল্পকে ‘ইয়াং চেইঞ্জমেকার্স অ্যাওয়ার্ড ২০২৪’ দেওয়া হয়। পুরস্কার গ্রহণের পর নুজহাত বললেন, ”ঠিক সাইজের কাপড় না পাওয়ার ‘সমস্যাটা এই রুমের অনেকের, সমস্যাটা এই বাংলাদেশের অনেকের, সমস্যাটা আমাদের। আর সেই সমস্যা আমরা সমাধানের চেষ্টা করেছি।” নিজেদের উদ্যোগের গল্প শুনিয়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রামে ছাত্রছাত্রীদের জামাকাপড় কেনার সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা ওইটা। সেই নিউ মার্কেটে গিয়ে বান্ধবীকে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। “চার ঘণ্টা পুরো মার্কেট খুঁজে আমি ওর জন্য মাত্র একটা কাপড় খুঁজে বের করতে পেরেছিলাম। আমি সারাজীবনই দর্জির কাছে অপমানিত হয়েছি, যখনই কোনো জামা বানাতে গিয়েছি। সমস্যাটা আমার কিংবা আমার বান্ধবীর না। আজকে আমরা যে স্টল দিয়েছি, আমি অন্তত ৩০টি গল্প শুনেছি, যারা এই রকম সংগ্রাম মোকাবেলা করেছে।” নুজহাত বলেন, “আমরা অনেকগুলো সাইজের কাপড় এনেছি, অনেকগুলো কাপড় এনেছি। কিন্তু আমার কাছে একটা ছোট অর্জন, যেটা আমার কাছে সবচেয়ে কাছের। সেটা হচ্ছে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝুপড়িতে জামাককাপড় চাইলে দোকানদাররা খুব অপমান করত, হাসাহাসি করত। এখন সেটা আর হবে না। “আপনাকে এই কথাটা দিতে পারছি না যে, গেলে আপনি যে কোনো সাইজের জামাকাপড় পেয়ে যাবেন। তবে, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আপনার সাথে কেউ খারাপ করবে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না।” তিনি বলেন, “যে পরিবর্তন আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে পেরেছি, আমরা বিশ্বাস করি, আমরা সেই পরিবর্তনটা বাংলাদেশে আনতে পারি।” স্বস্তি আর স্বাধীনতার সঙ্গে মানুষের পোশাক বাছাইয়ের প্রকল্প ‘মুক্ত’ যেভাবে পুরস্কার পেয়েছে, খুলনার ‘প্রজেক্ট উজ্জীবন’ পেয়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেরকে প্লাস্টিক পণ্য ও পোশাকের পুনরায় ব্যবহার (রিসাইক্লিং) সম্পর্কে সচেতন করে। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কয়েকজন তরুণ-তরুণী মিলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘জলবায়ু ক্লাব’ গঠন করার মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বার্তা নিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে। ‘মুক্ত’ ও ‘প্রজেক্ট উজ্জীবন’সহ দেশের নানা প্রান্তে তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মোট পাঁচটি প্রকল্পকে ‘ইয়াং চেইঞ্জমেকার্স অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়।*পুরস্কার পেল আরও যেসব প্রকল্প* রাজশাহীতে একটি মাদ্রাসার নারী শিক্ষার্থীদের ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দিয়ে পুরস্কার পেয়েছে ‘প্রজেক্ট খাদিজা’; মাত্র তিন মাসে ৬৩ জন শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ২৩ জনকে অর্থ উপার্জনের উপযোগী করে তুলেছে তারা। ময়মনসিংহে বিহারী ক্যাম্পের নারীদের কাজ শিখিয়ে তাদের তৈরি কাপড় বাজারজাত করার প্রকল্প নিয়ে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছে ‘উদ্যমিতা’। বরিশালে বস্তি এলাকার মানুষের মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা তৈরি এবং সেখানকার বর্জ্য থেকে সার উৎপাদন করার প্রকল্প ‘ওয়েইস্ট টু রিসোর্সেস’ এসেছে পুরস্কারের তালিকায়। *তরুণদের উৎসাহ দিলেন স্পিকার* পুরস্কার তুলে দেওয়ার আয়োজনে নিজের জীবনের বিভিন্ন গল্প শোনানোর পাশাপাশি তরুণদের জন্য উৎসাহমূলক বক্তব্য দেন স্পিকার শিরিন শারমীন চৌধুরী। বয়সের ফারাক থাকলেও নিজের সন্তানদের দেখে তরুণদের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন দেখতে পান বলে মন্তব্য করেন ১৯৮৩ সালে সারা দেশে প্রথম স্থান অধিকার করে মাধ্যমিক পাস করা এই রাজনীতিক। তিনি বলেন, “আমার ছেলের বয়স এই সেপ্টেম্বরে ২১ হবে। সে মোটামুটি তোমাদের তরুণ সমাজেরই একজন বলা যায়। তার সাথে আমার যে মিথষ্ক্রিয়া হয়, সেখান থেকে আমি কিছুটা হলেও বর্তমান তরুণ সামজের যে চিন্তাধারা, পালস যেভাবে তারা ভাবছে, সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারি। “এবং সেই জানার মধ্যে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমার সাথে চিন্তার জায়গাগুলোতে অনেক ভিন্নতা রয়েছে। কোনটা সঠিক, কোনটা ভুল সেই বিচারে বা বিশ্লেষণে আমি যাব না। কিন্তু চিন্তাধারার মাঝে নিশ্চিতভাবে অনেক পার্থক্য আমরা লক্ষ্য করি। এবং সেটা ইতিবাচক বলে মনে করি। কারণ, নতুন প্রজন্ম নতুনভাবে ভাববে, নতুনভাবে সমস্যার সমাধান দেবে, তাদের উদ্যমী-উদ্ভাবনী প্রাণশক্তি দিয়ে সমাজকে পরিবর্তন করবে।”