কালের কণ্ঠ
এত আগ্রহ কেন বিসিএসে?

এত আগ্রহ কেন বিসিএসে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পাঠাগারে বিকেলের পর ঢুকলেই ভিন্ন দৃশ্য চোখে পড়বে। বিশাল এই পাঠাগারে শিক্ষার্থীরা বসার জায়গা পান না। স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে, এটাই তো স্বাভাবিক দৃশ্য হওয়ার কথা। শিক্ষার্থীরা তো পড়ালেখা করবেনই। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো, শিক্ষার্থীরা পাঠাগার থেকে নিয়ে তেমন কোনো বই পড়ছেন না। তাঁরা নিজেরাই নিয়ে আসা বিসিএসের নানা গাইড বই পড়ছেন। মূলত নিরিবিলি জায়গা পাওয়ার জন্যই তাঁরা পাঠাগারে ঢুকেছেন। অথচ সাত-আট বছর আগেও দৃশ্যপট ছিল ভিন্ন। পাঠ্য বই রেখে বিসিএসে কেন ডুবে আছেন শিক্ষার্থীরা? এর উত্তর খুঁজতেই মিলল সরকারি চাকরির প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা। অনেকের উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যই যেন বিসিএস। কেউ কেউ ক্লাসে ভালো ফল না করলেও বিসিএসে ঠিকই ভালো করছেন। আবার বিসিএস থেকে আগের চেয়ে অধিকসংখ্যক নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়ায় বিসিএসের প্রতি আগের আগ্রহ আরো বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একসময় সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা থাকলেও সুযোগ-সুবিধা কম ছিল। বর্তমানে বিসিএস ক্যাডারগুলোতে সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। হয়তো এর মধ্যেও কোনো ক্যাডার অধিক ভালো আছে। অন্যদিকে বেসরকারি চাকরিতে অনিশ্চয়তা থাকে। কিন্তু সরকারি চাকরিতে রক্ষাকবচ বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিসিএসে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ছে।’ ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় গত শুক্রবার। এতে অংশ নেন প্রায় তিন লাখ ৩৮ হাজার চাকরিপ্রার্থী, যাঁদের সবাই স্নাতক সম্পন্ন করা। ওই দিন রাজশাহীর এক পরীক্ষাকেন্দ্রে বিসিএসে অংশ নিতে না পেরে একজন পরীক্ষার্থীর রাস্তায় গড়াগড়ি খাওয়ার বিষয়টি সবার নজরে আসে। এতে বিসিএসের প্রতি গুরুত্ব নতুন করে সবার সামনে আসে। গত ১০ বছরে বিসিএসে আগ্রহ ব্যাপকভাবে বাড়ছে তরুণদের। ফলে স্বল্পসংখ্যক পদের বিপরীতেও তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হচ্ছে প্রার্থীদের। তবে কয়েক বছর ধরে বিসিএস পরীক্ষা থেকে অধিকসংখ্যক প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশকে অনেকটা বোনাস হিসেবেই দেখছেন প্রার্থীরা। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিসিএস দেওয়ার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, এখানে যোগ্যতা ও মেধা থাকলেই চাকরি হয়। আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া আগে থেকেই সরকারি চাকরির প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ছিল। ইদানীং সুযোগ-সুবিধা বাড়ায় সেই আগ্রহ আগের চেয়ে বেড়েছে। আমার মনে হয়, করোনাকালীন বেসরকারি চাকরিজীবীরা বড় ধাক্কা খেয়েছেন, সেটাও শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরিতে আগ্রহ বাড়ার কারণ। তবে একজন প্রার্থী যতবার খুশি ততবার বিসিএস দিতে পারেন, এতে একই প্রার্থী বারবার পরীক্ষা দেওয়ায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে।’ শিক্ষার্থীরা জানান, তাঁরা মূলত স্নাতকের (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের শুরু থেকে বিসিএসের জন্য ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তখন শ্রেণির পড়ালেখা তাঁদের কাছে অনেকটা ঐচ্ছিক হয়ে যায়। স্নাতক পরীক্ষার পর প্রশংসাপত্র দিয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিতে শুরু করেন। চাকরির বয়স থাকা পর্যন্ত অনেকেই পাঁচ-ছয়বার পর্যন্ত বিসিএস দিয়ে থাকেন। জানা যায়, বিসিএসের মাধ্যমে পাওয়া প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি অনেকটাই ‘সোনার হরিণ’। শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ থাকে প্রশাসন। এরপর পররাষ্ট্র, পুলিশ বা ট্যাক্স ক্যাডার। এগুলো না পেলে যেটাই পান, সেটাতেই যোগদান করেন। প্রশাসন ক্যাডারের জন্য মরিয়া হওয়ার মূল লক্ষ্য, সরকারের প্রশাসনে কাজ করতে পারা। সহকারী কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক ও সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরির সুযোগ পাওয়া। অন্যদিকে পুলিশ, পররাষ্ট্র বা ট্যাক্স ক্যাডারও প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক দিয়ে এগিয়ে। আর এসব ক্যাডারে সুযোগ না পেলে ২৬ ক্যাডারের যেকোনো একটিতেই সুযোগ পেলে খুশি শিক্ষার্থীরা। সূত্র জানায়, ৩৭তম