কালের কণ্ঠ
চার মাসে গণপিটুনিতে ২৪ হত্যা

চার মাসে গণপিটুনিতে ২৪ হত্যা

ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার চাকুয়া গ্রাম থেকে ভেঙে ভেঙে ঢাকায় আসছিলেন দুই প্রতিবেশী মো. নাসির (৩২) ও মো. হৃদয় (২২)। পথে রাত হয়ে যায়। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সিংহশ্রী ইউনিয়নের নামিলা গ্রামে পৌঁছে তাঁরা যাত্রাবিরতি দেন। সেখানে রাস্তার পাশে একটি দোকানে বসে দুজনে চা পান করছিলেন। ওই সময়টায় নামিলা গ্রামে ঘন ঘন গরু চুরির ঘটনা ঘটছিল। স্থানীয়রা চায়ের দোকানে অপরিচিত লোক দেখে গরুচোর সন্দেহে কিছু বুঝে ওঠার আগেই গণপিটুনি দিয়ে নাসির ও হৃদয়কে গুরুতর জখম করে। পরে উদ্ধার করে কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাটি ঘটে গত ২৯ মার্চ রাতে। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ দুটি গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠালে স্বজনরা সেখানে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। শুধু নাসির ও হৃদয়কে হত্যা নয়, প্রায়ই খবর পাওয়া যায়, দেশের কোথাও না কোথাও বিভিন্ন কারণে সন্দেহের জেরে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সর্বশেষ গত ১৮ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নে মন্দিরে আগুনের ঘটনায় সন্দেহের জেরে দুজন শ্রমিক আশরাফুল খান ও আসাদুল খানকে (আপন ভাই) গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে গতকালও সংশ্লিষ্ট এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির পরিসংখ্যান বলছে, দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ২৪ জনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা করা হয়েছে। কাপাসিয়ায় গণপিটুনিতে নিহত মো. নাসির দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় ছিলেন। দেশে ফিরে তিনি এলাকায় মাছের খামার করেন। তাঁর দুটি শিশুসন্তান রয়েছে। গণপিটুনিতে স্বামীকে হত্যার পর নাসিরের স্ত্রী নুর নাহার দুই সন্তান নিয়ে ভয়াবহ কষ্টের জীবন পার করছেন। নুর নাহারের সঙ্গে কথা হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী নিরপরাধ মানুষ ছিলেন। আর অপরাধ করলেও আইনের তোয়াক্কা না করে কাউকে কি এ রকম নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করা যায়? যারা আমার স্বামীকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’ গণপিটুনিতে নির্দয় হত্যাকাণ্ডের বড় উদাহরণ রেনু হত্যাকাণ্ড। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তসলিমা বেগম রেনু নামের এক নারীকে। ওই সময়টায় ছেলেধরা গুজব চলছিল। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে দিন দিন গণপিটুনিতে হত্যাকাণ্ড বেড়েই চলেছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব মতে, ২০২৩ সালে দেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ৫১ জন, ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৬, ২০২১ সালে ২৮, ২০২০ সালে ৩৫ এবং ২০১৯ সালে ৬৫। আর ২০১৯ সাল থেকে চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ২৪৮ জন। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলেছে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে গণপিটুনিতে দেশে যেসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে। এসব মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত আছে। পুলিশ সদর দপ্তরের অপারেশনস বিভাগের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনোভাবেই কাউকে পিটিয়ে হত্যা করা মেনে নেওয়া যায় না। দেশের কোনো নাগরিক নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারেন না। যারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের অনাস্থা। যারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর আরো তৎপর হতে হবে। *কাপাসিয়ার সিংহশ্রীতে দুজনকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে* মালয়েশিয়াপ্রবাসী মো. নাসির ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার চাকুয়া গ্রামের মাসুদ সেখের ছেলে। আর হৃদয় একই এলাকার আবু শাহীদের ছেলে। পারিবারিক সূত্র জানায়, করনাকালে নাসির মালয়েশিয়া থেকে দেশে এসে আর ফিরে যাননি। গ্রামে বেশ কটি পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। পাশাপাশি অন্য ছুটা কাজও করতেন। ঈদ ের আগে প্রতিবেশী হৃদয়ের সঙ্গে গ্রাম থেকে রাজধানীতে আসছিলেন বাড়তি রোজগারের আশায়। কিন্তু কাপাসিয়ার গুদারাঘাট পার হয়ে রাত ১০টার দিকে নামিলা গ্রামে পৌঁছে একটি দোকানে চা পান করতে যান। ওই সময় গরুচোর সন্দেহে তাঁদের পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। নিহত নাসিরের ভাই মাসুম বলেন, ‘নাসির ও হৃদয় কোনো অপরাধী নন। দেশের কোথাও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। এর পরও লোকজন শুধু সন্দেহের জেরে গণপিটুনি দিয়ে তাঁদের হত্যা করে।’ তিনি বলেন, ‘নাসিরের নুসরাত (৩) ও করবী (তিন মাস) নামে দুটি শিশুসন্তান রয়েছে। তাঁর স্ত্রী নুর নাহার ঘটনার পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এখন এই দুই মাসুম বাচ্চা ও স্ত্রীর দায়িত্ব কে নেবে! যারা দেশের আইনকে তোয়াক্কা না করে মানুষ পিটিয়ে হত্যা করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।’ এ ঘটনায় গ্রাম পুলিশ জহিরুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে। তবে এখনো কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। কারণ জানতে চাইলে কাপাসিয়া থানার ওসি আবু বকর মিয়া বলেন, ‘এ ঘটনার তদন্ত চলছে।’ অপরাধ বিশ্লেষক মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ সাইন্স অ্যান্ড ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ‘গণপিটুনির নামে আইন কোনোভাবেই নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। যারা এভাবে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করছে তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। বিশেষ করে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে মানুষকে সচেতন করতে হবে।’
Published on: 2024-04-27 23:41:48.458413 +0200 CEST