আজকের তরুণ সমাজকে ‘অত্যন্ত ঐতিহ্য এবং গৌরবের উত্তরাধিকারী’ হিসেবে তুলে ধরে স্পিকার বলেন, “এই বাংলাদেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যে নতুন দেশটির জন্ম নিয়েছিল ১৯৭১ সালে, সেই দেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে, দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন থেকে মুক্তি দিয়ে, বাঙালির জাতি স্বত্তার মধ্য দিয়ে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছিল, সেখানেও নেতৃত্ব দিয়েছিল, এই দেশের তখনকার তরুণ প্রজন্ম।” তিনি বলেন, “অপার সম্ভাবনার মধ্যেই তোমাদের বেড়ে উঠা। কাজেই, তোমরা এই সম্ভাবনাগুলোকে পরিপূর্ণভাবে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজে লাগাতে পার, সেটার প্রতি অবশ্যই তোমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।” বঙ্গবন্ধুসহ বড় বড় নেতারা মানুষের মুক্তিকে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন মন্তব্য করে শিরিন শারমীন বলেন, “তোমরা তোমাদের অগ্রাধিকার দিবে, সেটাকে ভাবতে হবে। সেই ভাবনা সবারটা ভিন্ন হবে, কিন্তু সেই ভাবনার মাঝেই কিছু জিনিস কমন থাকতে হবে। “দেশপ্রেম, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দেশের মানুষের প্রতি একটা কর্তব্যবোধ, একটা দায়িত্ববোধ। যেমনি করে তোমার পরিবারের প্রতি, বাবা-মায়ের প্রতি সেই দায়িত্ববোধটা থাকতে হবে।”তিনি বলেন, “এই দেশের শতকরা ১৮ ভাগ মানুষ এখনও অতি দরিদ্র। তাদের মাঝেও তরুণ সমাজ আছে, তাদের মাঝেও শিশু সন্তানরা আছে। তাদের মাঝেও নারীরা আছে। তাদের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য তোমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে। কারণ, মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার মতো সন্তুষ্টি ও সার্থকতা, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ’ইনফ্লুয়েন্সার’ রাবা খান ও সাকিব বিন রশীদের সঙ্গে লাইভ আড্ডায় যোগ দেন ইয়াং চেঞ্জমেকাররা। সম্মাননা প্রদান শেষে রাবা খান পাঁচ প্রকল্পের ’চেঞ্জমেকারদের’ সঙ্গে তাদের সমাজ বদলের গল্প শুনতে এক অনানুষ্ঠানিক মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন। অনুষ্ঠানে বলা হয়, দেশের যুব ও কিশোর-কিশোরীদের মাঝে সহমর্মিতাভিত্তিক সামাজিক নেতৃত্ববোধ তৈরি, মানবিক মূল্যবোধ গঠন ও একবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন সমস্যার সমাধানমূলক দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে ব্র্যাক ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম।এটির অন্যতম কার্যক্রম, ‘আমরা নতুন নেটওয়ার্ক’ এর তরুণ অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন উদ্যোগ সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। পরিবর্তনের উৎসবে ইয়াং চেঞ্জমেকারদের সঙ্গে একটি টাউন হল সেশনে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ বলেন, “যে কাজটা করবে মনে প্রাণে করবে যাতে করে অনেক বেশি মানুষের জীবনে প্রভাব রাখতে পারো। তোমার স্বপ্নটা যেন বড় হয়, খাঁটি হয়। আর জোট বেঁধে কাজ করবে। একজন কোনো ভালো কাজে এগিয়ে এলে আরও অনেকে আসে। এজন্যই আমরা নতুন নেটওয়ার্ক করা হয়েছে যাতে আমরা একজন আরেকজনের পাশে থাকতে পারি।” অনুষ্ঠানের শুরুতে সূচনা বক্তব্য রাখেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান। এরপর দেশের নানা প্রান্তের ইতিবাচক নানা সামাজিক পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের (ইয়াং চেঞ্জমেকার) সামাজিক উদ্যোগ ও তাদের উৎপাদিত পণ্যসম্ভার বিভিন্ন স্টলে প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানে ইয়াং চেঞ্জমেকারদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়। সংগীতশিল্পী মিনার ও মাশার পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা উপভোগ করেন অংশগ্রহণকারীরা। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে রোববার দুদিনের উৎসব শেষ হবে।
Published on: 2024-04-27 18:58:59.564027 +0200 CEST