বিসিএসে আবেদনকারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৪৩ হাজার ৪৭৬ জন। এর পর থেকেই বিসিএসে তরতর করে আবেদনকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ৩৮তম বিসিএসে তিন লাখ ৪৬ হাজার ৪৪৬ জন, ৩৯তম (বিশেষ) বিসিএসে ৩৭ হাজার ৭১৩ জন, ৪০তম বিসিএসে চার লাখ ১২ হাজার ৫৩২ জন, ৪১তম বিসিএসে চার লাখ ৭৫ হাজার জন, ৪২তম (বিশেষ) বিসিএসে ৩১ হাজার জন, ৪৩তম বিসিএসে চার লাখ ৩৫ হাজার ১৯০ জন, ৪৪তম বিসিএসে তিন লাখ ৫০ হাজার ৭১৬ জন, ৪৫তম বিসিএসে দুই লাখ ৬৮ হাজার ১১৯ জন এবং সর্বশেষ ৪৬তম বিসিএসে তিন লাখ ৩৮ হাজার জন অংশ নিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিসিএসের জন্য আকৃষ্ট হওয়া খারাপ না। তবে কোর্সের পড়া বাদ দিয়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া ঠিক না। এ জন্য বিসিএস পরীক্ষার ধরন-ধারণে পরিবর্তন আনতে হবে। আসলে দেখতে হবে, প্রার্থীদের ক্রিয়েটিভিটি কতটুকু। একজন প্রার্থী নতুন সমস্যা সমাধানে কতটুকু সাকসেসফুল। আর সরকারি চাকরিতে সম্মান, নিশ্চয়তা, পেনশনের ব্যবস্থা আছে। যদি বেসরকারি চাকরিতেও সুবিধা আরেকটু বাড়ানো যায়, তাহলে অনেকেই বেসরকারি চাকরির কথা চিন্তা করবেন।’ জানা যায়, বর্তমানে তিনটি বিসিএস পরীক্ষার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল গত ৩ এপ্রিল প্রকাশ করা হয়েছে। এতে উত্তীর্ণ হয়েছেন ১১ হাজার ৭৩২ জন, যাঁদের মৌখিক পরীক্ষা আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ১২ হাজার ৭৮৯ জন, যাঁদের ২৩ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। যাঁরা এখন লিখিতের ফলের জন্য অপেক্ষা করছেন। আর ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় গত শুক্রবার। এই বিসিএসে তিন লাখ ৩৮ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। এর মাধ্যমে সাধারণ ক্যাডারে ৪৮৯ জন, প্রফেশনাল বা টেকনিক্যাল ক্যাডারে দুই হাজার ৭৪ জন (সহকারী সার্জন এক হাজার ৬৮২ জন, সহকারী ডেন্টাল সার্জন ১৬ জন, সহকারী প্রকৌশলী ৬৫ জন) ও সাধারণ শিক্ষায় ৫২০ জন ও কারিগরি শিক্ষায় ৫৭ জন সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাবেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগেও বিসিএসে মেধাবীরা চাকরি পেতেন। তবে সেটা ছিল হাতে গোনা। পিএসসিতে তদবির, অনিয়ম ও বাণিজ্য বাসা বেঁধেছিল। বিভিন্ন ধরনের হস্তক্ষেপ ছিল চোখে পড়ার মতো। দেখা যেত ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী ও যাঁরা বড় অঙ্কের ঘুষ দিতে পারতেন তাঁদের প্রাধান্য ছিল বিসিএসে। এমনকি বাণিজ্য ও অনিয়মের অভিযোগে ২৭তম বিসিএস বাতিল পর্যন্ত করা হয়েছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরে অনিয়ম নেই বললেই চলে। আর গত কয়েক বছরে তদবিরও নেই। ফলে প্রার্থীদের আগ্রহ বেড়েছে। আগে মেধাবীরা পড়ালেখা শেষে বিসিএস না দিয়ে দেশের বাইরে, এনজিও ও বড় বড় কম্পানিতে চাকরি করতেন। কিন্তু এখন মেধাবীরা সবার আগে বিসিএসে চেষ্টা করছেন। পিএসসি সূত্র জানায়, ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পদে পিএসসির সুপারিশ পেয়েছিলেন ১৬ হাজার ৯০ জন। এর মধ্যে ক্যাডার পদে ১২ হাজার ৭১৯ জন ও নন-ক্যাডার পদে তিন হাজার ৩৭১ জন। ২০০৭-০৮ সালে মোট সুপারিশ পেয়েছিলেন চার হাজার ১৬৫ জন। এর মধ্যে ক্যাডার পদে তিন হাজার ৬৪৬ জন ও নন-ক্যাডার পদে ৫১৯ জন। আর ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট সুপারিশ পেয়েছেন ৬৬ হাজার ২৫৬ জন। এর মধ্যে ক্যাডার পদে ৩১ হাজার ৩৩৩ জন ও নন-ক্যাডার পদে ৩৫ হাজার ৯২৩ জন। আর ২০২০ সালে ৩৯তম বিশেষ বিসিএসে দুই হাজার চিকিৎসক, ২০২১ সালে ৪২তম বিশেষ বিসিএসে চার হাজার চিকিৎসক, ২০২২ সালে ৪০তম বিসিএসে এক হাজার ৯৬৩ জন, ২০২৩ সালে ৪১তম বিসিএসে দুই হাজার ৫২০ জন ও ৪৩তম বিসিএসে দুই হাজার ১৬৩ জন ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন। এই বিসিএসগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নন-ক্যাডার পদেও নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন। জানা যায়, করোনার সময় বিসিএসে জট লাগলেও গত বছর থেকে তা খুলতে শুরু করেছে। গত বছরই দুটি বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়। আর এ বছর একই সঙ্গে তিনটি বিসিএসের কার্যক্রম চলছে। আর কয়েক বছর ধরে বিসিএসে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের যাঁরা ক্যাডার পদে সুপারিশ পান না, তাঁদের মধ্য থেকে অধিকসংখ্যক হারে নন-ক্যাডারে সুপারিশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ উত্তীর্ণ হলেই যেকোনো পদে চাকরি অনেকটা নিশ্চিত।
Published on: 2024-04-28 05:15:40.14667 +0200 CEST